Menu

‘গ্লোবাল লিংগুয়া ফ্রাঙ্কা’ আরেকটু রপ্ত করা যেতে পারে

সালাহ্উদ্দিন নাগরী :: একটি দেশের মাতৃভাষা তার অহঙ্কার, যে জাতি জ্ঞান-বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে যত অগ্রগামী, সে জাতির ভাষা অন্য জাতির কাছে তত বেশি আদরণীয় ও গ্রহণযোগ্য। বায়ান্ন’র ভাষা আন্দোলন আমাদের ভাষাকে সমুন্নত ও সমৃদ্ধ করার অন্যতম অনুপ্রেরণা।

এ আন্দোলন বাংলাকে রাষ্ট্রভাষায় পরিণত করেছে। মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীনতা বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সর্বক্ষেত্রে প্রবেশাধিকার দিয়েছে। সরকার বাংলা ভাষার আরও উন্নতি, শ্রীবৃদ্ধি ও ক্ষেত্র পরিবৃদ্ধিতে সদা সচেষ্ট।

এখন সরকারি বিভিন্ন আইন, আদেশ, ঘোষণা বাংলা ভাষায় তৈরি হচ্ছে। উচ্চশিক্ষা, গবেষণা কার্যক্রম কোনো কোনো ক্ষেত্রে বাংলায় সম্পন্ন করা হচ্ছে। কর্মপ্রতিষ্ঠানগুলোতেও বাংলা চালু হয়েছে। তারপরও বাংলাকে সর্বস্তরে চালু করা যায়নি।

বিদেশিদের সঙ্গে যোগাযোগ, দ্বিপাক্ষিক আলোচনা, মিটিং, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড, যৌথ ঘোষণা ও সিদ্ধান্ত ইংরেজি ভাষাতেই সম্পন্ন করতে হচ্ছে। প্রতিনিয়ত লেখাপড়া, উচ্চশিক্ষা, বিভিন্ন মিটিং, সভা-সেমিনার ও ওয়ার্কশপে অংশগ্রহণে বিদেশে যেতে হচ্ছে।

ভিন্নভাষাভাষীদের সঙ্গে নিয়মিত মিথস্ক্রিয়া হচ্ছে, ইংরেজিতে কথাবার্তা, আলোচনায় অংশগ্রহণ, মতবিনিময়ে নিজেকে যথাযথভাবে সম্পৃক্ত করা যাচ্ছে না, ফলে হয়তো আমাদের পিছিয়ে যেতে হচ্ছে।

ইংরেজি এখন শুধু ইংরেজদের ভাষা নয়- এটা শিল্প, সাহিত্য, অর্থনীতি, দর্শন ও বিজ্ঞানের ভাষা। পৃথিবীর যেখানে যখন যত ধরনের সভ্যতার উন্মেষ ঘটেছে, শিল্প-সাহিত্য, বিজ্ঞান ও যত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছে; তার সবকিছু ইংরেজিতে সংকলিত, সংযোজিত, সংরক্ষণ করা হয়েছে। গ্রিক, রোমান, ইসলামি, চাইনিজ ও ভারতীয় সভ্যতার উল্লেখযোগ্য গবেষণা, রচনাগুলো ইংরেজি ভাষায় অনূদিত হয়েছে।

যে কোনো বিষয়ের ওপর গবেষণা, বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনার জন্য রেফারেন্স হিসেবে ইংরেজিতে লিখিত বই-পুস্তকই প্রধান উৎস। যথেষ্ট দক্ষতা না থাকলে ওইসব লেখা পড়ে হৃদয়ঙ্গম করা অনেক সময় কষ্টকর হয়ে যায়। আমাদের দেশের শিক্ষার্থী, গবেষকদের প্রতিনিয়ত এ ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হতে হচ্ছে।

