Menu

প্রবাস বাংলা ভয়েস ডেস্ক ::‌ ইদানীং আশ্চর্য রকম এক নীরবতা খেলে যাচ্ছে তার চোখে-মুখে। সবকিছুতেই কেমন যেন উদাস ভাব। দিন কয়েক আগেও তো স্বাভাবিক ছিল লোকটা। হাসত, গাইত আর কাজ শেষে বাড়ি ফিরত। বাড়িতে এসে শেফালীর কাজে বেশ সাহায্যও করত। কিন্তু কিছুদিন থেকে তার এ রকম গাঢ় নীরবতা খুব পীড়া দিচ্ছে স্ত্রী শেফালীকে। বিশেষ করে একমাত্র মেয়ে ফোসোর বিয়ে দেওয়ার পর থেকেই এ রকম মনমরা ভাব দেখা যাচ্ছে। শীতের লোহার মতো দিনে দিনে ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে লোকটা। আগের মতো প্রাণচাঞ্চল্য দেখা যাচ্ছে না আর। মন কেমন করে ওঠে শেফালীর। পাহাড় সমান সোহাগ নিয়ে তাকায় ঘুমন্ত স্বামীর দিকে। চড়ুইপাখির মতো শান্ত মুখ তার স্বামী সলিমের। শ্যামলা রঙা চোখ। চোখের নিচে লম্বা কালশিটে দাগ। সেই চোখ জোড়ায় এখন গভীর ঘুম। শেফালীর বুকটা হুহু করে ওঠে। পরম মমতায় আস্তে আস্তে হাত বুলিয়ে দেয় স্বামীর চুলে। কিন্তু চুলে আঙুল ঢোকে না। চুলগুলো শক্ত হয়ে গেছে তারের মতো।

ধুলোবালিতে ভর্তি পুরো মাথা। ধুলোবালি ছাড়া কি-ই বা থাকার কথা। প্রতিদিন সন্ধ্যায় বামুনিয়া থেকে হেঁটে আঠিয়াবাড়ি, ওখান থেকে বাংলাদেশ সীমান্ত পার হয়ে ইসলামপুরের থুকরাবাড়ি হাট; সেখান থেকে মাথায় পঞ্চাশ কেজি ওজনের লবণের বস্তা নিয়ে লাহিড়ী হাটের হোসেন পাইকারের গুদাম। কম রাস্তা! আসা-যাওয়ায় কমপক্ষে ষোলো-সতের কিলোমিটার পথ। ক্লান্ত শরীর অতশত পয়-পরিষ্কার বোঝে না। বাসায় ফিরে তাই কোনো মতো হাতটা ধুয়ে ডাল-ভাত খেয়েই ঘুমে তলিয়ে যায় সলিম। এ চিত্র কম-বেশি প্রতিদিনের।

শেফালী লক্ষ করে, শীতের মধ্যে কিছুটা গুটিশুটি হয়ে শুয়ে আছে সলিম। সে কাঁথাটা টেনে মুড়িয়ে দেয় গলা পর্যন্ত। ঘুম ভেঙে গেছে একটু আগে। বিছানা ছেড়ে বারান্দায় চুপ করে এসে বসে ও। ঘোকশোল পাড়ার দিক থেকে একটা শিশুর কান্নার আওয়াজ ভেসে আসছে। খমির দোকানির মোড় থেকে কয়েকটি কুকুরের করুণ ডাক বন্ধই হলো না এখনো। অনবরত ডেকেই চলছে তারা।

বারান্দায় বসে ঢকঢক করে এক গ্লাস পানি খায় শেফালী। রান্নাঘরে একবার গিয়ে দেখে আসে মা আখিলনকে। তারপর একটা বিড়ি ধরায়। বিড়ি খাওয়া শিখেছিল মা আখিলনকে দেখেই। তাও বহুদিন হলো। মাঝে মধ্যে স্বামীর সঙ্গেও খেত; ইদানীং খায় না আর।

শেফালী আর সলিমের বাড়ির সামনেই ইয়াজত আর খাতুনের ঘর। পশ্চিম পাশে ইয়াকুবের। মাঝখানে বিশাল একটা আঙ্গিনা। শেফালীর ঘরের সঙ্গে লাগোয়া পুব দিকের রান্নাঘরটার এক কোণে থাকেন শেফালীর মা আখিলন বুড়ি। শেফালীকে তিনি আদর করে ‘ঝোকো’ নামে ডাকতেন।

আখিলন আর টেপা মোহাম্মদের কোনো সন্তানাদি ছিল না। তাই শরমজানি গ্রাম থেকে পালিত কন্যা হিসাবে নিয়ে এসে নিজের মেয়ের মতোই আদর-যত্নে বড় করেছেন। বুকে আগলে রেখেছেন। অনেক বড় হয়ে সেটা জানতে পেরেছে শেফালী। তা-ও বিয়ের আগে। ১৯৮০ সালে। আজকের মতো সেদিনও অঘ্রাণের রাত ছিল। ঠান্ডা, কুয়াশাঘেরা। হালকা শীতে লাল একটি চাদর গায়ে জড়িয়ে সলিমের সঙ্গে শেফালীর সংসার সেদিন শুরু হয়েছিল এখানেই, এই বামুনিয়া গ্রামে।

