কিছু কিছু মানুষ হঠাৎ করেই প্রচন্ড ক্ষমতাশালী হয়ে উঠে। রাজনীতির এমন কালচার আগে ছিল না। ২০১৪ সাল থেকে রাজনীতির এই উল্টো সংস্কৃতি সমাজ দেশ আর জাতির উপর নতুন গতিতে চেপে বসেছে। আর এর খেসারত দিতে হচ্ছে দেশ ও জাতিকে, ক্ষতি হচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলোরও। আগেকার দিনে হঠাৎ করে নেতা হওয়ার কোন সুযোগ ছিল না। সামরিক একনায়করা যখন রাজনীতির প্রতি খায়েশী হয়ে উঠে, তখন থেকেই রাজনীতিতে কেনা বেচার সংস্কৃতিটি চালু হয়। জিয়া, এরশাদ এ ব্যবসায় বেশ সফল ও হয়েছিলেন। মুসলিম লীগ আর হতাশাগ্রস্থ জনবিচ্ছিন্ন চীন, রাশিয়া পন্থী বাম রাজনীতির কিছু নেতা নেত্রী এ ব্যবসায় বেশ দক্ষতা ও দেখিয়েছিলেন। জন সমর্থনে ইউপি চেয়ারম্যান হওয়ার যোগ্যতা না থাকলেও মন্ত্রীর পতাকা নিয়ে আলীসান বাড়ি,গাড়ি ভোগ করেছেন। সীমাহীন ত্যাগ তিতিক্ষার স্বীকার হলেও হাতে গুনা দু’চারজন বাদে আওয়ামী রাজনীতির বৃহত্তম অংশই জিয়া, এরশাদের পণ্য হয়ে উঠেনি। আর এর সুফল হচ্ছে, জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর আওয়ামীলীগ একুশ বছর ক্ষমতার বাইরে থেকেও নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়নি।
এরশাদ বহু জনবিচ্ছিন্ন অপদার্থকে মন্ত্রীত্ব দিয়েছিলেন। “আজকে রাজা কালকে ফকির” এমন কিসিমের মন্ত্রীর তো অভাব ছিল না। পতাকা সজ্জিত দামী গাড়ি আর পুলিশ পাইক পেয়াদা নিয়ে দাপট দেখালেও জনগণের কাছে এরা ছিল মূল্যহীন। নয় বছরের কেবিনেট মন্ত্রী সিরাজুল হোসেন খান হবিগঞ্জে আসলে সরকারি পাইকপেয়াদা ছাড়া সালাম দেয়ার লোক পাওয়া যেতো না। তারই এলাকার মানুষ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শরীফ উদ্দিন স্যার রাস্তায় বেরুলে জনগণের সালাম ভালোবাসায় ক্লান্ত হয়ে ঘরে ফিরতেন। অর্থ বিত্ত ক্ষমতা নয়, ত্যাগ তিতিক্ষার রাজনীতি করে এরা জনমানুষের নেতা হয়ে উঠেছিলেন।
বছর পাঁচ আগে স্থানীয় সরকারে দলীয় মনোনয়ন প্রথা চালু হলে আশাবাদী হয়ে উঠে তৃণমূলের ত্যাগী নেতা-কর্মীরা। বিধি বাম, অল্প দিনেই শুভ কাজে অম্ল! টাকার জোরে অনেক স্থানেই ত্যাগীদের পেছনে ফেলে নব্য সুবিধাবাদীরা এগিয়ে যায়। সারাজীবন ত্যাগ স্বীকার করা মানুষগুলোকে আবারও হতাশায় ভর করে। জননেত্রী শেখ হাসিনার হুংকার গতিপথে কিছুটা স্থবিরতা আনলেও নষ্টরা থেমে থাকেনি। অাধুনিক গনতন্ত্রের পরিপন্থী আইউবী কায়দার জেলা পরিষদের নির্বাচন নষ্টদের জন্য পোয়াবারো হয়ে উঠে। সারাদেশেই চেয়ারম্যান প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হতে উঠেপড়ে লেগে যায়। ক্ষমতাশালীরা সফল হয়, যেখানে সফলতা আসেনি, মৌলিক গনতন্ত্রের ভোটে টাকা ই সেখানে মূখ্য হয়ে উঠে। আবারও সেখানে বঞ্চিত হয় আদর্শিক ত্যাগী নেতা কর্মিরা।