ইন্টারমিডিয়েট পর্যন্ত বাংলা মাধ্যমে লেখাপড়া করা একজন শিক্ষার্থীর পক্ষে উচ্চশিক্ষায় হুট করে ইংরেজিতে লেখা বই পড়ে বোঝা ও পাঠদান অনুসরণ কঠিন না হলেও সহজসাধ্য নয়।

বর্তমানে আমাদের শিক্ষাকাঠামোয় স্কুল পর্যায়ে কমিউনিকেটিভ ইংরেজির ওপর জোর দেয়া হয়েছে, তারপরও মনে হয় এ কাঠামো ও সামাজিক মিথস্ক্রিয়ায় ইংরেজি বলা, শোনা, লেখায় যতটুকু দক্ষতা আসা দরকার; সেটা আসছে না।

আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় ন্যাশনাল কারিকুলামের বাংলা ভার্সনে পড়া শিক্ষার্থীদের সঙ্গে, একই কারিকুলামের ইংরেজি ভার্সন ও ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়া শিক্ষার্থীদের ইংরেজি ভাষায় দক্ষতাকেন্দ্রিক পার্থক্য বিভিন্নভাবে অস্বস্তিকর ও নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।

সরকারি এবং কিছু বেসরকারি অফিসে ফাইলিং, নোটিং, মিটিং সাধারণত বাংলায় সম্পন্ন হয়। তাই কর্মজীবনে ইংরেজি চর্চার সুযোগ থাকে না বরং ছাত্রজীবনে ইন্টারমিডিয়েট পর্যন্ত আহরিত ইংরেজি জ্ঞান কর্মজীবনে ভুলতে বসে।

সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন পর্যায়ের লোকজন দাফতরিক কাজ ও প্রশিক্ষণে বিদেশে যাচ্ছে, ওদের সঙ্গে নানা কাজে ইমেইল আদান-প্রদান করতে হচ্ছে, সেখানেও ইংরেজিতে দুর্বলতার বিষয়টি বাধা হয়ে দাঁড়ায়।

সরকারি-বেসকারি চাকরিতে ইন-সার্ভিস ট্রেনিংয়ে দু-চার মাসের ইংরেজি চর্চায় খুব একটা ফল পাওয়া যাচ্ছে না। আসলে ম্যাচিউরড বয়সে ওই ধরনের ট্রেনিংয়ে ইংরেজি ফ্লুয়েন্সি আসবে না।

উন্নত যেসব দেশে ব্যাপকভিত্তিক ইংরেজি চর্চা নেই, ওইসব দেশের সর্বোচ্চ পদধারীরাও বিভিন্ন মিটিং বা দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় কাউন্টারপার্টের সঙ্গে দোভাষীর মাধ্যমে কথোপকথন চালাচ্ছে।

কিন্তু আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশের বেলায় এটা অনেক ক্ষেত্রে অযোগ্যতা হিসেবেই বিবেচিত হচ্ছে। ইংরেজি ভাষায় পরিচালিত সভা-সেমিনার, ওয়ার্কশপে অনেকেই ভালো ভালো পর্যবেক্ষণ, যুক্তি, ব্যাখ্যা সঠিকভাবে উপস্থাপন করতে পারছে না। নিজেকে গুটিয়ে রাখছে। অনেক ক্ষেত্রে চোখে-মুখে অসহায়ত্বের ছাপ ফুটে উঠছে।

বিভিন্ন দেশে জনবল প্রেরণে সমযোগ্যতাসম্পন্ন হয়েও ইংরেজিতে দুর্বলতার কারণে অন্যান্য দেশে বিশেষত ভারত, শ্রীলঙ্কা, ফিলিপাইনের সঙ্গে পেরে ওঠা যাচ্ছে না।

ওই দেশগুলোর ক্লিনার, ডে-লেবারার, সেলসম্যানসহ প্রায় সবাই কাজ চালিয়ে নেয়ার মতো ইংরেজি জানে ও বলতে পারে। এত অধিক জনসংখ্যার দেশ হওয়ার পরও বিদেশে প্রেরিত আমাদের জনবল অন্যান্য দেশের সঙ্গে কম্পিটিশনে পিছিয়ে যাচ্ছে।

