Menu

প্রবাস বাংলা ভয়েস ডেস্ক :: ঈমাম হোসাইন

সে কালে পূর্ববাংলায় ধর্মীয় উৎসব হিসেবে ঈদ-উল-ফিতর এবং ঈদ-উল-আজহা মুসলিম সংস্কৃতির সঙ্গে মিশে যায়। কোরবানি সবচেয়ে বেশি আলোচিত হয়েছে বাঙালি মুসলিম লেখকদের স্মৃতিকথায়। সুবাহ-ই-বাঙ্গালা বা বঙ্গ প্রদেশে মুসলিম শাসনের প্রতিষ্ঠার অনেক আগেই আরব বণিকদের ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে যাতায়াত ছিল। ইতিহাস থেকে আমরা জানতে পারি, অলি-আউলিয়া, পির-মুরশিদের মাধ্যমেই এ দেশে ইসলাম প্রচার হতে থাকে। যারা ইসলাম গ্রহণ করেন তারা অধিকাংশই ছিলেন হিন্দু ধর্মাবলম্বী, বিশেষ করে নিম্নবর্ণের হিন্দু। সমাজে তাদের প্রতিপত্তি কমই ছিল। যখন তারা ইসলাম ধর্মের পাঁচ ভিত্তিতে বিশ্বাস স্থাপন করে ইসলামি উৎসবাদি পালন করতে থাকে তখন যে উত্সবটি নিয়ে স্থানীয় হিন্দুদের সঙ্গে বিরোধ দেখা দেয় তা হলো কোরবানির ঈদ।

ত্রয়োদশ শতাব্দীতে মুসলমানদের উৎসবাদি সম্বন্ধে সামান্য যা লেখা হয়েছে তা কেবল কারবালার বিষাদময় ঘটনা নিয়ে। পঞ্চদশ শতাব্দীতে প্রকাশিত মধ্যযুগের কবি সৈয়দ সুলতানের ‘নবীবংশ’-এ কোরবানির রীতি প্রচলনকারী ইব্রাহিম (আ.) ও ইব্রাহিম পুত্র ইসমাইল (আ.)-এর বর্ণনা পাওয়া যায়। আল্লাহর আদেশ পালন এবং তাঁর নৈকট্য লাভের বিরল সুযোগ বা সৌভাগ্য অর্জনের আশায় মুসলমানরা কোরবানির ঈদ উৎসব পালন করে। বাংলা সাহিত্যের আদি যুগে বা প্রারম্ভিক অবস্থায় এই উৎসব সম্বন্ধে কিছুই পাওয়া যায় না। মধ্যযুগে মুকুন্দরাম চক্রবর্তী মুসলিম সমাজের একটি নিখুঁত বর্ণনা উপস্থাপন করলেও সেখানে কোরবানির কোনো উল্লেখ নেই।

ঈদ-উল-আজহা সেকালে ‘বকরি ঈদ’ নামেই পরিচিত ছিল। হিন্দু জমিদার অধ্যুষিত এই অঞ্চলে গরু কোরবানি সম্পর্কে বৈরী মনোভাব থাকার কারণে সেসময় ছাগল তথা বকরি কোরবানি দিতে হতো। উনিশ শতকের সাহিত্য ও সংবাদ-সাময়িকপত্রে তার প্রমাণ মেলে। ১৮৮২ সালে দয়ানন্দ সরস্বতী গো-রক্ষা আন্দোলনের সূচনা করেন। প্রচারপত্রের মাধ্যমে হিন্দু জনসাধারণকে হাটে-বাজারে মুসলমান কসাই-এর কাছে গরু বিক্রি করতে নিষেধ করা হয়। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে এসে কোরবানিসংক্রান্ত বিষয় নিয়ে বিরোধ তুঙ্গে অবস্থান করে এবং এর পক্ষে ও বিপক্ষে কবিতাও রচিত হয়। মীর মোশাররফ হোসেন লিখে বসেন ‘গোজীবন’। এতে মুসলমান সমাজ ক্ষোভে ফেটে পড়ে। ক্ষোভটা কতখানি তীব্র ছিল তা উপলব্ধি করা যায় পণ্ডিত রেয়াজ উদ্দীন আহমদ মাশহাদীর লেখা ‘অগ্নি কুক্কুট’ গ্রন্থ পাঠে। এ ঘটনা আদালত পর্যন্ত গড়ায়।

