Menu

প্রবাস বাংলা ভয়েস ডেস্ক ::‌ হাওয়ায় ভরা একটি চামড়ার গোলক—ফুটবল! এই ফুটবল হলো অঘটন ঘটন পটিয়সী। আধুনিক ফুটবলের জন্ম হয়েছিল ১৮৬৩ সালে, ইংল্যান্ডে। তবে চীনে প্রায় আড়াই হাজার বছর আগেই ফুটবল খেলার প্রথম ধারণা তৈরি হয়। এই খেলা গ্রিক এবং রোমান সম্প্রদায়ের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে খ্রিষ্টের জন্মের ৩৫০ বছর আগে। একসময় ‘গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ’ অলিম্পিককে বলা হলেও সেই তকমা বহু আগেই অর্জন করেছে ফিফা ফুটবল বিশ্বকাপ। ১৯৫৪ সালে বিশ্বকাপ ফুটবল প্রথম টেলিভিশনে সম্প্রচার শুরু হওয়ার পর বর্তমানে এটি সারা বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় অনুষ্ঠান। এমনকি অলিম্পিক গেমসের চেয়েও বেশি মানুষ বিশ্বকাপ ফুটবল দেখে থাকে। মেক্সিকোতে অনুষ্ঠিত ৮৬ সালের বিশ্বকাপ ফুটবল বাংলাদেশ টেলিভিশন প্রথম সরাসরি সম্প্রচার করে। পরের বার ১৯৯০ সালে ইতালিতে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপ বিটিভিতে যখন সরাসরি সম্প্রচার করা হয়, তখন সারা দেশে ব্যাপক উন্মাদনা শুরু হয়। কারণ ততদিনে ঘরে ঘরে টেলিভিশনের সংখ্যা বেড়েছে। যেই এক মাসব্যাপী ফুটবল বিশ্বকাপ হয়, সেই মাসটিতে চুরি-ডাকাতিও কমে যায়। পাড়ায় পাড়ায় ব্যাপক উন্মদনা চলে—ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, জার্মানি, হল্যান্ড, ইতালি কিংবা অভাবিত ক্রীড়ানৈপুণ্য দেখানো নতুন কোনো দলের প্রতি।

গত দুই সপ্তাহ ধরে সারা দেশের অলিতেগলিতে হাতে লম্বা লাঠির মাথায় ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা-জার্মানসহ বিভিন্ন দেশের পতাকা নিয়ে ঘুরে বেড়াতে দেখা যাচ্ছে হকারদের। কোভিডের পরে রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বমন্দা দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশেরও মুদ্রাস্ফীতি ও মূল্যস্ফীতি বেড়েই চলেছে। কমে যাচ্ছে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা। কিন্তু যতই বিপর্যয় থাকুক না কেন, ক্রীড়ামোদিদের মধ্যে এসব সংকট-সংশয় নিয়ে কোনো হেলদোল নেই যেন। আমাদের শিল্পসাহিত্যেও ফুটবলের উপস্থিতি যথেষ্ট পুরনো। রবীন্দ্রসাহিত্যে প্রথম ফুটবলের উল্লেখ পাওয়া যায় ‘প্রজাপতির নির্বন্ধ’ উপন্যাসে। চতুর্থ পরিচ্ছেদে উপন্যাসের অন্যতম নায়ক বিপিন সম্পর্কে লেখা আছে যে, সে ফুটবল খেলে। এরপর ‘মাস্টারমশায়’ গল্পে বলা হয়েছে, অধর মজুমদার প্রচুর টাকা-পয়সা করলেও হিসেবি ও সাবধানী ছিলেন। তাঁর সম্পর্কে লেখা ছিল, ‘পাড়ার ফুটবল ক্লাবের নাছোড়বান্দা ছেলেরাও বহু চেষ্টায় তাঁহার তহবিলে দন্তস্ফুট করিতে পারে নাই।’ রবীন্দ্রনাথের ‘সহজ পাঠ’-এ আছে—‘ঐ যে আসে শচী সেন, মনি সেন, বংশী সেন। আর ঐ যে আসে মধু শেঠ আর ক্ষেতু শেঠ। ফুটবল খেলা হবে খুব।’

