Menu

মাঠের ঘাসের গন্ধ বুকে তার

বাংলানিউজসিএ ডেস্ক :: ভালোবাসার শক্তি কতটা, তা নিয়ে আমার কোনো সংশয় নেই। এর অজস্র প্রমাণ চারপাশে ছড়িয়ে আছে; কিন্তু সবচেয়ে কাছের জিনিসগুলো আমরা সহজে দেখতে পাই না। নিজের কাজটাকে ভালোবাসলে কী অসামান্য ফল পাওয়া যায়, তার একটা বড় উদাহরণ তৈরি করেছেন শাইখ সিরাজ। আমাদের প্রিয় সিরাজ ভাই।

কাজটাকে ভালোবাসেন বলেই হয়তো এত পরিশ্রম করতে পেরেছেন বছরের পর বছর। আজ গণমাধ্যমের নবীন-প্রবীণ অনেক কর্মীই সুযোগ পেলে হৃদয়ে মাটি ও মানুষ অনুষ্ঠানটির সঙ্গে যুক্ত হতে চাইবেন। কিন্তু আজ থেকে তিরিশ-পঁয়ত্রিশ বছর আগে কাউকে পছন্দের অনুষ্ঠান বেছে নিতে বললে তারা কি এরকম একটা উন্নয়নমূলক কঠিন পরিশ্রমের অনুষ্ঠান বেছে নিতেন?

যতদূর মনে পড়ে, শিল্পায়নে বাংলাদেশ আর আমার দেশ নামের দুটো অনুষ্ঠান দিয়েই শাইখ সিরাজের উপস্থাপক জীবনের শুরু। বিটিভির উন্নয়নমূলক অনুষ্ঠানগুলো দর্শক পাবে কী করে! প্রযোজক বা বিটিভির অন্য কেউই সেগুলোকে কোনো গুরুত্ব দিতেন বলে মনে হয় না।

প্রথমদিকে কর্তাব্যক্তিরাও ভাবেননি, এসব অনুষ্ঠান দেখার জন্য মধ্যবিত্ত নাগরিক পরিবারের দর্শকের কোনো আগ্রহ থাকতে পারে। সুতরাং অল্প বাজেটে যেনতেনভাবে কাজ সেরে ফেলাটাই যথেষ্ট। তাই যখন ওসব অনুষ্ঠান দেখানো হয়, তখন বাড়ির ছোট-বড় সবাই যার যার কাজকর্ম সারেন। লেখাপড়া, খাওয়া-দাওয়া অথবা অন্যসব কাজের জন্য সেটাই আদর্শ সময়।

কারণ, তার পরই শুরু হবে কোনো বিখ্যাত উপস্থাপকের বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান অথবা ছায়াছবি। বিপুল আয়োজনে এবং যত্নে নির্মিত, বহু তারকাখচিত সেসব অনুষ্ঠান। অন্যদিকে উন্নয়নমূলক অনুষ্ঠানগুলো অনেকটা সরকারি প্রচারণার মতো অতিরঞ্জিত; কিন্তু অনাকর্ষণীয় রয়ে যায়। যেন এটাই স্বাভাবিক। দু-একজন আগ্রহী প্রযোজক আর শাইখ সিরাজের মিলিত চেষ্টায় পরিস্থিতি অল্পদিনে পুরোটাই বদলে গেল।

স্বাধীনতা-পরবর্তী দুই দশকে বাংলাদেশে উপস্থাপক হিসেবে তারকা পরিচিতি ছিল দুই প্রজন্ম মিলিয়ে মাত্র তিন-চারজন মানুষের। আমি আর আমার বন্ধুরা কেউ কেউ সেসব অনুষ্ঠানে কাজ করেছি বিভিন্ন ভূমিকায়। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যারের কোনো কোনো অতি জনপ্রিয় অনুষ্ঠানে প্রতি সপ্তাহে অংশ নিয়েছি। তার মজাই আলাদা।

এ সময়ে নতুন প্রযোজক আলী ইমাম ভাই অন্য কিছু কিছু অনুষ্ঠানের জন্য আমাদের ডেকে নেন। অন্যান্য তরুণ প্রযোজকও এ ধরনের অনুষ্ঠান করতেন। তাদের হাত ধরেই উন্নয়নধর্মী অনুষ্ঠানে শাইখ সিরাজের যাত্রা শুরু হল।

