Menu

প্রবাস বাংলা ভয়েস ডেস্ক ::‌ ঝিনাইদহের মহেশপুর উপজেলার একতারপুর গ্রামের সনু বিশ্বাস মারা যান গত ২৮ জুন রাতে। এর পাঁচ দিন পর ৩ জুলাই একই উপসর্গ নিয়ে মারা যান তার ভাইয়ের স্ত্রী আনোয়ারা বেগম এবং মেয়ে রাবেয়া। মৃত্যুর এই মিছিলে পরদিন ৪ জুলাই যুক্ত হন সনুর আরেক ভাই আব্দার হোসেন।ভারতের সীমান্তবর্তী এই উপজেলার রুরাল ডেভেলপমেন্ট সেন্টারের প্রধান নির্বাহী আব্দুর রহমান এসব তথ্য জানিয়ে বললেন, ‘মারা যাওয়া ওই চারজনেরই সর্দি-জ্বরের মতো উপসর্গ ছিল।’

তার ভাষ্যমতে, মহেশপুরের গ্রামগুলোতে ঘরে ঘরে মানুষ জ্বরে ভুগছেন। বাড়িতে বসেই সাধারণ জ্বরের চিকিৎসা নিচ্ছেন তারা। শুধু শ্বাসকষ্টের মতো সমস্যা হলে চিকিৎসকের কাছে যাচ্ছেন। তাদের প্রতিষ্ঠানের হিসেবে কোভিডের উপসর্গ নিয়ে মহেশপুরে ১৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। সরকারি হিসেবে উপজেলায় কোভিড শনাক্ত হওয়া আরো ১০ জন মারা গেছেন।

আব্দুর রহমান বলেন, এই এলাকার অনেক মানুষই গত দুই মাসে ভারত থেকে ফিরেছেন। তাদের অনেকের পরীক্ষায় কোভিড ধরাও পড়ে। এরপর থেকে গ্রামগুলোতে জ্বরের প্রকোপ শুরু হয়। মূলত করোনার ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট সবচেয়ে বেশি আঘাত হেনেছে গ্রামেগঞ্জে।

আর তা খুব কম সময়ে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে। যার ফলে শহরের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে গ্রামেও বাড়ছে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা। গ্রামের মানুষরা উপসর্গ নিয়েই মারা যাচ্ছেন বেশি। সর্বশেষ গতকাল বৃহস্পতিবার করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে ১৯৯ জন। এর বাইরে করোনার উপসর্গ নিয়ে মারা গেছেন আরো ২ শতাধিক।

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অসচেতনতার কারণেই গ্রামের মানুষ বেশি মারা যাচ্ছেন। তারা করোনার অন্যতম উপসর্গ জ্বর-সর্দি ও কাশিকে সিজনাল রোগ বা সাধারণ রোগ মনে করে কোনো পাত্তা দেন না। উগসর্গ দেখা দেয়ার পর অনেকে সুযোগ পেয়েও নমুনা পরীক্ষা করান না আবার অনেকে নমুনা পরীক্ষা করার সুযোগও পান না। আবার কেউ কেউ অবস্থা জটিল হওয়ার আগ পর্যন্ত আসতে চান না হাসপাতালে। এসব বিষয়ে সচেতন না হলে গ্রামেগ্রঞ্জে মৃত্যুর সংখ্যা কমিয়ে আনা যাবে না বলে মনে করছেন তারা।

খোদ স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক ডা. এবিএম খুরশীদ আলম বলেন, গ্রামের মানুষের মধ্যে সচেতনতার অভাব রয়েছে। পরিস্থিতি জটিল হওয়ার পর তারা চিকিৎসকের কাছে আসছে। তাদের অনেকেরই অক্সিজেন স্যাচুরেশন ৫০ শতাংশের নিচে থাকছে। মস্তিষ্কে অক্সিজেন স্যাচুরেশন বেশি সময় ধরে যদি কম থাকে তাহলে ‘ব্রেন ডেথ’ হয়ে যায়। এমন সময় যারা চিকিৎসা নিতে আসছে তাদের সামাল দেয়া কঠিন হচ্ছে।

খুরশীদ আলম বলেন, গ্রামের লোকদের বিশ্বাস, তাদের করোনা হয় না। তারা সর্দি কাশিকে এক রকম উপেক্ষা করেন। কিন্তু তারা এমন সময় চিকিৎসা নিতে আসছে যখন তাদের সামাল দেয়া কঠিন হচ্ছে। তাদের বাঁচানোও কঠিন হচ্ছে।

করোনা সংক্রমণ রোধে স্বাস্থ্য অধিদফতরের প্রস্তুতি কী? -এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সংক্রমণ প্রতিরোধে আমাদের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। তবে প্রস্তুতিরও সীমাবদ্ধতা রয়েছে, এটা আমাদের মানতে হবে। কারণ রোগী যদি আমরা না কমাতে পারি, যতই প্রস্তুত থাকুন না কেন ১৬ কোটি মানুষের দেশে আমরা কত বিছানা দেব?