পূর্ব বাংলায় বিভিন্ন স্থানে কোরবানি নিয়ে সহিংস ঘটনা ঠেকাতে এবং নির্বিঘ্নে গরু কোরবানির অধিকার আদায়ে ঢাকার নওয়াবদের ভূমিকা ছিল অগ্রগণ্য। ‘ঢাকা প্রকাশ’ (১৮৭৯) পত্রিকার প্রকাশিত তথ্য হতে জানা যায়, ৩০ ডিসেম্বর, ১৮৭৯ থেকে ১ জানুয়ারি ১৮৮০ পর্যন্ত সর্বসাধারণের জন্য গো-মেষ প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করা হয়। ১৯০৩ সালের সরকারি ছুটির তালিকায় দেখা যায়, মুসলমানদের প্রধান ধর্মীয় উত্সব ঈদ-উল-ফিতর ও ঈদ-উল-আজহা উপলক্ষ্যে সরকারি ছুটি ছিল মাত্র একদিন। মূলত সাতচল্লিশ পরবর্তী সময় থেকে এই অঞ্চলে ব্যাপকভাবে কোরবানির ঈদ পালিত হতে শুরু করে। পাকিস্তান আমলেও এখনকার মতো এত অধিকসংখ্যক পরিবার কোরবানি দিতে পারত না। এ কালে উচ্চবিত্ত, উচ্চমধ্যবিত্তের সীমানা পেরিয়ে কোরবানি চলে যায় মধ্যবিত্তের ঘরেও।

যতটুকু জানা যায়, বিশ শতকের গোড়ার দিকে বাংলা কবিতায় ঈদ নিয়ে লেখালিখি শুরু হয়। সৈয়দ এমদাদ আলীর ‘ঈদ’ কবিতাটিই সম্ভবত বাংলাভাষায় রচিত প্রথম ঈদ বিষয়ক কবিতা। ১৯০৪ সালে তাঁরই সম্পাদনায় প্রকাশিত মাসিক নবনূর পত্রিকার ঈদ সংখ্যায় এ কবিতাটি ছাপা হয়। ‘কুহেলী তিমির সরায়ে দূরে/তরুণ অরুণ উঠিছে ধীরে/রাঙিয়ে প্রাত তরুণ শিরে।’ আর এ পত্রিকায় কবি কায়কোবাদ, বেগম রোকেয়া ও সম্পাদক স্বয়ং এ তিনজন ঈদসংক্রান্ত কবিতা ও প্রবন্ধ লেখেন ১৯০৩ সালে। কয়েক শ বছর ধরে বাঙালি মুসলমান ঈদ উদযাপন করলেও মাত্র এই শতাব্দীর শুরু থেকে ঈদসম্পৃক্ত সত্যিকার সাহিত্য রচনা শুরু হয়েছিল।

ব্রিটিশ শাসনের নাগপাশ থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য নজরুল জাতিকে আহ্বান জানালেন জান কোরবানের শপথ নিতে। নজরুল মনে করতেন ব্রিটিশ খেদানোটাই সবচেয়ে বড় কোরবানি। তিনি মনে করতেন, মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা, নাগরিক হিসেবে সম্মান নিয়ে, স্বাধীনতা নিয়ে মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকার অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সর্বোচ্চ উত্সর্গের প্রতীকী নামই কোরবানি। তাই ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে দুর্বার আন্দোলন সংগ্রামের মাধ্যমে ইনসাফপূর্ণ রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠাই ছিল নজরুলের চোখে কোরবানির প্রধান সার্থকতা— ‘পশু কোরবানি দিস তখন/আজাদ মুক্ত হবি যখন/জুলুম মুক্ত হবে রে দ্বীন/কোরবানির আজ এই যে খুন/শিখা হয়ে যেন জ্বালে আগুন/জালিমের যেন রাখে না চিন/আমিন রাব্বিল আলামিন।/আমিন রাব্বিল আলামিন।’