বিদেশিদের সঙ্গে দাফতরিক আলোচনা ও বিদেশে স্টাডি ট্যুর বা অন্যান্য প্রশিক্ষণে ইংরেজিতে ঘাটতির জন্য কাক্সিক্ষত ফল লাভ হচ্ছে না।

লেখাপড়া ছাড়া জ্ঞানের সীমা বাড়ে না, আর মাতৃভাষা ছাড়া ভিন্ন ভাষায় জ্ঞানচর্চা পরিপূর্ণতা পায় না। অপরিপূর্ণ জ্ঞান নিয়ে বিশ্ব চরাচরের তুমুল প্রতিযোগিতায় কেবল পিছিয়েই যেতে হয়।

একটা জাতি ও দেশের স্বকীয়তাকে ধরে রাখা ও দেশের মানমর্যাদা বৃদ্ধির জন্য মাতৃভাষা বা রাষ্ট্রীয় ভাষাকে সমুন্নত করার কোনো বিকল্প নেই, পৃথিবীর উন্নত দেশ যেমন জার্মানি, ফ্রান্স, জাপান, চীনসহ আরও বেশকিছু দেশ তাদের নিজস্ব ভাষাতেই লেখাপড়া, গবেষণা, দাফতরিক কাজকর্মসহ আনুষ্ঠানিক সবকিছুই পরিচালনা করছে।

আমরা এখনও ওইসব দেশের পর্যায়ে উন্নীত হতে পারিনি। তাই ইংরেজি ভাষাকে একটু আয়ত্তে আনার উপায় বের করা দরকার।

অভিভাবকের আর্থিক সঙ্গতির ওপর ভিত্তি করে একজন শিক্ষার্থীর ইংরেজি জানা না জানার বিষয়ে পার্থক্য তৈরি হচ্ছে। অসচ্ছল পরিবারের সন্তানরা সাধারণ স্কুলে পড়ে ইংরেজি জানা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে অনেক ক্ষেত্রে কুলিয়ে উঠতে পারছে না।

যেহেতু ইংরেজি বিশ্বভাষা, তাই প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে ইংরেজিতে পর্যাপ্ত দক্ষতা আনয়নে সমসুযোগ সৃষ্টির বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে।

ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, এদেশে বসবাস করে বাংলায় কথা বলা পরিবেশে বেড়ে ওঠা অনেক শিশু স্কুলে যাওয়ার বয়সের আগেই টিভি, কম্পিউটারে ইংরেজি কার্টুন, বাচ্চাদের মুভি দেখে ইংরেজিতে যথেষ্ট অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছে।

অনেক ক্ষেত্রে ওইসব শিশু বাংলার চেয়ে ইংরেজিতে কথা বলতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছে। আমাদের প্রাইমারি স্কুল পর্যায়ে লিসেনিং, রাইটিং, স্পিকিং চর্চায় উদ্যোগ নিতে হবে।

শিশু শিক্ষার্থীদের ইংরেজি কার্টুন বা বাচ্চাদের উপযোগী ছবি নিয়মিত দেখানোর মাধ্যমে ইংরেজিতে দ্রুত দক্ষতা আসতে পারে। একটি টেলিভিশন বা প্রজেক্টর ও কিছু সিডি দিয়ে উদ্যোগটি বাস্তবায়ন করা যাবে। তাই স্কুল পর্যায়ের প্রত্যেক শ্রেণীতে ‘ইংরেজি প্র্যাক্টিক্যাল’ সাবজেক্ট হিসেবে একটি ক্লাস চালু করা যেতে পারে।

আমাদের দেশে উচ্চশিক্ষায় ইংরেজি চর্চার কোনো ব্যবস্থা নেই। প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে নিজেকে যোগ্যতর হিসেবে প্রতিষ্ঠার জন্য আমরা কি উচ্চশিক্ষার সব পর্যায়ে কমিউনিকেটিভ ইংরেজির একটি পেপার চালু করতে পারি না? করলে দোষ কী?

