Menu

প্রবাস বাংলা ভয়েস ডেস্ক ::  এবারের ২৬ মার্চ ছিল বাংলাদেশের ৫৪তম স্বাধীনতা দিবস বা ৫৩তম স্বাধীনতাবার্ষিকী। স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষ্যে দেশের সংবাদপত্রগুলো বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করেছে। কয়েকটি সংবাদপত্রের বিশেষ সংখ্যায় দেশের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের যেসব প্রবন্ধ-নিবন্ধ বেরিয়েছে, সেগুলোর মধ্যে বেশ কয়েকটি পড়ে দেখেছি। প্রবন্ধ-নিবন্ধ ছাড়াও ছিল বিশিষ্টজনদের সাক্ষাৎকার। এসব সাক্ষাৎকার পড়ে বোঝার চেষ্টা করেছি বিশিষ্টজনরা দেশ এবং দেশের সমস্যা নিয়ে কী ভাবছেন।

মহিউদ্দিন আহমদ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট, বাংলাদেশের রাজনৈতিক দল ও গণতন্ত্র সম্পর্কে ডজন খানেক কিংবা তারও বেশি গ্রন্থ রচনা করেছেন। মহিউদ্দিন আহমদ অনেক মেহনত করে ইতিহাসের তথ্যসামগ্রী সংগ্রহ করেছেন। তার এ অব্যাহত সমসাময়িক ইতিহাস চর্চার সুবাদে তিনি ইতিহাসবিদ হিসাবে পরিচিতি পেয়েছেন, যদিও তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন অর্থনীতি। অনেকটা কাজী আবদুল ওদুদের মতো। কাজী আবদুল ওদুদ সম্পর্কে জনশ্রুতি ছিল তিনি পড়েছেন অর্থনীতি, পড়ান বাংলা সাহিত্য এবং আলোচনা করেন ধর্ম।

মহিউদ্দিন আহমদ এবারের স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষ্যে প্রথম আলোর উপসম্পাদকীয় পাতার জন্য একটি প্রবন্ধ লিখেছেন। এর শিরোনাম হলো, ‘আমাদের স্বাধীনতা দিবস’। তিনি লিখেছেন, ‘২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস কেন, এ নিয়ে তর্ক হতেই পারি। একটু পেছনে ফিরে যাওয়া যাক। ’৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর যখন পাকিস্তানি সৈন্যরা ঢাকায় ও অন্য স্থানে আত্মসমর্পণ করে, তখন আমরা মুক্তির স্বাদ পেতে শুরু করি। ওই দিন থেকে মানুষ নিজেদের স্বাধীন ভাবতে শুরু করে। পরে অবশ্য ১৬ ডিসেম্বরকে বিজয় দিবস হিসাবে ঘোষণা করা হয়।’ ২৬ মার্চ কেন আমাদের স্বাধীনতা দিবস, তা নিয়ে আমার একটি ব্যাখ্যা আছে। ১৯৪৭-এর ১৪ আগস্ট পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর ধীরে ধীরে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জনমনে পাকিস্তানের ঐক্য ও সংহতি সম্পর্কে অসন্তোষ দানা বাঁধতে থাকে। এর মূলে ছিল পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের বিমাতাসুলভ ব্যবহার। মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী পূর্ব পাকিস্তানের আইনসভায় বক্তৃতা করতে গিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন, ‘আমরা কি সেন্ট্রাল গভর্নমেন্টের গোলাম?’ বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রাম, বিশেষ করে ৬ দফা ও ১১ দফার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে পূর্ব বাংলার স্বাধীনতার দাবি জোরালো হতে থাকে। এর আগে ’৫২ সালের ভাষা আন্দোলন এবং ’৫৪-এর নির্বাচনে ২১ দফা কর্মসূচির ভিত্তিতে যুক্তফ্রন্টের বিজয় পূর্ব বাংলার স্বতন্ত্র অস্তিত্ব নির্মাণের পথ প্রশস্ত করে। ১৯৭০-এর নির্বাচনি রায় অনুযায়ী যখন সংখ্যাগরিষ্ঠ দল আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হলো না, তখন পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ বুঝে নিয়েছিল তাদের চলার পথ পশ্চিম পাকিস্তানিদের পথ থেকে আলাদা হয়ে গেছে। এ উপলব্ধি থেকেই সূচনা হয় গণবিদ্রোহের। পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী এ গণবিদ্রোহ দমনের জন্য ২৬ মার্চ মধ্যরাত থেকে (রাত ১১টা থেকে) শুরু করে ব্যাপক গণহত্যা। এ গণহত্যা এতই ভয়াবহ ছিল যে, এ থেকে রক্ষা পায়নি ছাত্র, যুবক, শ্রমজীবী মানুষ, অধ্যাপক ও আইনজীবীসহ সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ। যাদের মধ্যে ছিল অগণিত নারী ও শিশু। ঢাকা নগরীতে রক্তস্রোত বয়ে গিয়েছিল। ধারণা কর যায় গণহত্যার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত এদেশের কিছু সংখ্যক মানুষ পাকিস্তান টিকে থাকুক এমনটি হয়তো ভেবেছিলেন। কিন্তু গণহত্যার বীভৎসতা ও ভয়াবহতা লক্ষ করে অবশিষ্ট এ মানুষগুলোরও পাকিস্তান সম্পর্কে মোহমুক্তি ঘটে। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ভাবতে শুরু করে, ওদের সঙ্গে আর থাকা যায় না। এভাবেই পাকিস্তান তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানিদের মনে মৃত পাকিস্তানে পরিণত হয়। যে মুহূর্তে পাকিস্তানের সঙ্গে চূড়ান্ত মানসিক বিচ্ছেদ, তখন থেকেই জন্ম নিয়েছিল বাংলাদেশ। এ কারণেই ২৬ মার্চ আমাদের স্বাধীনতা দিবস।