সাহিত্য ও সংবাদ-সাময়িকপত্র পর্যালোচনায় দেখা যায়, একালে যেমন ঢাকার মাঠে-ময়দানে, রাস্তায়-রাস্তায় গরুর হাট বসে, সেকালে তেমনটি ছিল না। সেকালে ঢাকার লোকসংখ্যা ছিল যেমন কম, কোরবানির পশুর সংখ্যাও ছিল তেমনি সীমিত। নির্দিষ্ট কিছু জায়গা যেমন রহমতগঞ্জ, গাবতলী, সোয়ারীঘাট ও জিঞ্জিরায় গরুর হাট বসত। বিশেষত ঢাকার নওয়াব আব্দুল গনির নামে রহমতগঞ্জের গনি মিয়ার হাটটি ছিল প্রসিদ্ধ। এই হাটের প্রচার কৌশলটিও ছিল বেশ চমকপ্রদ। হাটের ঢুলিরা ঢোল বাজিয়ে চিত্কার করে বলতেন, ‘ধার করো, কর্জ করো, গনি মিয়ার হাট কর।’ হাটে মুন্সিগঞ্জ জেলার মীরকাদিম বাজার থেকে আসত সাদা নাদুসনুদুস গরু।

কেউ কেউ ঈদের পশু কোরবানিকে কেন্দ্র করে অনেক আপত্তিকর লেখার অবতারণা করেছেন। একটি উদাহরণও দেওয়া যেতে পারে। তত্কালে তরিকুল আলম নামে এক ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন। তিনি ১৩২৭ বঙ্গাব্দে শ্রাবণের ‘সবুজপত্র’ পত্রিকায় ‘আজ ঈদ’ শিরোনামে একটি প্রবন্ধ লেখেন। সেই প্রবন্ধে তিনি বলেছিলেন, ‘আজ এই আনন্দ উত্সবে আনন্দের চেয়ে বিষাদের ভাগই মনের ওপর চাপ দিচ্ছে বেশি করে। যেদিকে তাকাচ্ছি, সেদিকে কেবল নিষ্ঠুরতার অভিনয়। অতীত ও বর্তমানের ইতিহাস চোখের সামনে অগণিত জীবের রক্তে ভিজে লাল হয়ে দেখা দিচ্ছে। এই লাল রঙ আকাশে-বাতাসে চারিদিকে ছড়িয়ে রয়েছে যেন সমস্ত প্রকৃতি তার রক্ত নেত্রের ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে পৃথিবী বিভীষিকা করে তুলেছে। প্রাণ একেবারে হাঁপিয়ে উঠছে।’ এ প্রবন্ধ পড়ে নজরুলের কলম গর্জে উঠল। নব্য তুর্কিরা তখন স্বাধীনতার জন্য অকাতরে জান কোরবান করছিল। সে ব্যাপারের সঙ্গে মিলিয়ে তিনি লিখলেন, ‘ওরে হত্যা নয়, আজ সত্যাগ্রহ শক্তির উদ্বোধন’। নজরুলের উল্লিখিত কাব্য লাইনটি তরিকুল আলমসহ এধরনের সব মানুষের উপযুক্ত জবাব।

জাহানারা ইমাম ‘অন্য জীবন’ গ্রন্থে কোরবানির স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে হারিয়ে গেছেন শৈশবে— ‘কোরবানির সময় আমাদের বাড়িতে চালের আটার রুটি বানানো হতো। সে একটা দেখবার মতো জিনিস। রসুনের খোসার মতো পাতলা রুটি, ধবধবে সাদা এবং সুগোল। …বকরিদের সকালে কোরবানি না হওয়া পর্যন্ত কেউ কিছু মুখে দিতেন না। পুরুষেরা গোসল সেরে নতুন কাপড় পরে নামাজ পড়তে যেতেন খালি পেটেই। ফিরে এসে একেবারে কোরবানি দিয়ে তারপর বাড়িতে ঢুকতেন। ততক্ষণে মেয়েদের রুটি, হালুয়া, সেমাই, ফিরনি সব রান্না শেষ।’ জাহানারা ইমাম বর্ণিত স্মৃতিকথায় ঈদের দিনের বাঙালি সংস্কৃতি, লোকজ ঐতিহ্য যা এ দেশের মাটি ও মানুষের সঙ্গে কয়েক শ বছর ধরে মিশে আছে।

প্রাচীন থেকে আধুনিক কাল পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যের সাহিত্যিকরা ঈদ বিষয়ক রচনায় স্ব স্ব প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। তবে আমরা যেন ভুলে না যাই কোরবানির প্রকৃত ত্যাগের মাহাত্ম্য। বনের পশুকে নয়, মনের পশুকে যেন জবাই করে মনুষ্যত্বের জয়গান গাইতে পারি। এ কালে হোক বাঙালি মুসলমানদের এমন ব্রত।

প্রবাস বাংলা ভয়েস /ঢাকা/ ০৪ জুলাই ২০২৪ /এমএম