Menu

প্রবাস বাংলা ভয়েস ডেস্ক :: দুই দিন পরই রোজার ঈদ। ঈদের খুশিতে মেতে উঠবে পুরো ছোট কমলপুর গ্রাম। গ্রামের উত্তর-পশ্চিম কোনে বিশাল ঈদের মাঠ। আশপাশের অন্তত পাঁচ-সাত গ্রামের মানুষ ঈদের নামাজ পড়তে এখানে আসে। মাঠের পাশেই বসে মেলা। বাচ্চারা অধীর আগ্রহে মেলা এবং ঈদের জন্য অপেক্ষা করে। নামাজ শেষে বড়রা মেয়ে-বউদের জন্য নিয়ে যায় পানসুপারি, লেবু, লাড্ডু, মিষ্টি ইত্যাদি।

মাঠের দক্ষিণ-পূর্ব কোনে রহিম মিয়ার বাড়ি। বাড়ি বলতে ছোট একটি জং ধরা পুরাতন টিনের ঘর। পাশে ছন আর বাঁশ দিয়ে তৈরি রান্নাঘর। রান্নাঘর থেকে মাঠের পাশ দিয়ে সোজা চলে যাওয়া পাকা রাস্তা দেখা যায়। রাস্তার ওপাশে কিছু দূরে বড় বাবুদের বাড়ি। রহিম মিয়ার স্ত্রী ফুলবানু কখনো বৃষ্টিতে ভিজে কখনো গ্রীষ্মের তপ্ত রোদে পুড়ে এ ঘরে রান্না করে। পরিবারে একমাত্র ছেলে কামরানকে নিয়ে তাদের তিনজনের অভাবের সংসার। বিয়ের দীর্ঘদিন পর কামরানের জন্ম হয়। তাদের দুইজনের বয়সের তুলনায় ছেলের বয়স নিতান্তই কম বলে গ্রামের অনেকে রহিমের নাতি বলেও ঠাট্টা করে। এই সমাজের মানুষ অন্যকে ঠাট্টা করে পৈশাচিক আনন্দ পায়। তাতে অবশ্য রহিম মিয়ার কিছু আসে যায় না। বংশের প্রদীপ কামরানকে সে প্রাণের চেয়ে বেশি ভালোবাসে। যদিও সে ছেলের সব চাহিদা পূরণ করতে পারে না। পারবে কী করে মানুষের বাড়িতে গতর খেটে যে পয়সা পায় তাতে ডাল আনতে পান্তা ফুরায় অবস্থা। তিনজনের খাবার জোগাতেই তাকে হিমশিম খেতে হয়। ফুলবানু অত্যন্ত লক্ষ্মী। সে নিজেও সম্ভ্রান্ত বাড়ির হাঁড়িপাতিল ধুয়ে দেয়। কাপড় কেচে দেয়। বিনিময়ে খাবারের উচ্চিষ্টাংশ পায়। সেখানে বসে না খেয়ে, ঘরে নিয়ে এসে তিনজনে মিলে খায়।

রহিম মিয়ার সারা বছর কাজ থাকে না। ফসলের মৌসুমে কাজ থাকলেও মৌসুম শেষ হলে হাত গুটিয়ে বসে থাকা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না। তখন ফুলবানুর আনা খাবারের ওপরই নির্ভর করতে হয়। উপোস থাকা থেকে বাঁচতে কখনো মাসিক সুদে ঋণ করে চাল-ডাল আনতে হয়। সেই ঋণের সুদ দিতে গত কার্তিক মাসে ফুলবানুর আদরের ছাগলটা বিক্রি করতে হয়েছিল। সেদিন ফুলবানু বলেছিল—‘আমি না খেয়ে থাকলেও আর ঋণ করব না।’ ‘নিজের কান ধরে কসম করলাম। এই জীবনে আর ঋণ করব না। যদি করি তাহলে আমি মরা বাপের লাশ খাই’—বলে প্রতিজ্ঞা করে রহিম।

কিন্তু অভাবের করাল গ্রাস তার কথায় স্থির থাকতে দেয়নি। একমাত্র সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে রহিমকে মাসিক সুদে ঋণ করার জন্য সায় দেয় ফুলবানু। বৈশাখ মাসে কড়া রোদে শ্রমিকের চাহিদা বেশি থাকায় তখন কামলার দাম বেশি থাকে। সেই সুযোগে রহিম আগুন ঝরা রোদে পুড়ে বর্গাজমিতে কাজ করে। মজুরির টাকা দিয়ে সব ঋণ সুদসহ পরিশোধ করে। তখন সে ব্যাগ ভরতি করে বাজার করে। অন্যান্য সময় তেলাপিয়া, সরপুঁটি, সিলভার কাপের মতো কম দামি মাছ কিনলেও এ সময় সে রুইমাছ কেনে। তার বাবা বলত—ছোটবেলায় রুইমাছের মাথা খেলে ব্রেইন ভালো হয়। গোশত কেনার কথা সে ভাবতেই পারে না। বছরে একবার গরুর গোশতের স্বাদ নিতে পারে।