মহিউদ্দিন আহমদ লিখেছেন, আমরা দেখেছি ৩ মার্চ অনুষ্ঠেয় গণপরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করা হলে জনতা ক্ষোভে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে, প্রকাশ্যে পাকিস্তানি পতাকা পোড়ায় এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করে দেয়। সাধারণ মানুষের কাছে ১ মার্চ থেকেই পাকিস্তান মৃত। পাকিস্তান সরকারের একতরফা ঘোষণার প্রতিবাদে সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালির নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অসহযোগ আন্দোলনের ঘোষণা দেন। ছাত্ররা ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কলা ভবন প্রাঙ্গণে স্বাধীন বাংলার পতাকা তোলে। ৩ মার্চ পল্টন ময়দানে এক জনসমাবেশে শেখ মুজিবের উপস্থিতিতে ছাত্ররা স্বাধীন বাংলার ইশতেহার পাঠ করে রবীন্দ্রনাথের ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’ গানটিকে জাতীয় সংগীত হিসাবে ঘোষণা দেয়। ৪ মার্চ শেখ মুজিবের আহ্বানে আঞ্চলিক সামরিক আইন প্রশাসক লে. জেনারেল সাহেবজাদা ইয়াকুব খান সেনাবাহিনীকে তখনকার মতো সেনানিবাসে ফিরিয়ে নিলে ঢাকার নিয়ন্ত্রণ চলে যায় শেখ মুজিবের হাতে। এখানে উল্লেখ করা যায়, সাহেবজাদা ইয়াকুব খান ছিলেন বহুভাষাবিদ। তিনি বাংলাও জানতেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে তিনি ছিলেন মুষ্টিমেয় উদারমনা ও সভ্য জেনারেলদের মধ্যে একজন।

ইতিহাসের রেকর্ড আরও স্পষ্ট করার জন্য রবীন্দ্রনাথের ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’ গানটিকে জাতীয় সংগীত হিসাবে ঘোষণা দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছিল ছাত্রলীগ। এ গানটি ৫০ ও ৬০-এর দশকে বামপন্থি ছাত্র সংগঠন ছাত্র ইউনিয়নের সাংস্কৃতিক প্লাটফর্ম সংস্কৃতি সংসদের অনুষ্ঠানে গাওয়া হতো। ধীরে ধীরে গানটি পূর্ব বাংলার ঋদ্ধজনের অন্তরে ঠাঁই করে নেয়। শুরুর দিকে ছাত্রলীগ এ গানটি গাওয়া পছন্দ করত না। কারণ তখন ছাত্রলীগ হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মতাদর্শের প্রতি নিষ্ঠাবান ছিল। তখনকার দিনে ছাত্রলীগ মনে করত এ গান পাকিস্তানের ঐক্য ও সংহতির পরিপন্থি। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ছিলেন গণতন্ত্রের মানসপুত্র। এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু তিনি ছিলেন পাকিস্তান রাষ্ট্রের সংহতির দৃঢ় প্রবক্তা। একপর্যায়ে তিনি মন্তব্য করেছিলেন, পাকিস্তান টিকে আছে তার এবং পিআইএ’র জন্য। শেখ মুজিবুর রহমান হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী যতদিন জীবিত ছিলেন, ততদিন তাকে মান্য করেছেন। তার কথার অবাধ্য হননি। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব বাংলার স্বাধিকারের প্রশ্নে সরব হয়ে ওঠেন। শেষ পর্যন্ত স্বায়ত্তশাসনের স্বরূপ স্পষ্টকরণ করতে তিনি ৬ দফা কর্মসূচি উত্থাপন করেন।

