Menu

— শামসুল আলম জুয়েল

অনু কবিতা হলো ছোট্ট পরিসরে কবির চিন্তনীয় মনের অতি গভীরের আলাপন যেখানে উঠে আসতে পারে সমাজের কথা, দেশের কথা, আপামর জনগণের কথা, সর্বোপরী মহাবিশ্বের একমাত্র স্রষ্টার কথা। এ বিষয়ে আমরা দেখতে পারি খ্রিস্টিয়পূর্ব পাঁচ হিজরীর দিকে রচনা করেন দার্শনিক ওমর খৈয়াম

রুবাইয়াত। রুবাইয়াত লিখে ওমর খৈয়াম ভীষণ খ্যাতি অর্জন করেন। তিনি ছিলেন একজন দার্শনিক ও গণিতবিদ সহ বহু জ্ঞানের অধিকারী। তাকে নিয়ে প্রচুর আলোচনা হয়েছে এবং অদ্যাবদি সে আলোচনা চলমান।
আল্লাহকে জানতে হলে সকলের আগে নিজেকে জানতে হয়। এই বিষয়ে তিনি ইসলামী বর্ণনা তুলে ধরতে গিয়ে  লিখেছিলেন—
‘বিশ্ব-দেখা জামশেদিয়া পেয়ালা খুঁজি জীবন-ভর
ফিরনু বৃথাই সাগর গিরি কান্তার বন আকাশ-ক্রোড়।
জানলাম শেষ জিজ্ঞাসিয়া দরবেশ এক মুর্শিদে
জামশেদের এই জাম-বাটি এই আমার দেহ আত্মা মোর।’
এই লেখাটি মাত্র চারটি লাইনে সীমাবদ্ধ হলেও এখানে পাঠকের মনের খায়েশ যেনো সহজেই মেটে না। পাঠক লেখাটির গভীরতা দেখে ‍শুধু অবাকই হয় না বরং বারবার পড়ে সেখান থেকে ‘এবং আরও কিছু’ আবিষ্কার করতে চান। লেখকের মনোভাব কতই না গভীরে ছিলো। একারণে অনুকবিতাগুলো  ছোট্ট পরিসরে রচিত হলেও এর ভাবময় ও তাৎপর্য্যগুলো আরও  বিস্তরভাবে আমরা যেনো আরও বেশি করে সহজ করে নিয়েছি।
মনোভিব্যক্তির ক্ষুদ্রতম প্রকাশ যেনো অনুকাব্যগুলো হয়ে উঠেছে আজ বেগবান।

কাব্যালাপন ও কবিদ্বয়ের সংলাপ :
আলোচিত ‘কাব্যালাপন’ গ্রন্থটিও যেনো তারই ধারাবাহিকতায় প্রচণ্ড বেগমান। কাব্যগ্রন্থটি পাঠ করলে আমরা দেখতে পারি একই বৃন্তের দুটি ফুল–ধরার বুকে তাদের কাব্যপ্রীতির এক মোহনীয় সংমিশ্রণে ভাবাবেগে, রিক্তে, সহানুভূতিতে, মননের হাজারও আবেদনের চিরভাস্বর এক অভূতপূর্ব প্রেমময় আবেগে উথলা হৃদয়ে চির  ভাসমান কপোত-কপোতি। যেখানে বয়সটা কোনো বিষয় নয়—আবেগই হলো আসল বিষয়।
ভালোবাসা মানেটা কী সহজে বোঝা যায়—দূর থেকে প্রথম দৃষ্টি বিনিময়। তারপর চারচোখ এক করা। চোখেচোখে চাওয়া-চাওয়ি। হৃদয়ে হৃদয়ে এক অদৃশ্য টান। মৃদু বুকে কাঁপুনি তারপর দৃষ্টিতে নিবন্ধ দুটি মন। অতি কাছে আসা। অপরের দুঃখবোধ-সুখবোধ নিজ হৃদয়ে নেওয়া, আপদে-বিপদে সহযোগিতা করা, হৃদয়ে-হৃদয়ে সুখ অনুভব করা—এগুলোই হলো  প্রেম বা ভালোবাসা। প্রকৃতপক্ষে ভালোবাসার সংজ্ঞা দেওয়া বড়ই কঠিন।
ভালোবাসার অনেক রূপ আছে। সমবয়সী কিংবা অসম বয়সী অথবা হতে পারে ছেলেতে-বুড়োতে। তাতে কি—প্রেম তো প্রেমই! এটা হলো অদৃশ্য এক সুতোর টান। যে টানে মানুষ ছুটে চলে দেশ হতে দেশ-দেশান্তরে। এর একটি নির্দিষ্ট বয়সও লাগে। সব বয়সে সবকিছু সম্ভব না হলেও আবেগটা প্রকাশ করতে সমস্যা কোথায়? আবেগ হলো মানুষের প্রকাশিত মনের এক সহজাত প্রবৃত্তি। আবেগ আছে বলেই—মানুষ মনের কথা বলে। আবেগ আছে বলেই মানুষ সুখ-দুঃখ প্রকাশ করে—কান্না করে, হাসতে পারে। এগুলোই মানুষকে আশা জাগায়। কবিরা মানুষ বলেই এদের আবেগ একটু বেশি। তাই কবিরা আবেগ প্রকাশ করে থাকেন—আবেগ দিয়ে কবিতা লেখে।
আলোচিত ‘কাব্যলাপন’ গ্রন্থটিও একই সুতোয় গাঁথা এক  রোমান্টিক প্রেমের আলাপন। যেখানে বিয়াল্লিশটি জোড়া অনুকাব্য রচিত হয়েছে।
ফেরদৌস  জেসমীন ও বেলাল মোহাম্মদ জীবন দুই সহকবি গ্রন্থটি রচনা করেছেন। দুজনেই বাংলাদেশের অধিবাসী হলেও জীবিকাসূত্রে ফেরদৌস জেসমীন আমেরিকার  অধিবাসিনী—অপরজন বেলাল মোহাম্মদ জীবন বাংলাদেশের। কবিসূত্রে তাদের আলাপন দীর্ঘদিনের। বয়সের সমতা একটু ওদিক ওদিক হলে কি হবে—তারা যে মনেপ্রাণে কবি। আর এই কবি মন থেকে বন্ধুত্বের আলাপনে তাদের মনে আসে এই কাব্যলাপনের মনোভাব। ব্যাচ শুরু হয়ে গেলো একদম খামখেয়ালী মন থেকে কাব্য লেখা। কেউ একটু গুছিয়ে বলেন আবার কেউ কম গুছিয়ে। এই গুছাগুছির পালা শেষ হলে দেখা গেলো তাদের মন্থন গতিতে বিশাল এক কাব্যতার রূপ নিয়েছে আলাপনের বিষয়গুলো।  শুরু হয়ে গেলো তা সংরক্ষণ ও সংবিয়োজনের অভিলাষ। রূপ  নিলো কাব্যগ্রন্থে। পাঠক পেলো  আনন্দ। তাঁরা জানতে চাইলো কি আছে কবির আলাপনে?

