Menu

প্রবাস বাংলা ভয়েস ডেস্ক :: মাছ ও পোলট্রির দাম বাড়াটা খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেশি হারে বাড়ার প্রধানতম কারণ-বিআইডিএস প্রধানের এ বক্তব্য আগ্রহী সবার নজর কেড়েছে। আর এ বক্তব্য ধরে যুগান্তরে প্রকাশিত ড. আরএম দেবনাথের নিবন্ধটি নজর কেড়েছে আমার। সিনিয়র এ লেখকের নিবন্ধটি পড়ে অর্থশাস্ত্রের একজন ছাত্র হিসাবে মনে হলো, আমিও না হয় এ নিয়ে কিছু আলোকপাতের চেষ্টা করি। প্রথাগত কাঁচাবাজারে যাতায়াতকারী হিসাবেও এ বিষয়ে কিছু পর্যবেক্ষণ আছে আমার। মাছ উৎপাদন, বাজারজাতকরণ, আমদানি-রপ্তানি ও দামের বিষয়ে যেসব প্রতিবেদন এসে থাকে, সেগুলো কমবেশি খেয়াল করি বলেও ইচ্ছা হয় এ নিয়ে কিছু বলার। সন্দেহ নেই, ড. দেবনাথের লেখাটি সেটা উসকে দিয়েছে।

সাম্প্রতিক বছরগুলোয় দেশে মাছের উৎপাদন যে অনেক বেড়েছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিছু মাছ রপ্তানিও হচ্ছে। চাহিদা পরিপূরণ করেই যে আমরা রপ্তানি করছি, এমন নয়। কিছু মাছ তো আমদানিও হচ্ছে। এর অর্থ এ-ও নয় যে, মাছে স্বয়ংসম্পূর্ণ হইনি বলেই আমদানি করতে হচ্ছে। এখানে দামের প্রশ্ন রয়েছে। মিয়ানমার আর ভারতের খামারে উৎপাদিত মাছও আমদানি হয়ে আসছে এখানে। সেগুলো হয়তো ‘দেশে উৎপাদিত’ বলেই বিক্রি হচ্ছে। বিক্রেতাই কেবল জানে কোত্থেকে কী হচ্ছে। আর জানে সতর্ক ক্রেতা। অনেক ক্রেতাই কিন্তু এ সংক্রান্ত হালনাগাদ তথ্যগুলো জানে না। কোরাল বলতেই তারা মনে করে নদী বা সাগরের কোরাল। শোল আর শিংও যে চাষ হচ্ছে, সেটা অনেকেই জানে না। ‘বিলুপ্তপ্রায়’ কিছু ছোট মাছও আজকাল চাষ হচ্ছে। মৎস্যবিজ্ঞানীরা এ জায়গাটায় বড় ভূমিকা রেখে চলেছেন। তাদের উদ্ভাবনগুলো দ্রুত ছড়াচ্ছে দেশের মাছচাষিদের মধ্যে। বিজ্ঞানসম্মতভাবে চাষ করে অনেকেই সুফল পাচ্ছে। না বুঝে বিনিয়োগ করে লোকসানের মুখেও পড়ছে অনেকে।

এমনটা ভারতেও ঘটছে নিশ্চয়। মাছ উৎপাদনে তারা অবশ্য আমাদের চেয়ে এগিয়ে। এগিয়ে আছে চীনও। তবে চীন থেকে আমরা বিপুলভাবে পণ্য আমদানি করলেও মাছ বোধহয় আনছি না এখনো। এমন খবর বরং রয়েছে, তারা আমাদের মাছ নিয়ে ‘প্রসেস’ করে রপ্তানি করছে পশ্চিমে। এ-ও বলতে হয়, তাদের কাছ থেকে আমরা শিখতে শুরু করেছিলাম কার্পজাতীয় মাছ চাষ। তবে সাম্প্রতিককালে বেশি উৎপাদন করছি পাঙাশ, তেলাপিয়া। এগুলোর ওপর নির্ভরতাও বেড়েছে নিম্ন-আয়ের মানুষের। নদীনালা, খালবিলসহ মুক্ত জলাশয়ের মাছ কেনা তাদের পক্ষে প্রায় অসম্ভব। নদীর ইলিশ তো তাদের জন্য আরও আগেই হয়ে উঠেছে ‘দুষ্প্রাপ্য’-যদিও এর উৎপাদন বিপুলভাবে বাড়ার খবর তারাও পড়ে থাকে। ড. দেবনাথ স্মরণ করেছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রাবাসে হররোজ ইলিশের কারি খেতে দেওয়ায় তারা বিরক্ত হতেন। সরকার অবশ্য ইলিশ রপ্তানি বন্ধ রেখেছে দেশে এটাকে সহজলভ্য করতে। কিন্তু সে লক্ষ্য অর্জিত হচ্ছে না। ইলিশের ভরা মৌসুম সামনে। এটা এবার কেমন ধরা পড়বে এবং দামে কী প্রভাব পড়বে, বলা যাচ্ছে না। আগে ইলিশের মৌসুমে অন্যান্য মাছের চাহিদা ও দাম যেত পড়ে। সেটা এখন আর ঘটছে না ইলিশ বিশেষভাবে আকর্ষণীয় পণ্য হয়ে উঠেছে বলে। এ বিষয়ে আলাদা করেই লেখা যায়। হয়তো লিখবও। আপাতত শুধু বলি-পাঙাশ, তেলাপিয়া, কই ইত্যাদির দাম উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়ায় বিপুলসংখ্যক মানুষ আমিষের সহজলভ্য উৎসটাও হারাচ্ছে। এমনকি গ্রামে এ চিত্র খুঁজে পেয়েছে বিআইডিএস।

