Menu

প্রবাস বাংলা ভয়েস ডেস্ক :: ১৯৬৯ সালের ১ জুন সুদূর পিন্ডিতে তাঁর রহস্যজনক মৃত্যু হয়। প্রয়াণ দিবসে মানিক মিয়ার জীবনকর্মের চুম্বকতথ্যের শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদিত হলো। লিখেছেন— মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়  তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া এক ঋজু মন আর অন্তঃস্থ হূদয়বত্তায় উদারচেতা মহান ব্যক্তিত্ব। পেশায় তিনি ছিলেন সাংবাদিক। বিচক্ষণতা এবং মানবপ্রেম ছিল তাঁর চালিকাশক্তি। উপমহাদেশে এমন এক বৈরী লগ্নে তাঁর জীবন ও কর্ম অতিবাহিত হয়েছে যে তা আলোচনা করতে গিয়ে বিধুর না হয়ে উপায় থাকে না।

তাঁর জন্ম বাংলাদেশের দক্ষিণের এক জেলা তৎকালীন বরিশালের ভান্ডারিয়ায়। বর্তমানে এটি পিরোজপুর জেলান্তর্গত। তাঁর পিতার নাম মুসলেমউদ্দীন মিয়া। অল্প বয়সেই মাতৃহারা তিনি। তাঁর জন্মের বছরেই জন্মেছিলেন বিপ্লবী বিনোদবিহারী চৌধুরী, অভিনেতা অশোককুমার, ক্রিকেটার বিজয় মার্চেন্ট। এবং প্রয়াত হয়েছিলেন জোসেফ পুলিত্জার—হাঙ্গেরিয়ান বংশোদ্ভূত মার্কিন সাংবাদিক, যিনি মিডিয়াজগতে কিংবদন্তি হয়ে আছেন লেখক ও সাংবাদিকরূপে, যাঁর অর্থে প্রতিবছর সাহিত্য সংগীত নাটক ইতিহাস ইত্যাদি একুশটি ক্ষেত্রে বার্ষিক পুরস্কার দেওয়া হয়।

উল্লেখ্য, শিল্পসাহিত্যের নানা অঙ্গনে যেসব বাঙালির পদচারণা, তাঁদের একটি বড় অংশই পূর্ববঙ্গ তথা অধুনা বাংলাদেশের মানুষ। সাংবাদিকদের মধ্যেও দেখা যায় বিখ্যাত বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায় মাদারীপুরের ভূমিপুত্র। বঙ্কিমচন্দ্র সেন ময়মনসিংহের। টাঙ্গাইলের মানুষ সত্যেন্দ্রনাথ মজুমদার। সাগরময় ঘোষ কুমিল্লা ও অমিতাভ চৌধুরী সিলেটের। কাঙাল হরিনাথ ছিলেন কুষ্টিয়ার কুমারখালীর।

মানিক মিয়া মেধাবী ছাত্র ছিলেন। ভান্ডারিয়া সরকারি বিদ্যালয় থেকে তিনি সসম্মানে ম্যাট্রিক পাশ করে বরিশালের ব্রজমোহন কলেজে ভর্তি হন। মনে রাখা জরুরি, তাঁর জন্ম ও বেড়ে ওঠা এমন এক সময়সরণি বেয়ে; যখন বাংলা তথা ভারতের ইতিহাস এক জ্বলন্ত ভিসুভিয়াস। বঙ্গভঙ্গের আগ্নেয় উত্তেজনা যখন সারা বাংলাদেশে পরিব্যাপ্ত, সে-সময়ের জাতক তিনি। শৈশবে আঁচ নিয়েছেন অসহযোগ আন্দোলনের। কৈশোরের দিনগুলোতে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের করালদংষ্ট্রা আর জালিয়ানওয়ালাবাগ! তিরিশের বিশ্বব্যাপী মন্দা। যে বরিশালে তাঁর জন্ম তা ছিল মহাত্মা অশ্বিনীকুমারের শিক্ষাদর্শে গড়া এমন এক স্থান যে স্থানটি নিয়ে মহাত্মা গান্ধী পর্যন্ত শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। কলেজজীবন শেষে মানিক মিয়া একাধিক জায়গায় চাকরি করলেও আদর্শগত কারণে কোথাও স্থায়ী হতে পারেননি। এর মধ্যেই এলো রাজনীতির আহ্বান। সে সময়ের জনপ্রিয় নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর হাত ধরে রাজনীতিতে আসেন তিনি, ঠিক যেভাবে এসেছিলেন বঙ্গবন্ধু। তবে মানিক মিয়া কখনো রাজনীতির মাধ্যমে নির্বাচনে যেতে চাননি। এক্ষেত্রে তিনি মওলানা ভাসানীর আদর্শে চলেছেন। অথচ মানিক মিয়ার রাজনৈতিক প্রজ্ঞা বঙ্গবন্ধুকে তাঁর প্রতি আস্থাশীল করেছে। দান করেছে তাঁর প্রতি নির্ভরতা। তার ঐতিহাসিক প্রমাণ ১৯৬৬। সেবার অন্য নানা ব্যস্ততার জন্য বঙ্গবন্ধু করাচিতে আইয়ুবের ডাকা গোলটেবিল বৈঠকে নিজে না গিয়ে শাহ আজিজুর রহমানকে পাঠাতে চেয়েছিলেন। বাদ সাধলেন মানিক। তাঁর যুক্তি—আজিজুর এই সেদিনও মুসলিম লীগের সমর্থক ছিলেন। অতএব তার আওয়ামী লীগের প্রতি আনুগত্য প্রশ্নাতীত নয়। তাই বঙ্গবন্ধুরই সেখানে যোগদান কর্তব্য এবং আবশ্যিক। বঙ্গবন্ধু মানিক মিয়ার এই রাজনৈতিক বিচক্ষণতা অনুভব করেছিলেন বলেই সিদ্ধান্ত পালটে নিজে যান। তাঁর ঐতিহাসিক ফলাফল পরবর্তীকালে মুজিবের ঐতিহাসিক ‘ছয় দফা’— বাংলাদেশের ইতিহাসকেই যা মুঠি ধরে নাড়িয়ে দিয়েছিল। আমাদের এ প্রসঙ্গে জুলিয়াস সিজারের রুবিকন নদী পার হওয়ার দ্বিধার কথা মনে পড়ে। ইংরেজিতে Crossing the Rubicon কথাটির অর্থ Passing a point of no return। ৪৯ খ্রিষ্টাব্দ। সিজার তাঁর সৈন্যবাহিনী নিয়ে রুবিকনের ওপারে। নদী পেরোলেই রোমে জ্বলে উঠবে তাঁর বিরুদ্ধে দ্রোহ। আর না পেরোলে ইতিহাস থেকে তাঁর চিরতরে অন্তর্ধান! সিজার নদী অতিক্রমের সিদ্ধান্ত নেন। রোমের ইতিহাস পালটে গেল এর ফলে। ১৯৬৬-তে মুজিব করাচি গিয়ে সেই ইতিহাসেরই পুনরনুসরণ করলেন। নেপথ্যনায়ক মানিক মিয়া। ইতিহাস যেন এইভাবে তাঁর মূল্যায়ন করে।