সলিম তার বাবা লাল মিয়াসহ কাজের সন্ধানে এসেছিল এই গ্রামে। রংপুরের গঙ্গাচড়ায় বাড়ি ছিল তাদের। তিস্তার ভাঙনে সর্বস্বান্ত হয়ে কাজ করতে এসে এ গ্রামেই পরিচয় হয় শেফালীর বাবা টেপা মোহাম্মদের সঙ্গে। পরে এক সময় শেফালীর সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধে সলিম। বিয়ের পর শ্বশুরবাড়িতেই থেকে যায়। রংপুর থেকে এসেছিল বলে বামুনিয়া গ্রামের সবাই তাকে ‘সলিম রংপুরিয়া’ নামেই ডাকা শুরু করে। উচ্চতায় খাটো হলেও কাজেকর্মে সে তার উচ্চতার চেয়েও ছাড়িয়ে গিয়েছিল।

বিড়িটা শেষ করে ডানপাশে তাকিয়েই চমকে ওঠে শেফালী। সলিম কখন যে এসে তার পাশে বসেছে টেরই পায়নি ও। সলিম অস্ফুট স্বরে বলে ওঠে-

-বিড়ি খায় তো ঠোঁট কালো করে ফেলালো শেফালী। এত মানা করছু, তাঁহু যদি একনা শুনিস।

শেফালী নিরুত্তর। মৃদু হেসে স্বামীকে বিড়ি আর দেশলাই এগিয়ে দেয়। বড় বাড়ির আমগাছটার ফাঁক গলে কিছুটা ল্যাম্পের আলো এসে পড়ে সলিমের কপালে। চকচক করে ওঠে পুরো কপালটা। ছেলে ভুট্টোর জন্মের সময় স্বামীর চোখে-মুখে এরকম উজ্জ্বলতা দেখেছিল শেফালী। কিন্তু কিছুদিন পরে তা নিভেও গিয়েছিল। মাত্র পনের দিন পরেই ভুট্রো মারা গিয়েছিল অজানা এক রোগে। সেটা ভাবতেই চোখ ঝাপসা হয়ে আসে শেফালীর।

শেরমোহন পাড়া থেকে ঢোল-তবলার শব্দ ভেসে আসছে। সত্যপিরের গান বসেছে কুদ্দুস মাহালিয়ার বাড়ির আঙ্গিনায়। সলিমকে সেখানে যেতে অনেক কষ্টে রাজি করায় শেফালী। হেমন্তের হিম গভীর রাতে অলীক মানুষের মতো নিঃশব্দে দুজনে রওয়ানা দেয় সত্যপিরের গান শুনতে।

সলিমের আজ সকালেই ঘুম ভাঙে মাঘু মাতবরের ডাকে। স্পষ্ট করে শাসিয়ে যায় সলিমকে। ‘শালা রংপুরিয়া, সমোন্ধির বেটা-সাত দিনের মধ্যে টাকা না দিলে তোক ভিটামাটি করে ছাড়িম, ফম (খেয়াল) রাখিস কথালা’। একটু পরে বিশু, তারপর নফিল ও পুন্না পাড়ার আইজত মিয়া এসে যা ইচ্ছা তাই বলে যায় সলিমকে। হেলে পড়া গাছের মতো মাথা নিচু করে সব হজম করে সলিম। কাউকে কিছু বলে না।

নিজ গ্রামের, পাশের গ্রামের অনেকের কাছেই ধান, গম কাটার ওপর এভাবে অগ্রিম টাকা নিয়ে রেখেছিল সে। চড়া সুদের ওপর টাকাও ধার নিয়েছিল তিন-চারজনের কাছ থেকে। মেয়ে ফোসোর বিয়েতে খরচ করেছিল সব টাকা। জামাই মমিনুল আপন ভাগিনা হওয়া সত্ত্বেও যৌতুক বাবদ পঞ্চান্ন হাজার টাকা ও টু-ব্যান্ড রেডিও বুঝে নিতে একটুও দ্বিধা করেনি।

দুপুরে অঘ্রাণের কড়া রোদ ওঠে। সেই রোদ চোখে-মুখে নিয়ে হেঁটে লাহিড়ী হাট আসে সলিম আর শেফালী। একটি ছাগল, পাঁচটা মুরগি ও দুটো হাঁস বিক্রি করে। শেষ সম্বল গলায় থাকা তিন ভরি ওজনের রুপার হারটাও বিক্রি করে দেয় গগন বানিয়ার কাছে। বিকাল বেলা লাহিড়ী হাটে ঠাকুরের চালিতে মাঘু মাতবরের পাঁচশ পঞ্চাশ টাকা শোধ করে যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচে দুজনে। হাট থেকে ফেরার আগে মা আখিলন বুড়ির জন্য রহমান হোটেলের দুটো রসগোল্লা আর একটি পাউরুটি নিয়ে বাড়ি ফেরে শেফালী। আখিলন মাসখানেক হলো শয্যাশায়ী। বয়স আশি ছুঁইছুঁই। কোন্ দিন কী হবে কে জানে।

