Menu

আজাদুর রহমান

হাহাকার করে উঠল সে—মৌসুমি তুমি আমাকে

ছেড়ে যেতে পারবে না। আমার সন্তান দরকার নেই।

আমি তোমাকে চাই, তোমাকে

দু জনে পার্টি থেকে ফিরেছে মাত্র, কাপড় পালটে শেষ করতে পারেনি মৌসুমি; সোহরাব হঠাত্ নিজের মনে বলে উঠল—শালার জীবনটাই বৃথা। কথাটা কানে গেলেও মৌসুমি পালটা উত্তর দিল না। দু বছর হয়ে গেল—এখনো তাদের বাচ্চা হয়নি। সোহরাব আবার নিচুস্বরে বলল—চোখের সামনে কলিগদের বাচ্চাগুলো কী সুন্দর কলরব করছিল! আব্বা আব্বা বলে বাবার কোলে লাফিয়ে পড়ছিল!

মৌসুমি আর চুপ থাকতে পারল না। মুখের সামনে গিয়ে ঝাঁজিয়ে উঠল—আমাকে নিয়ে তুমি সন্তুষ্ট না, তাই না? এতই যখন তোমার আফসোস তো যাও না, একটা মেয়ে দেখে বিয়ে করে নাও।

সোহরাব কিছু একটা বোঝাতে যাচ্ছিল, কিন্তু সামাল দেবার আর সময় দিল না মৌসুমি। বেডরুমে ঢুকে দপ করে দরজা বন্ধ করে দিল। এ এক জ্বালা হয়েছে। কথাবার্তা মনমতো না হলেই মৌসুমি দরজা বন্ধ করে দেয়। তারপর হাজার সাধলেও তার মান ভাঙানো যায় না। রাগ পড়তে পড়তে তিন-চার দিন পর্যন্ত লেগে যায়। মাথায় কিছু চড়ে গেলে সঙ্গে সঙ্গেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে সে। এই যেমন কদিন আগে, সোহরাব অফিসে যাওয়ার জন্য বের হচ্ছে, এমন সময় ক্যাঁচালটা লেগে গেল। অফিস টাইমে ঝামেলা না করাই বুদ্ধিমানের কাজ। গালাগালি পর্যন্ত যাওয়ার পর সোহরাব তাই নিজেকে কন্ট্রোল করে নিল। কিন্তু হাল ছেড়ে দেওয়াতে মৌসুমি আরো রেগে গেল এবং একপর্যায়ে ব্যর্থ হয়ে পায়ে পাড়া দিয়ে তুই-তোকারি করে বকতে শুরু করল। বকাবাজি যাই হোক, বউ তুই-তোকারি করলে মেজাজ ঠিক রাখা কঠিন হয়ে পড়ে। সোহরাব রাগটা বেশিক্ষণ চেপে রাখতে পারল না, চিত্কার করে উঠল—মুখ সামলে কথা বল, তুই-তোকারি করছ কেন?

আর যায় কোথায়, মৌসুমি যেন পয়েন্ট পেয়ে গেল। ঝাঁপিয়ে এসে গলা বাড়াল—তুই বললে কী করবি, মারবি। মার তো দেখি মার।

পরিস্থিতি যা তাতে ম্যাচে টোকা দেওয়ামাত্র অগ্নিকাণ্ড ঘটে যাবে। অগত্যা দাঁতে দাঁত পিষে না খেয়েই বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ল সোহরাব। তারপর দুপুরেই ফিরে এলো সে। দরজায় তালা লাগানো। বুয়াকে চাবি দিয়ে মৌসুমি ঘণ্টা দুয়েক আগে চলে গেছে। মোবাইল সুইচড অফ। বাপের বাড়িতেও কিছু জানায়নি সে। অস্থিরতার মধ্যে দিয়ে সময় পার করতে থাকল সোহরাব। একটা মেয়েমানুষ কোথায় গেল? রাগের মাথায় আবার না কোনো উলটোপালটা কাজ করে বসে। ভয়ে ভয়ে বারবার মোবাইলে চেষ্টা করতে লাগল সে। কিন্তু মৌসুমি মোবাইল খোলেনি। অবশেষে রাত ন’টায় শ্বশুর ফোন করে জানালেন, সে বাড়িতে এসেছে। কোনোমতে হাঁফ ছেড়ে বাঁচে সোহরাব।