বিছানা দিয়েও সামাল দেয়া যাবে না। আপনারা দেখছেন কঠোর লকডাউনের মধ্যে মানুষ কীভাবে বের হচ্ছে। লোকজন স্বাস্থ্যবিধি মানছে না। এমন হতে থাকলে পরিস্থিতি খারাপ হবে। ঢাকার হাসপাতালগুলোর অবস্থা গ্রাম থেকে অনেক ভালো আছে। উপজেলা হাসপাতালগুলোতে আমরা শয্যা বাড়ানোর চেষ্টা করছি। অক্সিজেন সরবরাহ ঠিক রাখার চেষ্টা করছি।

একই কথা বলছেন করোনার চিকিৎসার সঙ্গে জড়িত চিকিৎসকরা। সিলেট ওইমেন্স মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মেডিক্যাল অফিসার ডা. ফাতেমা রউফ সুস্মিতা বলেন, আমাদের হাসপাতালের এখন গ্রামের রোগীরাই বেশি আসছেন। তবে তারা সংকটাপন্ন অবস্থায় আসছেন। যার ফলে সর্বোচ্চ চিকিৎসা দিয়েও অনেককে বাঁচানো সম্ভব হচ্ছে না।

বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) মহাসচিব ডা. এহতেশামুল হক চৌধুরী দুলাল বলেন, গ্রামাঞ্চলে করোনায় সংক্রমিত রোগী বেশি। রাজধানীসহ শহর এলাকায় কম সংক্রমিত হচ্ছে। করোনা নিয়ন্ত্রণ করতে হলে জনপ্রতিনিধিদের সম্পৃক্ত করে গ্রামাঞ্চলে লকডাউন বাস্তবায়ন করতে হবে। একইসঙ্গে গ্রামে ফিল্ড হাসপাতাল তৈরি করতে হবে। এক্ষেত্রে জরুরি ভিত্তিতে বেকার ডাক্তার-নার্সদের নিয়োগ দেয়া উচিত। নইলে সামনে ভয়াবহ বিপদের আশঙ্কা।

এদিকে যশোর সদর হাসপাতালে শয্যা খালি না থাকায় বারান্দায় ভ্যানের ওপর কোভিড রোগীদের চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে, যাদের বেশিরভাগই প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে আসছেন। চাপ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন স্বাস্থ্য-কর্মীরা। প্রতিদিন মৃত্যু ও শনাক্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে বলে খবর মিলছে।

যশোর সদর হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক আখতারুজ্জামান বলেন, গ্রামাঞ্চলের কোভিড রোগীর সংখ্যা এখন বেশি। আর তারা এমন অবস্থায় হাসপাতালে আসছেন যে, সঙ্গে সঙ্গে অক্সিজেন দিতে হচ্ছে। রোগীর সংখ্যা এমন বৃদ্ধি পেতে থাকলে অক্সিজেন সংকট তৈরি হবে।

সীমান্তবর্তী আরেক জেলা বাগেরহাটে জ্বর নিয়ে মৃত্যুর সংখ্যা বৃদ্ধি মানুষের মধ্যে ভয় তৈরি করেছে। জেলা সিভিল সার্জন কেএম হুমায়ুন কবীর বলেন, গত ৬ জুন থেকে ৬ জুলাইয়ের মধ্যে জেলায় করোনা আক্রান্ত হয়ে ৪৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। মহামারীর প্রথম ঢেউয়ের চেয়ে দ্বিতীয় ঢেউয়ে মৃত্যু বেড়েছে তিনগুণ।

জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আজিজুর রহমান বলেন, গত ৩০ মে থেকে বাগেরহাটে সংক্রমণ বাড়ছে। মোংলা দিয়ে শুরু হয়েছে সংক্রমণ। সেখানে সংক্রমণের হার ৭৩ শতাংশ পর্যন্ত উঠেছিল। এখন করোনার উপসর্গ সর্দি-জ্বর-কাশি জেলার গ্রামের ঘরে ঘরে। মানুষ পরীক্ষা করছে না, ভয় পাচ্ছে। একঘরে হয়ে যাওয়ার ভয় রয়েছে।

উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোতেও ঘরে ঘরে জ্বর ছড়িয়েছে। ঠাকুরগাঁও সদর হাসপাতালের চিকিৎসক হাবিব এ রসুল লিটন বলেন, সেই জুনে জ্বরের রোগীর যে স্রোত শুরু হয়েছিল তা এখনো চলছে। যেই গ্রামে একবার জ্বরের প্রকোপ শুরু হয়েছে, সেখানে ঘরে ঘরে ছড়িয়ে তারপর থামছে।

সাধারণভাবে ধারণা করা যায়, আক্রান্তদের মধ্যে খুব বেশি হলে ৫ শতাংশের মধ্যে রোগটা জটিল আকার ধারণ করছে। বিশেষ করে যারা বয়স্ক ও যাদের অন্যান্য শারীরিক জটিলতা রয়েছে। তবে সম্প্রতি জেলায় তিনজন যুবা করোনা আক্রান্ত হয়ে বা উপসর্গ নিয়ে মারা গেছেন।

পাশের জেলা পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জ উপজেলার ভাউলাগঞ্জ বাজারে প্রায় ৩০ বছর ধরে চিকিৎসা কেন্দ্র এবং ওষুধের দোকান চালিয়ে আসছেন পল্লী চিকিৎসক নূর ইসলাম। তিনি বলেন, জ্বর বেড়েছে এটা সত্য। তবে প্রতিবছর গরম পড়ার পর গ্রামে জ্বরের প্রকোপ দেখা দেয়। সাধারণ মানের কিছু ওষুধেই তা সেরে যায়। এবারো সাধারণ ওষুধেই জ্বর সারছে। এই ওষুধের বিক্রিও বেড়েছে।

প্রবাস বাংলা ভয়েস/ঢাকা/ ০৯  জুলাই ২০২১ /এমএম


এই বিভাগের আরও সংবাদ