অনেক বিদ্বত্জন বলেন, কাজী নজরুল ইসলামের ফুটবল খেলার ভীষণ ঝোঁক ছিল। তিনি নাকি ফুটবল খেলায় নেমে ইংরেজ ছেলেদের সুযোগ পেলেই কিল-চড়-ঘুষি মারতেন! এমনকি ফুটবলকে তিনি ‘ভারতের স্বাধীনতা’ হিসেবেও একটি কবিতায় উল্লেখ করেছেন। তিনি লিখেছেন: “ক্যালকাটা মাঠে সহসা বিকাল বেলা।/ ময়দানে জোর ভিড় জমিয়াছে বড় ছোট মাঝারির/স্বদেশি বিদেশি লোভী নির্লোভ হেটো, মেঠো বাজারীর।/এই দিকে ‘রাজী’ ও দিকে ‘নারাজী’ দল/সেন্টারে পড়ে আছে ‘ভারতের স্বাধীনতা’ ফুটবল।”জসীমউদ্দীন তাঁর ‘হাসু’ কাব্যে ‘ফুটবল খেলোয়াড়’ কবিতায় লিখেছেন: আমাদের মেসে ইমদাদ হক ফুটবল খেলোয়াড়,/হাতে পায়ে মুখে শত আঘাতের ক্ষতে খ্যাতি লেখা তার।’

রম্যলেখক শিবরাম চক্রবর্তী রসাত্মক গল্প লিখেছেন ফুটবল নিয়ে। গল্পটির একটি অংশে আছে: ‘খেলার শেষে মাঠ পেরিয়ে বাড়ি ফিরছি, সঙ্গে বিশুদা। সেদিন মোহনবাগান হেরে গেছে যেন কার সঙ্গে, সকলের মন-মেজাজ অত্যন্ত কুিসত। বিশুদা যেমন-কে-তেমন গম্ভীর। কতদূর এগোতেই সামনে দেখি কতকগুলো ছোকরা দুই দলে ভিন্ন হয়ে গিয়ে একে-অন্যকে নৃশংসভাবে গালাগাল করছে।…প্রথম দলের দিকে এগিয়ে গেল বিশুদা। স্বাভাবিক শান্ত গলায় বললে, কী বাবা, গালাগাল দিচ্ছ কেন? বলেই বলা-কওয়া নেই কতকগুলি চান্ত গালাগাল বিশুদা তাদের লক্ষ্য করে ছুড়ে মারল। তারা একদম ভ্যাবাচাকা খেয়ে গেল—কে এই লোক! পরমুহূর্তেই অপর দলকে লক্ষ্য করে বিশুদা বললে, সব ভদ্রলোকের ছেলে তোমরা, গালাগাল করবে কেন? বলেই ওদের দিকে কতকগুলো গালাগাল ঝাড়ল। প্রথম দল তেড়ে এলো বিশুদার দিকে: আপনি কে মশাই আমাদের গালাগাল দেন? দ্বিতীয় দলও মারমুখো। আপনি গালাগাল করবার কে? আপনাকে কি আমরা চিনি, না, দেখেছি? দেখতে দেখতে দু-দল একত্র হয়ে বিশুদাকে আক্রমণ করতে উদ্যত হলো। বিশুদার গম্ভীর মুখে দুষ্টু একটু হাসি। করজোড় করে বললে, বাবারা, আর কেন? যেভাবেই হোত, দু-দলকে মিলিয়ে দিয়েছি তোত। যাও বাবারা বাড়ি যাও। এমনি একত্র হয়ে থাক—মাঠের খেলায় দেশের খেলায় সব খেলায় জিততে পারবে। আমার শুধু মিলিয়ে দেওয়া কথা। নইলে, আমি কেউ না।’সত্যিই তো, হানাহানি-মারামারি কেন এত? একটাই তো দেশ! আমাদের মধ্যে যদি ঐক্য থাকে, তবে কে আমাদের দাবিয়ে রাখবে?

প্রবাস বাংলা ভয়েস/ঢাকা/ ২৯ নভেম্বর ২০২২ /এমএম