‘সস্তা’ চাষের মাছের দামও কেন বাড়ছে, সেটা খতিয়ে দেখা অবশ্য প্রয়োজন। পোলট্রির দামও একই সঙ্গে বেড়েছে। এমনকি রমজানের পর এগুলোর দাম বাড়ছে নতুন করে। রমজানের পর সয়াবিন তেলেরও দাম বেড়েছে। এক্ষেত্রে কারণ ছিল ভ্যাট ছাড়ের সময়সীমা শেষ হওয়াটা। তবে চাষের মাছ ও মুরগির দাম বৃদ্ধিতে সম্ভবত ভূমিকা রেখেছে ফিডের দাম বাড়ার ঘটনা। তারপর আবার এপ্রিলজুড়ে নজিরবিহীন তাপপ্রবাহে দুই খাতই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ‘সোনালি’ মুরগির খামারও ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় দাম বেড়েছে লাফিয়ে। এটা তো পিকনিক আর বিয়েশাদির সিজন নয় যে, চাহিদা অনেক বেড়েছে। একই সময়ে খামারের ডিমের দামও দিয়েছে লম্ফ! যা হোক, মাছের কথা হচ্ছিল। টানা তাপপ্রবাহ এবং তার মধ্যে আবার লোডশেডিংয়ে এর পোনা উৎপাদন হচ্ছিল ক্ষতিগ্রস্ত। অগভীর জলে বিচরণশীল মাছগুলোও ভেসে উঠছিল মরে। পোনা কিনে খামারে নিয়ে যাওয়ার প্রবণতা স্বভাবতই কমে গিয়েছিল তখন। এরও কিছু প্রভাব কি নেই মাছের বাজারে? ড. দেবনাথ বলেছেন, তরুণদের অনেকে মাছ খেতে চায় না আজকাল। একটা বিশেষ শ্রেণিতে এ প্রবণতা বেড়েছে বৈকি। তবে চাষের সস্তা মাছ কিনতে না পারা তরুণও কম নেই দেশে। তাদের মধ্যে হালে আরও বেড়েছে বেকারত্ব। এদিকে বিনিয়োগ পরিস্থিতি ভালো হবে বলেও মনে হচ্ছে না ঋণের সুদের হার আর ডলারের দাম বাড়তে থাকার সময়টায়। শেয়ারবাজারও হুড়মুড় করে নামছে। এসবের মধ্যে মূল্যস্ফীতিই কেবল ঊর্ধ্বমুখী মনে হয়!