কোরবানি ঈদে বাবুদের বাড়ি থেকে গরুর গোশত দেয়। রোজার ঈদে কখনো গরুর গোশত কিনতে পারে না। এক কেজি গরুর গোশত কিনতে নাকি এক মণ ধানের দাম দিতে হয়। বাজার থেকে যেতে যেতে ভাবে কামরানকে পড়াশোনা করাতে পারলে সে অনেক বড় অফিসার হবে। তাদের আর দুঃখ থাকবে না। ভাবতে ভাবতে সে বাড়িতে চলে আসে। ঘুমন্ত ছেলেকে ডেকে তোলে—‘কামরান, ওঠ বাপ দ্যাখ কী নিয়ে আইছি।’

কামরানের চোখ ছলছল করে। সারা বছরে দু-একবার সে এই দৃশ্য দেখতে পারে। মায়ের কাছে বায়না ধরে—‘মা, আমি কিন্তু মাছের মাথাটা খাব।’ ছেলের হাসিমুখ দেখে ফুলবানুর মুখে হাসির রেখা ফোটে। বলে—‘তর লাইগগাই তো তোর বাপ বড় মাছ নিয়ে আসে। আমার লাইগগা তো কিছু আনে না।’

ফুলবানু যদিও জানে রহিম তাকে কত ভালোবাসে। ফুলবানুর পছন্দের খাবার আর কাপড় জোগাড় করতে সে সর্বোচ্চ চেষ্টা করে। কিন্তু একজন দিনমজুরের আর কী বা করার থাকে। বড়বাবুর বউয়ের পুরাতন কাপড়ে তার বছর চালাতে হয়। তাতে ফুলবানুর মনে কষ্ট নেই। এতিম ফুলবানুকে বিয়ের সময় রহিম লাল টুকটুকে শাড়ি দিয়েছিল। হাতের চুড়ি, গলার চেন, আলতা কোনো কিছুর কমতি ছিল না সেদিন। বিয়ের পর তেমন শাড়ি, গয়না পায় না। বিয়ের লাল শাড়িটা সে রেখে দিয়েছিল পরম যত্নে। নতুন শাড়ির জন্য আক্ষেপ হলে বিয়ের শাড়িটা বের করে দেখে। নিজেকে সান্ত্বনা দেয়। রহিমও প্রতি ঈদে ফুলবানুকে ভালো একটা শাড়ি কিনে দেওয়ার পরিকল্পনা করে। কিন্তু তা সে করতে পারছে বলে মনে পড়ে না। রহিম তার ছেলে কামরানকে বলে—‘তোর মাকে আমি কখনো ভালো শাড়ি কিন্্না দিতে পারি নাই। তুই যখন বড় হয়ে অফিসার হবি। তোর মায়ের পছন্দের লাল একটা শাড়ি কিননা দিবি।’

‘একটা না, আমি মাকে পাঁচটা লাল শাড়ি কিন্্না দিবো’—ডান হাতের পাঁচ আঙুল দেখিয়ে বলে কামরান। খুশিতে কামরানকে বুকে জড়িয়ে ধরে রহিম।

কামরান পাশের স্কুলে চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে। পড়াশোনায় সে যথেষ্ট ভালো। প্রতিদিন নিয়ম করে স্কুলে যায়। কখনো স্কুল কামাই দেয় না। তৃতীয় শ্রেণি থেকে চতুর্থ শ্রেণিতে ওঠা ষাট জন ছাত্রছাত্রীর মধ্যে কামরানের অবস্থান প্রথম দিক থেকে তৃতীয়। তার আগে গ্রাম-ডাক্তার ক্ষীতিশ চন্দ্র সূত্রধরের ছেলে অখিল চন্দ্র সূত্রধর। তারও আগে অর্থাত্ ক্লাসে প্রথম হলো মেজো বাবুর ছোট ছেলে রফিক। কামরান যেদিন রহিমকে এই খবরটা দেয়, সে খুশিতে আত্মহারা হয়েছিল। তার বিশ্বাস বাবুর ছোট ছেলেকে কামরান একদিন পিছনে ফেলবেই।

ছেলেকে উত্সাহ দিয়ে বলে, ‘ফাস্ট হতে হবে বাপ; ফাস্ট হতে হবে।’

তার বিশ্বাস ছেলে আসলেই বড় অফিসার হবে। বাবুদের ছেলেমেয়ের তুলনায় কামরানকে সে কিছুই দিতে পারে না। না ভালো খাবার, না ভালো কাপড়। কিন্তু একটা জিনিসের সে কখনো অভাব রাখে না। তা হলো কামরানের পড়াশোনার জন্য কাগজ, কলম। এই তো দু দিন আগে। বৈশাখ মাসের তীব্র রোদে রহিম বড়বাবুর জমিতে বোরো ধান কাটছিল। খেতের আইলে দাঁড়িয়ে বড় বাবু বললেন—‘রহিম, তোর ছেলেও বড় হয়ে যাচ্ছে। এইবার কাজে লেগে গেলেই তোর কষ্ট অনেকটা শেষ। আগে থেকে কাজের অভ্যাস করাতে হবে। ছোটকাল থেকে কাজ না করলে তো তোর মতো ঝানু কামলা হবে না। এইসব স্কুলেটুলে গিয়ে কোনো কাজ নাই। দেশে চাকরির বড় অভাব। আগে থেকে কাজকর্ম শিখলে কোনোমতে খেয়েপরে বাঁচতে পারবে।’

তীব্র রোদে রহিমের গা বেয়ে ঘাম ঝরছে। ঘামের পানি মাঝেমধ্যে চোখে চলে যাওয়ায় চোখ দুটি রক্তবর্ণ ধারণ করে। গামছা দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বলে—‘বাবু, ছেলেটা তো এখনো অনেক ছোট। সে কী কাজ করবে?’