আমার জেলা হবিগঞ্জ আওয়ামী লীগের ঘাঁটি বলেই পরিচিত। অনেকেই হবিগঞ্জকে বৃহত্তর সিলেটের গোপালগঞ্জ বলেই অভিহিত করেন। ৮৬ আর ৮৮’র ম্যাজিক নির্বাচন কে বাদ দিলে ১৯৭০ সাল থেকেই আওয়ামী লীগের প্রাধান্য ছিল সর্বব্যাপী। এ যাবতকালের জেলা আওয়ামীলীগের নেতৃবৃন্দ-এর জন্য অবশ্যই সাধুবাদ পেতে পারেন। ৯১ সালে মরহুম আবু লেইছ মুবিন চৌধুরীর বিএনপি তে যোগদানের মাধ্যমে সদরের সংসদীয় আসনে বিএনপি অাধিপত্য বাড়তে থাকে। সজ্জন, সদালাপী, সৎ মানুষ মুবিন চৌধুরীর ব্যক্তি ইমেজ আর পৌর মেয়র গৌউছের সাংগঠনিক দক্ষতায় কিছু কালের জন্য বিএনপি বেশ শক্তিশালী হয়ে উঠে।
হবিগঞ্জ আওয়ামী লীগের কালোমেঘ কাটতে খুব বেশী সময় লাগেনি। এডভোকেট আবু জাহিরের সুদক্ষ সাংগঠনিক নেতৃত্বে আবারও সুদিন ফিরতে শুরু করে। ২০০৮ সালে রেকর্ড ভোটের ব্যবধানে বিএনপি কে হারিয়ে আবু জাহির সাংসদ হয়ে ছাত্রলীগ, যুবলীগ আওয়ামী লীগের প্রাণের নেতা হয়ে উঠেন। দলীয় প্রতিক নিয়ে জেলার অনেক নেতা, মন্ত্রী এমপি হলেও তৃণমূলের ত্যাগী নেতা কর্মীর ‘ভাই’ হয়ে উঠতে পারেননি। সেক্ষেত্রে আবু জাহির ব্যতিক্রম ই বটে। তিনবারের এমপি হলেও সারা জেলার নেতা কর্মীর কাছে এখনো সে তাদের প্রিয় ‘জাহির ভাই’। পাওয়া না পাওয়ার কিছু মান অভিমান থাকলে ও ২০০১ থেকে ২০১৮ অবধি আবু জাহিরের নেতৃত্বে হবিগঞ্জের আওয়ামী লীগ মহীরুহে পরিনত হয়।
গত দুই বছর যাবত, প্রশ্নাতীত সাফল্যের অধিকারী জেলা আওয়ামী লীগ কে বিতর্কিত করার নানা প্রচেষ্টা চালানো হয়। উত্তরাধিকারের দাবি নিয়ে কেউ কেউ নেতা হতে চাইলেও তৃনমূলের ত্যাগী নেতা কর্মীর আপনজন হয়ে উঠতে পারেন নি। হতাশায় নিমজ্জিত কুচক্রীরা হলুদ সাংবাদিকতা দিয়ে আওয়ামীলীগকে চেপে ধরতে চেষ্টা করে। পৌরসভার স্থানীয় নির্বাচন কে নিয়ে কিছুটা সফল ও হয়।
অদ্যাবধি হবিগঞ্জে পাঁচ টি পৌরসভার নির্বাচনে তিনটিতে হেরেছে আওয়ামী লীগ। শায়েস্তাগঞ্জে জেলা আওয়ামী লীগের তালিকার ব্যত্যয় ঘটিয়ে নৌকা নিয়ে আবির্ভূত প্রার্থী তৃনমূলের নেতা কর্মীর প্রার্থী হয়ে উঠতে পারেন নি, ফলাফল বিপর্যয়ে বিএনপির জয়লাভ। নবীগঞ্জ আওয়ামী লীগের উর্বর ভূমি। সেখানেও তৃনমূলের কাছে গুরুত্বহীন, এক মন্ত্রী জামাতার নৌকা নিয়ে আকস্মিক আবির্ভাব জনগন ভালো চোখে দেখেনি। জেলা, উপজেলা আর কেন্দ্রীয় নেতাদের অক্লান্ত পরিশ্রমেও মন্ত্রী জামাতার মান-সম্মান রক্ষা করা সম্ভব হয়নি। মাধবপুর ১৯৭০ সাল থেকেই আওয়ামী লীগের