মুক্ত জলাশয়ের মাছ কেনার কথা সাধারণ মানুষ ভাবতেও পারে না-এটা খুব সঠিকভাবে বলেছেন ড. দেবনাথ। খামারের কোরাল আর শোল মাছের দামও কিন্তু অত্যধিক। কোরালের উচ্চ দামের কারণটা বাজারে দাঁড়িয়ে একজন ক্রেতা বুঝিয়ে বলেছিলেন আমাকে। ‘বারবিকিউ’ আর চীনা রেস্তোরাঁয় ব্যাপকভাবে ব্যবহারের কারণেই নাকি এর দাম বেড়ে চলেছে। সঙ্গে এ কারণটাও বোধহয় আছে যে, কোরালকে অনেক খেতে দিতে হয়। শোল-গজারকেও। ভারত থেকে আসা আইর, বোয়াল, চিতলের দামও কম নয় সম্ভবত এ কারণে। তবে দেশে উৎপাদিত এসব মাছের দাম পড়ে আরও বেশি। আমদানি হয়ে না এলে এগুলোর দাম বোধহয় আরও বাড়ত। হালে পাঙাশ, তেলাপিয়া, কই, শিঙের দাম যেভাবে বাড়ছে, তাতে প্রশ্ন উঠতে পারে-এগুলোও কি আমদানি হতে শুরু করবে? তেলাপিয়া উৎপাদনে আমাদের সাফল্য বিরাট। কিন্তু প্রতিযোগিতামূলক দাম ধরে রাখা না গেলে মুক্তবাজারে সুবিধা করা কঠিন। মাছ তো আর আমদানি-নিষিদ্ধ পণ্য নয়। হয়তো এর ওপর উচ্চহারে শুল্ক আরোপ করা যেতে পারে। সেটা আরোপিত আছেও। তারপরও আমদানি হয়ে আসা কিছু মাছ বিক্রি হচ্ছে অপেক্ষাকৃত কম দামে। ‘কাচকি’ও নাকি আসছে। এক দোকানি বলছিলেন, ‘নাইলে সাগরের ভেজাল কাচকিই খাইতে হইতো!’

ড. দেবনাথ সংগত কারণেই মাছের উৎপাদন সংক্রান্ত তথ্য-উপাত্ত নিয়ে ইঙ্গিতে প্রশ্ন তুলেছেন। প্রশ্ন তো আরও অনেক ক্ষেত্রেই রয়েছে। গেল বছর আলুর উৎপাদন বিষয়ে ব্যবসায়ীদের বক্তব্যই কিন্তু শেষতক সত্য প্রমাণ হয়। তাতে দীর্ঘদিন পর আলু আমদানিতে যেতে হয়েছিল সরকারকে। এবার আলুর দাম আরও চড়া। খেতেই আলু বিক্রি হয়েছে বেশি দামে। অর্থাৎ ব্যাপারীরা বেশি দামে কিনতে রাজি হয়েছে। তারা ভালো বোঝে বাজারের গতিপ্রকৃতি। যারা নানারকম মাছ আমদানি করছে এত উৎপাদনের মধ্যেও, তারাও কম বোঝে না। এসব মাছ অবিক্রীত থাকছে বলেও খবর নেই। তবে ভারত থেকে বেশি দামে পেঁয়াজ এনে হালে কিছু ব্যবসায়ী পড়েছে বিপাকে। দেশে উৎপাদিত পেঁয়াজের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে তারা বেচতে পারছে না। যা হোক, কিছু মাছ কি চোরাচালান হয়েও আসছে না? আমাদের কিছু ইলিশ নাকি বিনা শুল্কে নৌপথে চলে যাচ্ছে মিয়ানমার ও ভারতে। সেখান থেকে রপ্তানি হচ্ছে পশ্চিমে ও মধ্যপ্রাচ্যে। বিক্রি হচ্ছে ‘পদ্মার ইলিশ’ বলে। ব্যবসাটা অন্যদের হলেও তাতে আমাদের ব্র্যান্ডিং হচ্ছে অবশ্য। কোয়ালিটি ইলিশ কিন্তু দেশের অন্যান্য নদীতেও মিলছে। মিললে কী হবে, গাদা গাদা ইলিশ জমা হচ্ছে বিত্তবানদের ডিপ ফ্রিজে। উচ্চ মূল্যস্ফীতিও নাগাল পাচ্ছে না তাদের। আয়কর বিভাগও না!