সে সময় আমরা কেউ কল্পনাও করিনি, টিভির দর্শকরা সেগুলো আগ্রহ নিয়ে দেখবেন; আর তার উপস্থাপক এমন ব্যাপক পরিচিতি ও জনপ্রিয়তা অর্জন করবেন। সেই অসম্ভব কাজটিই করে দেখালেন শাইখ সিরাজ।

এমনিতেই শাইখ সিরাজ কর্মনিষ্ঠ মানুষ। ছোট-বড় যে কোনো কাজ তিনি করেন মন দিয়ে। কিন্তু তারচেয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে স্বপ্ন। তার স্বপ্ন অনেক বড়। সেই স্বপ্ন-কল্পনাকে বাস্তবে রূপ দেয়ার জন্য অসম্ভব পরিশ্রম করেছেন শুরু থেকেই। সত্তর দশকের শেষদিকে আমরা দশ-বারোজন বন্ধু এক সঙ্গে বেড়ে উঠেছি।

আমাদের পড়ালেখার বিষয় আলাদা। কিন্তু কিছু লেখালেখি আর সার্বক্ষণিক আড্ডার আকর্ষণে আমরা দিনের অনেকখানি সময় কাটাই সাগরের খাবার-দাবার রেস্তোরাঁয় অথবা পুরানা পল্টনের একটা ছোট বিজ্ঞাপনী সংস্থার অফিসে। ফার্মেসি বিভাগে পড়ার সময় অরিয়ল নামের এই বিজ্ঞাপনী সংস্থায় আমি প্রায় ফুলটাইম কাজ করি। সারা দিন যার যার কাজে অন্য কোথাও যাই, কিন্তু তারপর বন্ধুদের খোঁজ করতে হলে আবার ফিরে আসি এখানে অথবা খাবার-দাবারে।

ফরিদুর রেজা সাগরের রেস্তোরাঁয় সাগরকে কিন্তু সবসময় পাওয়া যায় না। কারণ সে ব্যস্ত থাকে রামপুরার নতুন টিভি ভবনে, নতুন কুঁড়ি অনুষ্ঠানের নানা কাজে। খাবার-দাবারে বেশিরভাগ সময় থাকেন শাইখ সিরাজ। আসা-যাওয়ার মধ্যে থাকি আমরা। আমি, ইমদাদুল হক মিলন, আফজাল হোসেন, সিরাজুল ইসলাম, আবদুর রহমান, হিরু, পাভেল, আরেফিন, মুক্তাদির ও জুবায়ের।

সেখানকার ছোট্ট ঘরে কী নিয়ে আড্ডা চলত, তার তালিকা তৈরি করা কঠিন। তবে লোকজন কম থাকলে সেখানে বসে আমরা অনেকেই নিজেদের কাজ করি। বিচিত্রা, সচিত্র সন্ধানী, রোববার, কিশোর বাংলা ইত্যাদি পত্রিকার জন্য আমরা যার যার লেখাগুলো অনেক সময় লিখে ফেলি ওখানে বসেই।

শাইখ সিরাজ কিছু লেখালেখি করতেন রোববার পত্রিকার জন্য। এর বাইরে সাহিত্য বিষয়ে তার আগ্রহ কম। লেখালেখি আর সাহিত্যের আলোচনায় আমাদের উত্তেজনা দেখে তিনি মজা পান। আমাদের কোনো কোনো আলোচনা ও তর্ক তার কাছে অদরকারি মনে হয়।

তার স্বপ্ন আছে, পরিকল্পনা আছে; কিন্তু কোনো বুদ্ধিজীবী ধরনের ভাব নেই। তখন থেকেই তার আগ্রহ আর আকাক্সক্ষার ক্ষেত্রটি আলাদা। আমাদের দু-একজন বন্ধু তখন মঞ্চ ও টেলিভিশনে তুমুল জনপ্রিয়। অভিনয় আর উপস্থাপনায় তাদের প্রতিভা ও সাফল্য আমাদের আনন্দিত করে। কিন্তু তাদের প্রতি অজস্র ভক্তের আকুল মুগ্ধতা দেখে অন্যরা একটু মনোবেদনা বোধ করে।

আমাদের কোনো ভক্ত নেই; তবু লিখি। পত্রিকার লেখায়, মঞ্চে ও টিভিতে আমাদের বন্ধুরা ক্রমেই উজ্জ্বলতর হয়ে উঠছে। এরা প্রত্যেকেই সেই ক্ষেত্রটিতে কাজ করেছে, যা তারা ভালোবাসে। তাই নিজের কাজের সঙ্গে সবার প্রাণের সংযোগ।