রহিম এ ব্যাপারে কথা বাড়াতে চায় না। কামরানের পড়াশোনার বিষয়ে রহিম কোনো আপস করতে রাজি না। সে মনোযোগ দিয়ে কাজ করছে। এ সময়ে তার কাজে ফাঁকি দেওয়া চলবে না। তার ওপর দু দিন পরই ঈদ। এইবার ঈদে ফুলবানু ও কামরানকে নতুন জামা কিনে দিতেই হবে। গত কয়েক বছর ছেলেটাকে ঈদে শুধু গেঞ্জি কিনে দিতে পেরেছে সে। গতরাতে ঘুমানোর আগে কামরান বলেছিল—‘বাবা, এই ঈদে নতুন জামা আর গরুর গোশত আনতেই হবে। তা না হলে আমি কিন্তু ঈদে যাব না।’

‘এইবার তোর জন্য শহর থেকে নতুন জামা আনব। বড় বাজার থেকে আনব গরুর গোশত’—ছেলেকে বলে রহিম।

আগামীকাল ঈদ। আজকে সন্ধ্যায় ধান কাটার পয়সা পাবে রহিম। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। আকাশে ঈদের চাঁদ দেখা গেছে। পুরো পাড়া ঈদের চাঁদ দেখার আনন্দে আত্মহারা। রহিম খুশিমনে বড়বাবুর বাড়িতে যাচ্ছে। গিয়ে শোনে বড়বাবু ঢাকায় গেছে। ঈদকে সামনে রেখে সে অমানুষিক পরিশ্রম করেছে। ক্লান্ত পরিশ্রান্ত রহিমের চোখ অন্ধকার দেখছে। পরদিন ঘরের পাশেই হবে ঈদ উত্সব। অথচ রান্না হবে না তার ঘরে। কামরান হয়তো মুখটা ভারী করে ঘরেই বসে থাকবে।

রহিমের পা সামনে এগোচ্ছে না। মাথা ঘুরে সে পাশের জঙ্গলে পড়ে যায়। বাজার থেকে ফেরার পথে পাশের বাড়ির কদ্দুস আলী তাকে ধরে ধরে বাড়িতে দিয়ে যায়। সে রাতে ফুলবানুর হাজারো প্রশ্নের উত্তর সে দিতে পারেনি।

ঈদগাঁয়ে নামাজ শেষে বড় বাবুর সঙ্গে দেখা। কামরানকে একটা বাটি দিয়ে তাঁদের বাড়িতে পাঠিয়ে দিতে বলে। কামরানের জন্য গরুর মাংস দেবে। নামাজ শেষে কামরান বাটি নিয়ে বের হয় বাবুদের বাড়িতে যাওয়ার জন্য। তখন সকাল গড়িয়ে দুপুর। ঈদের মাঠ পেরিয়ে রাস্তা, তার কিছু দূরেই বাবুদের বাড়ি। ফুলবানু তখন রান্নাঘরে ভাত রান্না করছিল। ছেলেকে পাঠিয়ে দিয়ে সে ভাতের ফেন আলাদা করছে। অল্পক্ষণের মধ্যেই কামরানের ‘মা’ বলে চিত্কার শুনে ছনের বেড়ার ফাঁক দিয়ে তাকায়। দেখা যায় উচ্চ শব্দের সাউন্ডবক্স বাজাতে বাজাতে একটি ট্রাক দ্রুত চলে যাচ্ছে। ট্রাকে কতগুলো ছেলে গানের তালে তালে নাচছে। দেখে উন্মাদ মাতাল মনে হয়। ফুলবানু দৌড়ে গিয়ে দেখল তার নাড়িছেঁড়া ধন কামরান রাস্তায় পড়ে আছে। কামরানের তরতাজা মগজের অংশ মাথা থেকে ছিটকে মাংসের বাটিতে পড়ছে। বাটি থেকে যেন ‘মা বাঁচাও’ রবে শব্দ ভেসে আসছে।

‘বাপ আমার কোথাও যেতে হবে না তোর।’ বলে এক চিত্কারে মগজহীন নিথর কামরানকে কোলে তুলে নেয় ফুলবানু। ততক্ষণে কামরান দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করেছে।

[আশুতিয়া, কিশোরগঞ্জ]

প্রবাস বাংলা ভয়েস /ঢাকা/ ২৪ এপ্রিল ২০২৪ /এমএম