ইলিশ বাদে সাগর থেকে অন্যান্য মাছ আহরণও কম হচ্ছে না। লোকে এসব মাছ খেতে অভ্যস্তও হয়ে উঠেছে। এরও একাংশ আসছে ভারত, মিয়ানমার, এমনকি মধ্যপ্রাচ্য থেকে। বিশেষ শ্রেণির মানুষের ভোগের জন্য অত্যধিক দামি কিছু মাছও আনা হচ্ছে। গরিবের জন্যও আসছে কমদামি সামুদ্রিক মাছ। বঙ্গোপসাগরে নিজ জলসীমা বুঝে পেলেও আমরা তো এর সদ্ব্যবহার করতে পারছি না। সম্ভাব্য তেল-গ্যাস উত্তোলন থেকে মৎস্যসম্পদ আহরণ পর্যন্ত এটা বিস্তৃত। মাছ অবশ্য আহরণ করতে হয় এর প্রজনন ও উৎপাদন প্রক্রিয়া ধরে রেখে। সেটা হচ্ছে না বলে লাক্ষ্যা, কোরাল, রূপচাঁদার মতো আকর্ষণীয় মাছ নাকি হয়ে উঠছে দুষ্প্রাপ্য। ভয়ানকভাবে দূষিত নদীর পানিতে সাগরও দূষিত হয়ে পড়ার খবর রয়েছে। আলাদা করেও দূষিত হচ্ছে সাগরের অর্থনৈতিক অঞ্চল। এর গভীরে নৌযান নিয়ে যাওয়ার খরচও অনেক বেড়েছে ডিজেলের দাম বাড়ায়। সম্প্রতি বিষাক্ত জেলিফিশ বেশি করে ধরা পড়ায় জেলেরা আরও নিরুৎসাহিত বলে খবর মিলল। বিশেষজ্ঞরাই বলতে পারবেন, এটা আমাদের সমুদ্রসীমায় বড় পরিবেশগত বিপর্যয়ের ফল কিনা!

যে কারণেই হোক, সাগর থেকে মাছ আহরণ কমে গেলে তারও প্রভাব পড়বে গরিবের মাছ পরিভোগে। লইট্টা, ছুরি আর সার্ডিনের মতো মাছ কিন্তু এখনো সস্তা। লইট্টা আর ছুরি শুঁটকি তো এর বাজারটাও আগলে রেখেছে। তবে সাম্প্রতিককালে শুঁটকিও আমদানি হয়ে আসছে বিপুলভাবে। আর কমছে আমাদের রপ্তানি। কাঁচা মাছের মধ্যে চিংড়ি রপ্তানিও ক্রমহ্রাসমান বলা যায়। এখানেও প্রতিযোগিতায় মার খাচ্ছি ভারত ও চীনের কাছে। অথচ একদা চিংড়ি ছিল আমাদের দ্বিতীয় শীর্ষ রপ্তানিপণ্য। এর উৎপাদনেও উৎসাহ কমছে স্বভাবতই। তাই দেশীয় বাজারেও চিংড়ি এখন আরেক বিলাসদ্রব্য। নদী থেকে আহরিত ছোট চিংড়ির গায়েও হাত দেওয়া যাচ্ছে না।

সবশেষে বলা যায়, মাছ উৎপাদন অনেক বাড়িয়েও একটা সংকটে আমরা পড়েছি। এত দূষণ, দখল আর অপব্যবহারের পরও মুক্ত জলাশয়ের মাছ উৎপাদনও নাকি বেড়েছে অনেক। তবে বিত্তবানদের মধ্যে এর চাহিদা সম্ভবত বেড়েছে আরও বেশি। তাছাড়া নদনদী থেকেও মাছ আহরণ ব্যয় বেড়েছে। শ্রম খরচও বেড়েছে বোধহয়। আর মাছেও পরিবহণ ব্যয় বেশি। হাতবদল বেশি। মুনাফার প্রবণতাও সব ক্ষেত্রেই বেশি। এ অবস্থায় শাকসবজির দামটা সহনীয় থাকলেও নিম্ন-আয়ের মানুষ কিছুটা ক্ষতিপূরণ করে চলতে পারত। ড. দেবনাথ পুষ্টি ও মেধার বিকাশ নিয়ে চিন্তিত হয়েছেন স্বভাবতই। মাংস, ডিম, দুধ, মাছ খেতে না পারা মানুষ কি শিক্ষা আর চিকিৎসা খাতেও ব্যয় কমাচ্ছে না? এ অবস্থায় চাল, আটা ও আলুর বাজার নতুন করে অশান্ত হলে দুর্গতির শেষ থাকবে না তাদের। এক্ষেত্রে ভোজ্যতেল, পেঁয়াজ আর চিনির দামও গুরুত্বপূর্ণ। সামগ্রিকভাবে মূল্যস্ফীতি আরও বাড়ার শঙ্কাতেই আছে দেশ। এ অবস্থায় ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীকে কিছুটা হলেও সুরক্ষা জোগানোর সুযোগ রয়েছে আসছে বাজেটে। এ পর্যন্ত প্রাপ্ত খবরে তেমন প্রচেষ্টা গ্রহণের বার্তা কি মিলছে?

হাসান মামুন : সাংবাদিক, বিশ্লেষক

প্রবাস বাংলা ভয়েস /ঢাকা/ ২৯ মে ২০২৪ /এমএম