এমন একটা সময়ে শাইখ সিরাজ তার পছন্দের অনুষ্ঠান হিসেবে বেছে নিলেন কৃষি। ধান-পাট, আলু-পেঁয়াজ, রবিশস্য, ফলমূলের চাষাবাদ, মাটি, বীজ, সার, কীটনাশক ইত্যাদির মতো গদ্যময় বিষয়। সেই সঙ্গে গ্রাম জনপদের কৃষকের নিত্যদিনের কথাবার্তা, হাসি-আলোচনা, বঞ্চনা ও বেদনার চিত্র।

প্রচলিত বিনোদন-ধারণা থেকে সম্পূর্ণ আলাদা নতুন এক জগৎ। নগর-সভ্যতায় আমরা যতই বিচ্ছিন্ন মানুষের মতো যান্ত্রিক জীবনযাপন করি, হয়তো আমাদের নাগরিক সমাজের মনের গভীরে রয়ে গেছে মাটির সঙ্গে, কৃষকের সঙ্গে অদৃশ্য কোনো বন্ধন।

শাইখ সিরাজ তাকে শনাক্ত করতে পেরেছেন। পুরোপুরি নিজের আগ্রহ এবং অঙ্গীকার দিয়ে কী করে একটি মামুলি অনুষ্ঠানকে নতুন ও স্বতন্ত্র ধারা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা যায়, তা উদাহরণসহ দেখিয়েছেন সিরাজ ভাই। কৃষি, কৃষক ও গণমাধ্যমকে ভালোবেসে তিনি উৎসর্গ করেছেন তার জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান বছরগুলো। এ মানুষটি সফল হবেন, এতে আর আশ্চর্য কী!

কৃষি বাংলাদেশের জীবনরেখা। সবসময়ই এটা বাংলাদেশের প্রধানতম অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড। এ দেশে অনেক সফল কৃষিবিদ এবং বিজ্ঞানী আছেন। কৃষির অগ্রগতিতে তাদের রয়েছে বিশাল অবদান। রয়েছে কৃষিবিষয়ক শিক্ষা এবং গবেষণা প্রতিষ্ঠান। কিন্তু কৃষিবিষয়ক গণযোগাযোগ নিয়ে কোনো উল্লেখযোগ্য চিন্তা বা উদ্যোগ কখনও প্রকৃত সাফল্যের মুখ দেখেনি।

আমরা পেয়েছি কৃষিকথা নামের ক্ষীণকায় পত্রিকা অথবা রেডিও-টেলিভিশনের দু-একটা দায়সারা অনুষ্ঠান। শেষ পর্যন্ত এ দেশের সবচেয়ে শক্তিশালী দুটি স্রোত, কৃষি আর গণমাধ্যমকে একত্রিত করে একটি নতুন ধারা তৈরি করলেন শাইখ সিরাজ। অসামান্য উদ্ভাবন-ক্ষমতা আর প্রয়োগ-নৈপুণ্য ছাড়া এরকম কঠিন কাজ করা যায় না। শুরুর দিকে এ কাজে বিটিভির ব্যয়-বরাদ্দ কেমন ছিল, স্পন্সর-বিজ্ঞাপন পাওয়া যেত কিনা- এসব কথা ভাবলে এ উদ্যোগ বেশি দূর এগোতো কি?

আসলে আমার ধারণা, শুধু ভালোবাসার শক্তিই একজনকে এরকম কাজে অনুপ্রাণিত করতে পারে। কেবল কৃষি ও কৃষকের প্রতি ভালোবাসা নয়; দেশ-বিদেশের অসংখ্য দর্শকের জন্য ভালোবাসা আর নিজের কাজটির প্রতি অন্ধ অনুরাগ- এ অঙ্গীকারের জন্যই শাইখ সিরাজ পেয়েছেন অসাধারণ জনপ্রিয়তা, কৃষি ও গণমাধ্যমের অবিসংবাদিত নেতৃত্ব এবং কৃষিপ্রধান এ জনপদের বিপুলসংখ্যক মানুষের শ্রদ্ধা ও সম্মান।