বঙ্গবন্ধু তাঁকে অভিহিত করেন ‘বাংলার সবচাইতে জনপ্রিয় সাংবাদিক’ বলে। নিতান্ত অকারণে নয়। সাংবাদিকরূপে প্রথম তাঁকে পাই কলকাতায়। ‘ইত্তেহাদ’-এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তখন। সাতচল্লিশের স্বাধীনতা ও দেশভাগের ফলে কলকাতা ছাড়তে হলো তাঁকে। ১৯৫১-তে সাপ্তাহিক ‘ইত্তেফাক’ মুমূর্ষু। মওলানা ভাসানীর আদেশে ইত্তেফাকের ভার নিলেন মানিক মিয়া। এবং দু বছরের মধ্যে তাকে দৈনিকে দাঁড় করালেন? কী ছিল মোজেজা? না। পুলিৎজারের মতো হলুদ সাংবাদিকতার মাধ্যমে নয়। জনগণের দাবিকে যথাযথভাবে তুলে ধরে। দেশ যে পশ্চিমাদের দ্বারা নির্মম ও নিষ্ঠুর ভাবে শোষিত হচ্ছে দেশবাসীর কাছে তা তুলে ধরে। ১৯৫৪ সালে ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে নতুন রাজনৈতিক শক্তি যুক্তফ্রন্ট গঠন ও ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে ইত্তেফাক বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করে। স্বাধিকার, স্বায়ত্তশাসন থেকে স্বাধীনতার দীর্ঘ অভিঘাত ও সংগ্রামে বলিষ্ঠ নেতৃত্ব দিয়েছে মানিক মিয়ার দৈনিক ইত্তেফাক। ১৯৫৪-এর নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের বিশাল বিজয় এবং মুসলিম লীগের শোচনীয় পরাজয়ে সমগ্র পূর্ববাংলায় অসাম্প্রদায়িক শক্তির যে উত্থান সূচিত হয় তাতে ইত্তেফাক বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করে। এজন্য সরকারের রোষানলে পড়তে হয়েছে মানিক মিয়াকে। তিনবার জেলে যেতে হয়েছে তাঁকে।