এতে তো বরং শিক্ষার্থীদের উপকারই হবে; তারা লেখাপড়া শেষ করে আই.ই.এল.টি.এস, স্যাট, জি.আর.ই তে উত্তীর্ণ হওয়ার জন্য পয়সাকড়ি খরচ করে কত ধরনের কোর্সেই না ভর্তি হচ্ছে! একইভাবে বিদেশে দক্ষ শ্রমশক্তি প্রেরণের আগে তাদের পেশাভিত্তিক প্রশিক্ষণের পাশাপাশি প্রয়োজনীয় ইংরেজি শেখার আরেকটু বাড়তি ব্যবস্থা করতে পারা যায় না?

উন্নত দেশের কাতারে উন্নীত হওয়ার জন্য আমরা একটি ট্রানজিশনাল পিরিয়ড পার করছি। আমাদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বেড়েছে, ভৌত অবকাঠামোর গুণগত মান ও ব্যাপ্তি বৃদ্ধি পেয়েছে, আমাদের জিডিপি বেড়েছে, এসডিজি’র লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সাফল্য আসছে। তাই এ সাফল্যের ধারাকে আরও বেগবান করতে ইংরেজি চর্চা, ইংরেজি জানা জনবল আরেকটু বাড়তি শক্তি জোগাবে বলেই মনে করা হয়।

বাংলা ভাষাকে বহুল ব্যবহৃত এবং অন্যান্য ভাষাভাষী মানুষের অপরিহার্য ভাষায় পরিণত করতে হলে অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী হতে হবে, আমাদের অর্থনীতিকে অন্যান্য দেশের অর্থনীতির গতি-প্রকৃতি নিয়ন্ত্রণের পর্যায়ে নিয়ে আসার চেষ্টা করতে হবে।

ব্যবসায়-বাণিজ্য প্রসারিত ও বিদেশি বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। পর্যটন শিল্পের বিকাশ, চিকিৎসা সেবার মানোন্নয়নের মাধ্যমে বিদেশিদের ব্যাপকভাবে এদেশমুখী করার উদ্যোগ নিতে হবে।

আর যতদিন ওই পর্যায়ে উন্নীত হওয়া না যাবে, ততদিন দেশের অগ্রগতির ধারাকে ধরে রাখতে ইংরেজি চর্চা আমাদের অব্যাহত রাখতে হবে। ইংরেজিকে প্রয়োজনীয় সব ক্ষেত্রে সমন্বয় করতে হবে। এ প্রসঙ্গে একটি প্রবাদ স্মরণ করা যেতে পারে- ‘If you can’t beat them join them.’ বিষয়টি বিবেচনায় চীনের মতো দেশেও ইংরেজি চর্চায় গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে।

বিশ্বব্যাপী ইংরেজি তার ভাষার ব্যাপ্তি পেরিয়ে একটি প্রযুক্তিতে পরিণত হয়েছে। ‘গ্লোবাল লিংগুয়া ফ্রাঙ্কা’ অভিধার এ প্রযুক্তি যারা যত দক্ষতার সঙ্গে প্রয়োগ করতে পারছে, তাদের উন্নয়নের গতি তত বৃদ্ধি পাচ্ছে।

সর্বস্তরে বাংলা চালু রেখেও গ্লোবাল প্রতিযোগিতার বাজারে দেশের প্রত্যেক কর্মজীবীকে ইংরেজিতে কথা বলা ও লেখার ন্যূনতম একটি পর্যায়ে নিয়ে আসার উপায় নির্ধারণের বিষয়টি এখনই সর্বাধিক গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনার দাবি রাখে।
সালাহ্উদ্দিন নাগরী : সরকারি চাকরিজীবী
সূত্র: যুগান্তর

বাংলানিউজসিএ/ইএন/২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ইং