এরপর বহুবার মৌসুমি এই কাণ্ড করেছে। মৌসুমি যে তাকে ভালোবাসে না, তা নয়। যখন ভালোবাসে তখন পাগলের মতো করে। আর যাই হোক, কোনোভাবেই সে সোহরাবকে ছাড়া থাকতে পারে না। ঝগড়া পিক পয়েন্টে উঠে গেলে সে এমন কথাও বলে যে—সোহরাব প্রায় বিশ্বাস করেই ফেলে—সংসারটা বুঝি এবার ভেঙেই গেল। প্রথম বছরে সোহরাব কিছুটা মিস আন্ডারস্ট্যান্ড করত। কিন্তু দুই-তিনবার বাড়ি ছাড়ার পর বিষয়টা পরিষ্কার হয়ে এলো। যত রাগের তাপে সে বাপের বাড়ি যায় তত রাগ তার থাকে না। একদিন পরেই তার উলটো টান শুরু হয়ে যায়। টান ফেরাতে অবশ্য সামান্য মান ভাঙাতে হয়। সোহরাব নিজেই ফোন করে। মৌসুমি প্রথম দুই দিন কল কেটে দেবে, তারপর একসময় ভারী গলায় কথা বলে উঠবে। এরপর আর অসুবিধা হয় না। নিজ থেকেই ফেরার জন্য ছটফট শুরু করে দেয় সে। সোহরাবকে যেতে হয় না। মৌসুমি একাই বাসে উঠে বসে। আবার সাবেকি ধারায় সংসার চলতে থাকে। যেন কিছুই হয়নি। অতীতের সব ছবি মুছে যায় চোখ-মুখ থেকে। সোহরাবও মৌসুমিকে পাগলের মতো ভালোবাসে। মৌসুমির ভালোবাসাকেও ছোট করার উপায় নেই। কিছু পাগলামি ছাড়া সে অপূর্ব এক নারী। বাপের এক মেয়ে। ছোটবেলা থেকেই আবদার-আহ্লাদে বড় হয়েছে। হাঁড়ি ঠেলা তো দূরের কথা, কোনোদিন খড় ছিঁড়ে দু ভাগ পর্যন্ত করেনি সে। সংসারের আঁচ তার পাবার কথা নয়। তথাপিও সোহরাবের সংসারে এসে হাঁড়ি থেকে শুরু করে অন্দরমহলের সবকিছুতেই হাত লাগিয়েছে সে। সংসারের সবদিকে হাত রেখে যে মেয়ে স্বামীকে সমান তালে ভালোবাসতে পারে এ বাজারে তাই বা মন্দ কী? মৌসুমির তেমন বাহুল্য নেই। অন্যরা যেমন কাপড়চোপড়, কসমেটিক, গয়না কিংবা ইমিটেশন কেনার জন্য হামলে থাকে, মৌসুমি সেরকম নয়, বরং উলটো। এমনিতেই সে দশজনের মধ্যে একজন। সামান্য সাজুগুঁজু করলে তো কথাই নেই, পঞ্চাশ জনের মধ্যে একজন হয়ে যায় সে। মোদ্দাভাবে মৌসুমি যা চায় কেবল সোহরাবের পূর্ণ মনোযোগ আর ভালোবাসা।

সোহরাব অবশ্য তার প্রতি মনোযোগী হতে চেষ্টাও করছে। সমস্যা হলো মৌসুমির সব রুচির সঙ্গে তাল মেলানো কষ্টকর। সে চায় সোহরাব তার সঙ্গে বসে হিন্দি সিরিয়াল দেখুক। একটু বাংলা সিনেমা নিয়ে কথা বলুক। কিন্তু সোহরাবের এসবে মন বসে না। তার ফেভারিট হলো খেলা আর সংবাদ। কিন্তু আর যাই হোক, টিভি দেখার ব্যাপারে আপস করতে নারাজ মৌসুমি। অনেকটা বাধ্য হয়েই সোহরাব তাই হিন্দি সিরিয়ালে চোখ রাখে। হাল-বেহালের বাংলা সিনেমার কথায় সায় দেয়। বাংলা সিনেমা দেখতে গিয়ে মনে মনে আফসোস করে সোহরাব, আহা মৌসুমির সঙ্গে যদি রাজনীতি, কবিতা, সৃষ্টিরহস্য, ধর্ম, নিদেনপক্ষে সৃষ্টিশীল কোনো কিছু নিয়ে আলাপ করা যেত, শেয়ার করা যেত! আহা বড় ভালো হতো।

বিয়ের পরের বছর অবশ্য আরো একটা ঝামেলা করত। অফিস থেকে হুটোপুটি করে বের হয়ে আসতে হতো। ফোনের পর ফোন করত। তারপর জেরা টানতে টানতে জেরবার করে ফেলবে। নানান প্রশ্ন, এখন কোন জায়গায় আছ, আসতে কতক্ষণ লাগবে— ইত্যাদি। আধঘণ্টার জায়গায় চল্লিশ মিনিট হয়ে গেলেই অবস্থা খারাপ। গাল ফুলিয়ে ঢোল করে থাকবে। দুই-তিন ঘণ্টার কমে ফোলা কমবে না। সোহরাবকে সে যে ঠিক সন্দেহ করত তাও না। মৌসুমির গ্রামার ধরতে ধরতে এক বছর পার হয়ে গেল। এখন অবশ্য মৌসুমির এ ব্যাপারটা অনেকখানি কমে গেছে। ক্ষণে ক্ষণে বাড়ি যাওয়াটাও হালকা-পাতলা হয়ে গেছে। দিনে দিনে সে যেন সোহরাবের ভিতর নিজেকে সমর্পণ করে দিচ্ছে এখন। কিন্তু সন্তানের কথা উঠলেই সে আর সহ্য করতে পারে না। বিয়ের পরের দুই বছর বিষয়টি ছিল না। কিন্তু দুই বছরেও যখন সে কনসিভ করতে পারল না তখনই তার মনে ভয় ঢুকে গেল। তার মানে, সে কি আর মা হতে পারবে না!