১৯৬৪ সালের দাঙ্গা প্রতিরোধে দৈনিক ইত্তেফাক এবং এর সম্পাদক তফাজ্জল হোসেনের অগ্রণী ভূমিকা পালন করায় পত্রিকাটি পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর মোনায়েম খান এবং সরকারের পোষ্য দুষ্কৃতকারীদের প্রধান লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়। ১৭ জানুয়ারি দৈনিক ইত্তেফাকে ‘পূর্ব পাকিস্তান রুখিয়া দাঁড়াও’ শীর্ষক একটি আবেদনপত্র প্রকাশিত হয়। ঐদিনই ‘পশুশক্তি রুখিয়া দাঁড়াইবার জন্য সাধারণ নাগরিকদের দৃঢ়মনোভাব’ শিরোনামে সংবাদ প্রতিবেদন এবং ‘প্রতিরোধ বাহিনী গড়ে তুলুন’ শীর্ষক সম্পাদকীয় প্রকাশ করা হয়। উক্ত সংবাদ ভাষ্য এবং সম্পাদকীয় প্রকাশের দায়ে ২৮ মার্চ প্রাদেশিক সরকার তত্কালীন প্রেস-অ্যান্ড পাবলিকেশন অর্ডিন্যান্স বলে সম্পাদক তফাজ্জল হোসেনের নিকট ২৫ হাজার টাকা জামানত তলব করে। এরূপ সরকারি দমনপীড়ন এবং রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে মানিক মিয়া সেই সময়ের ভয়াবহ দাঙ্গা প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এরপর ১৯৬৬ সালে তো তাঁর পত্রিকা বন্ধ করেই দেওয়া হয়েছিল। বন্ধ করা হয় তাঁর প্রেস ‘নিউ নেশন’। বাজেয়াপ্ত হয় অন্য দুটি কাগজ—ঢাকা টাইমস আর পূর্বাণী। দ্বিতীয়টি ছিল সিনে ম্যাগাজিন। অবশ্য উনসত্তুরের গণঅভ্যুত্থানের সময় নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহূত হয়। অথচ কী পরিহাস! ১৯৬৩ সাল থেকে তিনি ছিলেন International Press Institute Pakistan-এর নির্বাচিত সভাপতি! তার আগে ১৯৫৬-৫৮ পর্বে ছিলেন সরকারি প্রেস কোর্ট অফ অনার্স-এর সেক্রেটারি। তত্সহ পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ার লাইনস-এর পরিচালক। এহেন সব সরকারি পদমর্যাদার অধিকারীকে কারাবন্দী করেই আইয়ুব তার ‘মৌলিক গণতন্ত্র’ জিইয়ে রাখতে চেয়েছিলেন।

অন্যদিকে মানিক মিয়া? ‘শিকল পরা ছল’-এর মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথের ‘মুক্তধারা’ নাটকের অভিজিৎ যেন তিনি। তাই তিনি বঙ্গবন্ধুর কাছে নিয়ে যান নিষিদ্ধ ঘোষিত কমিউনিস্ট পার্টির দুই নেতা খোকা রায় আর মণি সিংহকে, তাঁদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু সমঝোতায় আসতে পারেন যাতে। তার চেয়ে আরো তাৎপর্যপূর্ণ হলো তখনকার ঢাকাস্থ ভারতীয় উপদূতাবাসের রাজনৈতিক কর্মকর্তা শশাঙ্কশেখর ব্যানার্জীর সঙ্গে তাঁর বঙ্গবন্ধুর দেখা করিয়ে দেওয়া। ১৯৬২ সালে বড়দিনের মাঝরাতে। মানিক মিয়ার গৃহে। মুজিব শশাঙ্কের হাতে নেহরুকে দেবার জন্য একটি চিঠি দেন। শশাঙ্ক ঘটনাটিকে বলেছেন—A memorable turning point in the history of South Asia বলে। শিকল-পরা ছলের জন্যেই মানিক মিয়া আইয়ুব-পরিকল্পিত ব্রিগেডিয়ারীয় ফাঁদে পা দেননি।

পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বাঙালির দীর্ঘ একটানা সংগ্রামের অধ্যায়ে মানিক মিয়ার ‘ইত্তেফাক’ নির্যাতিত মানুষের কাছে আশা-ভরসার প্রতীকে পরিণত হয়েছিল, ‘ইত্তেফাক’ নামটি পেয়েছিল স্লোগানের ব্যঞ্জনা। বাংলাদেশের রাজনীতি নানা উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে লক্ষ্যের দিকে পথ করে নিয়েছে। তিনি ছিলেন বাংলাদেশের আধুনিক সংবাদপত্রের রূপকার, বাঙালি জাতীয়তাবাদ আন্দোলনের অন্যতম প্রবক্তা। ‘রাজনৈতিক ধোঁকাবাজি’, ‘রাজনৈতিক মঞ্চ’ আর ‘রঙ্গমঞ্চ’ শিরোনামে কলাম লিখে তত্কালীন পূর্ব বাংলার মানুষকে স্বাধীনতাকামী করে তোলেন মানিক মিয়া। ‘মোসাফির’ শিরোনামে তাঁর রাজনৈতিক মঞ্চ কলামে নির্ভয়ে সত্য উচ্চারণ, অনন্য রাজনৈতিক দিকনির্দেশনা এবং গণমানুষের প্রতি ভালোবাসার কারণেই বাংলার মানুষের হূদয়ে তিনি অবিনশ্বর হয়ে রয়েছেন। ১৯৬৯ সালে প্রয়াত হন তিনি। তাই স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ তিনি দেখে যেতে পারেননি। দুই পুত্রকে দিয়ে গিয়েছেন দেশপ্রেমের উত্তরাধিকার। ইত্তেফাকের মাধ্যমে তা আজো প্রবহমান।

প্রবাস বাংলা ভয়েস /ঢাকা/ ০৪ জুন ২০২৪ /এমএম