আজ শেষ বিকালের পর থেকেই মন কিছুটা ভালো সলিম রংপুরিয়ার। আজ নিজ হাতে ও আর শেফালী আলুর ডাল আর ডিম রান্না করেছে। সঙ্গে বেগুন ভাজা। দাওয়াত দিয়ে এনেছে ইয়াজত, রাজ্জাক, ইয়াকুব, খাতুন সবাইকে। বারান্দায় গোল হয়ে বসে খাচ্ছে সবাই। সলিম রংপুরিয়া খেতে খেতে ইয়াজতের উদ্দেশে বলে-

‘ভাই, মানুষের হায়াত-মউতের ঠিক নাই। মোর খুব ইচ্ছা ছিল তুমরালাক নিয়া একদিন ভালো-মন্দ খাম। আইজকার পর আর যদি আর কুনহদিন দেখা না হয়। যদি মরে যাও’

‘এই রংপুরিয়া থাম, থাম, এইলা কি রকম কাথা কহেছিরে। এইলা ওরকুন দোরকুন (অমঙ্গলজনক) কথালা বন্ধ কর’ এক প্রকার শাসনের সুরেই কথাগুলো সলিমের উদ্দেশ্যে বলে খাতুন। খাওয়া শেষ করে সবাই যে যার মতো চলে যায়।

বড্ড ক্লান্ত শরীর নিয়ে শেফালীও ঘুমিয়ে পড়ে। কিন্তু হঠাৎ স্বামীর ফিসফিস ডাকে ঘুম ভেঙে যায়। সলিম আস্তে করে বলে-একদম দেরি করা যাবেনি, শেফালী। তাড়াতাড়ি রেডি হয়া নে। এইঠে থেকে হামাক পালাবা হবে। আর উপায় নাই। এত মানুষের টাকা মুই কেংকরিয়া শোধ করিম, কোহেক তুই? মুই সব রেডি করিয়া রাখিছু, তুই কি কি নিবু তাড়াতাড়ি নিয়া চল, ভ্যান রাস্তাত দাঁড়ায়া আছে। এইঠে থিকা সোজা আখানগর স্টেশনত যায়া ট্রেন ধরি রংপুর চলি যামো এলা’।

এতক্ষণ যেন ঘোরের মধ্যে ছিল শেফালী। সে জোরে সশব্দে বলে ওঠে-মুই মোর বুড়ি অসুস্থ মা’টাক রাখেহেনে একচুল যামনি। ‘হারামজাদী’ বলে শেফালীর গালে কষে এক চড় মারে সলিম। কাঁদতে চেয়েও পারেনি শেফালী। হাত দিয়ে মুখ বন্ধ করে রাখে সলিম। বাধ্য হয়ে চোখের সামনে যা পায় সব ঢুকিয়ে নেয় বস্তার মধ্যে। যাওয়ার আগে মা আখিলনকে শেষবারের মতো দেখতে রান্না ঘরে ঢোকে ও। বড্ড মলিন আর ফ্যাকাশে মুখ নিয়ে ঘুমিয়ে আছে আখিলন। আস্তে করে চুমু খায় মার কপালে। ভেতরটা ফেটে যায়। দুমড়ে-মুচড়ে ওঠে। দম নিতে কষ্ট হয়। ওই অবস্থায় জোরে, হাত ধরে টেনে শেফালীকে বের করে আনে সলিম।

ভ্যান চলতে শুরু করে। পেছনে পড়ে থাকে তার বুড়ি মা আখিলন, গ্রামের সব ঘুমন্ত মানুষ। পেছনে পড়ে থাকে আশৈশব জড়িয়ে থাকা চির আপন, চির চেনা ঘর-দোর, মাটি, গাছপালা, আকাশ-বাতাস সবকিছু। যাদের সঙ্গে আর কোনোদিন দেখা হবে না। কথা হবে না। দলুয়া পাড়া পার হওয়ার আগেই শেফালী শেষবারের মতো দেখে নেয় নিজের গ্রামটাকে। খুব ইচ্ছে করে মাকে আরেকবার দেখে আসতে। মায়ের রোগা, মলিন মুখটা ভেসে ওঠে বারবার। কিন্তু সে সুযোগ আর নেই। নিজের মেয়ে হলে কি শেফালী এভাবে তার মাকে ফেলে রেখে পালিয়ে যেতে পারত? ঘৃণা, ক্ষোভ আর চরম স্বার্থপরতার জন্য নিজের ওপর একদলা থুতু ফেলে শেফালী। এসব দেখেও না দেখার ভান করে সলিম রংপুরিয়া। নির্বিকার চিত্তে সামনের দিকে তাকায় সে।

প্রবাস বাংলা ভয়েস /ঢাকা/ ০৮ ডিসেম্বর ২০২৩ /এমএম