তারপর ডাক্তার, কবিরাজ, বৈদ্য ধরে তিন বছরের মাথায় সে যখন কনসিভ করল তখন সে কী আনন্দ তার। কিন্তু তিন মাস না যেতেই তলপেট থেকে বাচ্চাটা নেমে গেল। আবার কালো মেঘ জমে গেল মৌসুমির মুখে। ছয় মাসের মাথায় ফের কনসিভ করল। কিন্তু এবারো একই ঘটনা ঘটল। মৌসুমি পাগলের মতো হয়ে গেল। এরপর থেকে টানা তিনবছর আর কোনোভাবেই কনসিভ করতে পারল না। যে-যেখানে যা বলেছে সন্তানের জন্য তা-ই করছে সে। ওদিকে নিয়ম করে গাইনি স্পেশালিস্ট তো আছেই। মৌসুমি মাঝেমধ্যে ঘুমের মধ্যে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে।

কিন্তু ইদানীং নিজের ওপর রাগ হয় সোহরাবের। সে কি কোনোদিনও সন্তানের পিতা হতে পারবে না? ভেতরে ভেতরে বোধ হয় হালও ছেড়ে দিয়েছিল ওরা। কিন্তু মৌসুমি এক সকালে হঠাত্ টের পেল যে আবার কনসিভ করেছে। সোহরাবকে মুখে কিছুই বলল না সে। হঠাত্ই তিন মাস পর আচমকা বমি শুরু হলো। বমির সঙ্গে বানের পানির মতো রক্তস্রাব। সোহরাবের মাথার ঠিক ছিল না। ভাগ্য ভালো যে সঙ্গে সঙ্গেই অ্যাম্বুলেন্সটা পাওয়া গিয়েছিল। ডাক্তার ভালো করে পরীক্ষা করার পর সোহরাবকে আলাদা করে বাইরে নিয়ে এলেন। ঘাড় নামিয়ে কানে কানে বললেন—ঝুঁকি নেওয়াটা ঠিক হবে না, বাচ্চা রাখতে গেলে রক্তক্ষরণে মা মারাও যেতে পারে। আপাতত অ্যাবরশন ছাড়া অন্য কোনো পথ নেই।

ডাক্তারের কথাগুলো কানে ঢোকার পর সে আর দাঁড়াতে পারল না। দ্রুত রাস্তায় নেমে এলোমেলো হাঁটতে লাগল। কী করবে সে? সে সন্তান চায়, কিন্তু মৌসুমিকে মেরে নয়। হাহাকার করে উঠল সে—মৌসুমি তুমি আমাকে ছেড়ে যেতে পারবে না। আমার সন্তান দরকার নেই। আমি তোমাকে চাই, তোমাকে।

প্রায় দৌড়েই ক্লিনিকের বারান্দায় চলে এলো সে। মৌসুমির ভরাট মুখটা একদিনেই কেমন চুপসে এতটুকুন হয়ে গেছে। পাশে গিয়ে বসে পড়ল সোহরাব। মৌসুমির বড় বড় চোখজোড়া থেকে জল গড়িয়ে নামল। সোহরাব সেদিকে খেয়াল করতে পারল না। অস্থির হয়ে সাদা কাপড়টা সরিয়ে দিল। রক্তে ভেসে গেছে বিছানা। আর সহ্য করতে পারল না সে—আমার সন্তান দরকার নেই, তুমি অ্যাবরশন করাও। আমি তোমাকে নিয়েই সুখে আছি।

মৌসুমি দুর্বল হাতে সোহরাবের হাতটা চেপে ধরল—দেখ একটা সন্তানের জন্য আমি মরতেও রাজি আছি। তোমার মুখের দিকে চেয়ে আমার বড় কষ্ট হয়। একটা সন্তান হবে, তোমাকে ‘বাবা বাবা’ বলে ডাকবে—এর চেয়ে শান্তি কী আছে আমার! তাছাড়া আমি তো বেঁচেও যেতে পারি।

মৌসুমি হয়তো আরো কিছু বলতে চাইছিল, কিন্তু তার কথা জড়িয়ে গেল, জ্ঞান হারিয়ে ফেলল। দৌড়ে সোজা ডাক্তারের চেম্বারে চলে গেল সোহরাব। ডাক্তারকে পাওয়া গেল। তাড়াতাড়ি প্রেসারটা মেপে নিলেন তিনি। তারপর মুখ তুলে বললেন, রোগীর ব্লাড গ্রুপ কী? সোহরাব ঘোরের মধ্যেই বলল, এ পজিটিভ।

ডাক্তারও যেন অস্থির হয়ে গেছেন—এক্ষুনি দুই ব্যাগ রক্ত জোগাড় করেন, অপারেশন করতে হবে। আর দেরি করা ঠিক হবে না।

প্রবাস বাংলা ভয়েস /ঢাকা/ ১৬ মার্চ ২০২৪ /এমএম