কবির আলাপন! কবিদের আলাপন কেমন হয়—দেখি না একটু  ভেতরে ডুব দিয়ে। এই ডুব  দিতে গিয়েই মাত্র একঘণ্টার কম সময়ে গ্রন্থটির যবানিকা টানতে শুরু করেন পাঠক/ পাঠিকা। সত্যিই খুব আগ্রহ নিয়ে এটি পড়তে হয়। প্রতিটা কবিতা শেষ হতে না হতেই আর একটি কবিতা পড়তে ইচ্ছে হয়। সেটি শেষ তো আর একটা। তারপর আর একটা করতে করতে আর কোথায়? এই যা বাবা—‘শেষ হইয়াও যেনো শেষ হইলো না।’ এতসুন্দর রোমান্টিকতার মধ্যে দিয়ে কবিদের আলাপন কখন সমাপ্ত হলো পাঠক তা বুঝতেই পারলো না।
কি আছে বইটির মধ্যে :
যেহেতু এটা যৌথ কাব্যগ্রন্থ সেহেতু দুজনেরই কথা তুলে ধরতে হয়। কবি বেলাল মোহাম্মদ জীবন চমৎকার লেখেন এবং তিনি আগে থেকেই অত্যন্ত রোমান্টিক চরিত্রের লোক। চমৎকার কথা বলেন এবং মনের অভিব্যক্তি ভীষণ ভালো ও সহজেই অপরকে আপন করে নেন। অত্যন্ত হাস্যজ্জল মনের ব্যক্তিত্ব তিনি।
অপরদিকে ফেরদৌস জেসমীন অত্যন্ত চমৎকার মনের মানুষ ও ভীষণ সুন্দর করে কথা বলেন। মিষ্টি কথা যেমন সুন্দর করে বলেন তেমনি অতি সহজেই তার ব্যক্তিত্ববোধ দিয়ে অপরকে কাছে টানতে পারেন। সুরেলা কণ্ঠ যে তাঁর আছে সেটা কিন্তু আসল কথা নয়; আসল কথা হলো তিনি প্রচণ্ড  ভালো লেখেন। তাঁর লেখাগুলো ঠিক তোতা পাখির কণ্ঠের মতো মিষ্টি, কি বিশ্বাস হলো নাতো—আসুন আমরা লেখাটি একটু পর্যালোচনা করি—কেমন লেখেন তিনি—
‘ইচ্ছেগুলো ইচ্ছে মতো
বুকের ভেতর জ্বলে
কপোল বেয়ে অশ্রুকণা
ঝরে তোমার ছলে।’
কিছু ইচ্ছে আছে যে ইচ্ছেগুলো শুধুমাত্র ইচ্ছের মধ্যেই কুক্ষিগত থাকে; যাকে বাইরে প্রকাশ করা যায় না—অন্তরে ডুকরে কাঁদে। ভেতরটা অঙ্গারে পুড়ে হয় ছাই অথচ প্রকাশ করা যায় না কোথাও। নীরবে-নিথরে দুচোখের গণ্ডদেশ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে তা কখনো মুখের ভেতর প্রবেশ করে।  অশ্রুজলের নোনা স্বাদে দুঃখিত ব্যক্তি কখনও সম্বিৎ ফিরে পায়; ভাবে হায় সে কতই না ছলে প্রেমিক বন্ধুটি তাকে দুঃখের  নদীতে ভাসাচ্ছে।
অপরদিকে প্রেমিক কবি বেলাল মুহাম্মদ জীবন বলেছেন, ‘দুটো দেহ এক আত্মায় বাঁধা।