দেশ-বিদেশের বিভিন্ন পুরস্কার, পদক ও স্বীকৃতি তো তিনি পেলেন; কিন্তু সেই সঙ্গে তাকে কাঁধে নিতে হল বিশাল দায়িত্ব আর প্রত্যাশার চাপ। এ দেশের কৃষি ও কৃষকের গতি-প্রকৃতি, সমস্যা-সংকট, বাণিজ্যিক সম্ভাবনা, রাষ্ট্রীয় নীতি-পরিকল্পনা, প্রান্তজনের ভাবনার সঙ্গে নীতিনির্ধারকদের সমন্বয় এবং পারস্পরিক মতবিনিময় ইত্যাদি প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে কাজ এগিয়েছে; আর শাইখ সিরাজের কাছে জনমানুষের প্রত্যাশা বেড়ে গেছে অনেকখানি।

এত সাফল্য আর স্বীকৃতির মধ্যেও আমরা বারবার তাকে মনে করিয়ে দিয়েছি নতুন কিছু করার কথা, আরও বড় দায়িত্বের কথা। তিনি কখনোই তার প্রিয়জনদের নিরাশ করেননি। নিজের অতীত অর্জনকে অতিক্রম করে সামনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য তিনি উন্মুখ।

সেভাবেই তার ‘হৃদয়ে মাটি ও মানুষ’ ক্রমেই উচ্চতর পর্যায়ে পৌঁছেছে। জন্ম নিয়েছে নতুন নতুন ধারণা। শুরু হয়েছে জাতীয় নীতিনির্ধারণ এবং পরিকল্পনায় কৃষকের নিজস্ব ভাবনাকে অগ্রাধিকারে আনার আয়োজন। পদলালিত্য ঝংকার মুছে ফেলে গদ্যের কড়া হাতুড়ি হেনেছেন তিনি।

তারপরও স্বপ্ন আর ভালোবাসার মিশেলে যে অনুষ্ঠান তিনি তৈরি করেন, আর যে বাংলাদেশকে তিনি তুলে আনেন; তা দেখে আমার মাঝে মধ্যেই মনে পড়ে জীবনানন্দ দাশের কবিতার লাইন।

সিরাজ ভাই আর আমার জন্মতারিখ পাশাপাশি। তাই এমনিতেই এ দিনটার কথা মনে থাকে। একটু মনোবেদনাও বোধ করি। চাই বা না চাই, আমাদের বয়স বেড়ে চলেছে। প্রতিবছর আমাদের জন্মদিন সে কথাটাই আরেকবার মনে করিয়ে দেয়। এতগুলো বছর ধরে আমরা যার যার কর্মক্ষেত্রে যথাসম্ভব এগিয়ে যাওয়ার সংগ্রামে প্রাণপাত করে চলেছি।

আমাদের সমসাময়িক বন্ধু-স্বজনদের একক ও মিলিত পরিশ্রম আর স্বেদবিন্দুর চিহ্ন থেকে জন্ম নিয়েছে শিখর স্পর্শ করার উদ্যম। তৈরি হয়েছে সফল অনুষ্ঠান, রচিত হয়েছে গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যকর্ম, গড়ে উঠেছে বেশকিছু সফল প্রতিষ্ঠান। জন্ম নিয়েছেন শাইখ সিরাজের মতো নিবেদিত, আন্তরিক আর হৃদয়বান মানুষ।

এখন বোধহয় সময় হল পরের প্রজন্মের উপযুক্ত মানুষ খুঁজে বের করার, যারা দায়িত্ব নেয়ার জন্য তৈরি; নতুন স্বপ্ন আর নতুনতর কর্মকুশলতায় সমৃদ্ধ। শাইখ সিরাজ এখানেও অন্যদের চেয়ে এগিয়ে থাকবেন বলে মনে হয়।

ইতিমধ্যে তিনি বহু যোগ্য মানুষকে একত্রিত করে গড়ে তুলেছেন এমন একটা কর্মী দল; যারা গবেষণা, পরিকল্পনা, চিত্রধারণ ইত্যাদি দিয়ে তার স্বপ্নকে সহজেই দর্শকের কাছে পৌঁছে দিতে পারেন। সিরাজ ভাইয়ের জন্মদিনে তাকে আন্তরিক অভিনন্দন ও শুভকামনা জানাই। কামনা করি তার দীর্ঘ ও সার্থক জীবন।

বাংলানিউজসিএ/ঢাকা/ ০৮ সেপ্টেম্বর ২০১৯/ এমএম


Array