দূর্গ বলে পরিচিত। পৌরসভা প্রতিষ্ঠার পর থেকে আওয়ামী লীগের ধারাবাহিক বিজয়ের ব্যত্যয় ঘটেনি। এবারের নির্বাচনে পঞ্চাশ বছরের ত্যাগী আওয়ামী লীগ নেতা দুই যুগের আওয়ামী লীগ সভাপতি দু’বারের সাবেক মেয়রকে চ্যালেঞ্জ করে নৌকা নিয়ে আবির্ভূত হয় সুধা সদনের অসীম ক্ষমতাধর এক সাবেক নিরাপত্তা কর্মী। তৃণমূল গ্রহণ করেনি বলে শোচনীয় পরাজয়ে জামানত বাজেয়াপ্ত হয়। আওয়ামী দূর্গে উত্থান ঘটে বিএনপির। পরবর্তীতে আওয়ামী প্রার্থীর সংবাদ সম্মেলনে জানা যায় ৯৯% নেতা কর্মীই উনার বিপক্ষে ছিল।
চুনারুঘাট পৌরসভায় আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী ছিল তৃণমূলের ত্যাগীদের ই একজন। জেলা উপজেলার সমন্বিত প্রয়াস থাকায় জনপ্রিয় বর্তমান মেয়রকে হারিয়ে আওয়ামী লীগ প্রার্থী জয়লাভ করেছে। গত ২৮ শে ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত হলো হবিগঞ্জ সদরের পৌরসভা নির্বাচন। আওয়ামী লীগের প্রার্থী ছিল দীর্ঘ দিনের পরীক্ষিত ত্যাগী যুবলীগ নেতা জেলা যুবলীগের সভাপতি আতাউর রহমান সেলিম। জেলা আর কেন্দ্রের নির্দেশ অমান্য করে প্রার্থী হয়েছিলেন বর্তমান মেয়র মিজানুর রহমান মিজান। ব্যক্তিগত ইমেজে, সততা আর সদালাপে মিজানকে নিয়ে প্রশ্ন না থাকলেও অসীম ত্যাগ তিতিক্ষার দৃষ্টান্ত সৃষ্টিকারী তৃণমূল নেতা কর্মীর ভালোবাসার প্রতিক সেলিম কে ই বেচে নেয় তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা। জেলা আওয়ামী লীগের সার্বিক তত্ত্বাবধানে যুবলীগ, ছাত্রলীগের অক্লান্ত পরিশ্রমে হলুদ সাংবাদিকতা আর নানা অপপ্রচার কে প্রতিহত করে পৌর পিতার পদটি পুনরুদ্ধার করে আওয়ামী লীগ।
আওয়ামী লীগ সামরিক ছাউনি তে জন্ম নেয়া কোন রাজনৈতিক দল নয়। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর দল আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের ইতিহাসের সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িত। উপমহাদেশের প্রাচীণতম এই দলটির রয়েছে অনেক গৌরবোজ্জ্বল অতীত। মুক্তবাজার অর্থনীতির প্রতিযোগীতায় অর্থ ই যখন মুখ্য, এমন পরিবেশে মিশ্র ধারার এই রাজনৈতিক দলে কিছু আগাছার আশ্রয় তো অসম্ভব নয়, তবুও ত্যাগ তিতিক্ষায় সমৃদ্ধ তৃণমূলের উপর অগ্রহণযোগ্য নেতৃত্ব ছাপিয়ে দেয়ার প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকলে, হঠাৎ ক্ষমতাশালী হয়ে উঠা এসব নেতৃত্ব দলটির জন্য বুমেরাং হয়ে উঠতে পারে।
লেখকঃ কলামিস্ট, উন্নয়ন গবেষক ও সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষক
প্রবাস বাংলা ভয়েস/ঢাকা/৩ মার্চ ২০২১ /এমএম