১৯৫৬ সালে ছাত্র ইউনিয়নের সাংস্কৃতিক মঞ্চ থেকে আমার সোনার বাংলা গানটি গাওয়া হলে ছাত্র ইউনিয়নের তৎকালীন সভাপতি আবদুস সাত্তার ছাত্রলীগের হামলার মুখে পড়েন। অথচ এ ছাত্রলীগই ষাটের দশকের শেষের দিকে এসে এ গানটির প্রতি অনুরক্ত হয়ে ওঠে। শুধু তাই নয়, এ গানের চেতনা ধারণ করে স্বাধীন সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠা করার মন্ত্রে দৃঢ়চিত্ত হয়ে ওঠে। ইতিহাস নানা চড়াই-উতরাইয়ের মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলে, এ ঘটনা তারই মূর্ত দৃষ্টান্ত। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস এই যে, বামপন্থি ছাত্র সংগঠন আমার সোনার বাংলা গানটি পরিবেশন করে বাংলা ভাষাভাষীদের স্বতন্ত্র পরিচয় নির্মাণ করতে চেয়েছিল, সময় উপস্থিত হলে সে কাজে নেতৃত্বের আসন তো দূরের কথা, তা থেকে অনেক দূরে ছিটকে পড়েছিল।

মহিউদ্দিন আহমদ একই নিবন্ধে আরও লিখেছেন, ‘আওয়ামী লীগ নেতা তাজউদ্দীন আহমদ ৩ এপ্রিল ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) সাহায্যে দিল্লি পৌঁছান। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে পরামর্শ করে তিনি গঠন করেন প্রবাসী সরকার। বিএসএফের মুখ্য আইন কর্মকর্তা কর্নেল এনএস বেইন্স বাংলাদেশের জন্য একটি ‘সংক্ষিপ্ত সংবিধানে’র খসড়া তৈরি করে দেন। এটি তাজউদ্দীন আহমদ ও তার সহকর্মীরা চূড়ান্ত করেন। এটিই ছিল স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র, যা ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলা গ্রামে বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিসভার শপথ অনুষ্ঠানে পাঠ করা হয়েছিল। ২৬ মার্চ বাংলাদেশ স্বাধীনতা ঘোষণা করে বলে এ ঘোষণাপত্রে উল্লেখ করা হয়।’ আমরা এতকাল জেনে এসেছি, এ ঘোষণাপত্র রচনায় গভীর রাতের সলতে পুড়িয়েছিলেন ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম। তিনি এখনো জীবিত আছেন এবং সজ্ঞানেই আছেন। শুনেছি তিনি এ ঘোষণাপত্র রচনা করেছিলেন আমেরিকার স্বাধীনতা ঘোষণার দলিলের আদলে। এখন মহিউদ্দিন আহমদ সাহেব জানাচ্ছেন, বিএসএফের মুখ্য আইন কর্মকর্তা কর্নেল এনএস বেইন্স বাংলাদেশের জন্য সংক্ষিপ্ত সংবিধানের খসড়া তৈরি করেছেন। প্রশ্ন হলো, এ দুই ধরনের তথ্যের মধ্যে কোনটি সত্য এবং সঠিক? মুক্তিযুদ্ধের এ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি নিয়ে যদি দুই ধরনের তথ্য থাকে, তাহলে বুঝতে হবে অনেক কিছু নিয়েই অমত-দ্বিমত থাকতে পারে। এ সমস্যা নিরসনের জন্য প্রয়োজন নিবেদিতচিত্তে বস্তুনিষ্ঠ গবেষণা চালিয়ে যাওয়া। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে শেষ কথা বলার যে সময় আসেনি, এ বিষয়টি তারই প্রকৃষ্ট প্রমাণ।

ড. মাহবুব উল্লাহ : শিক্ষাবিদ ও অর্থনীতিবিদ

প্রবাস বাংলা ভয়েস /ঢাকা/ ২৮ মার্চ ২০২৪ /এমএম