প্রবাস বাংলা ভয়েস ডেস্ক :: রাজশাহীর কৃষক উজাল এবার আলু চাষ করেছিল তিন বিঘা জমিতে। তিন বিঘায় তার বীজ আলু লেগেছে ৭৫০ কেজি। প্রতি কেজি ৯০ টাকায় মোট বীজ বাবদ খরচ হয়েছে ৬৭ হাজার ৫০০ টাকা। নিজের জমিতে চাষ করায় জমি বাবদ তার কোনো ভাড়া লাগেনি। তবে হাল চাষ, রাসায়নিক সার, কীটনাশক ও পানিসহ সব মিলিয়ে তার খরচ পড়েছে বিঘাপ্রতি ৫০ হাজার টাকা। তিন বিঘায় তার আলু উৎপাদন হয়েছে ১০,৭২৫ কেজি। ১০ টাকা কেজি দরে আলু বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছেন, যার বিক্রয় মূল্য মোট ১,০৭,২৫০ টাকা। তিন বিঘায় তার খরচ হয়েছিল মোট ১,৫০,০০০ টাকা। যোগ-বিয়োগের অংকে দেখা যায়, তার লস বা ক্ষতি হয়েছে ৪২,৭৫০ টাকা। এ ছাড়া যদি প্রতি বিঘা জমির ভাড়া ২০ হাজার টাকা করে ধরলে দেখা যায় তার এবার লস বা ক্ষতি হয়েছে এক লাখ দুই হাজার ৭৫০ টাকা। (তথ্যসূত্রঃ বাংলাদেশ রিসোর্স সেন্টার ফর ইন্ডিজিনাস নলেজ-বারসিকের মাঠ সমীক্ষা থেকে নেওয়া)।
আমরা বাজারে ১০ টাকায় আলু আর ২৫ টাকায় পেঁয়াজ পেয়ে যে শান্তির ঢেঁকুর তুলছি এবং সরকারকে বাহবা দিচ্ছি, শান্তির এই বাজার সৃষ্টি করার জন্য। সেই বাজার আসলে কেমন? আসলে সেই শান্তির কারণে কোথায় অশান্ত হয়ে যাচ্ছে সমাজের মানুষ, কৃষক সেটিও ভেবে দেখা দরকার নয় কি?
এদিকে রাজশাহীর বাঘা উপজেলার বাউসা ইউনিয়নের মাঝপাড়া গ্রামের কৃষক রুহুল আমিন তিন লাখ টাকা ঋণ নিয়ে পেঁয়াজ চাষ করেন। পেঁয়াজের সঠিক দাম না পাওয়ায় ক্ষতির শিকার হয়ে ক্ষুদ্রঋণের জালে আটকে পড়ে শেষ পর্যন্ত তাকে ট্রেনের চাকায় আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে হলো। (সূত্র: চ্যানেল২৪, ১৬ এপ্রিল ২০২৫, অনলাইনে প্রকাশিত প্রতিবেদন)।
আমরা সবসময় উন্নয়নের কথা বলি। উন্নয়ন বাংলাদেশের রাজনৈতিক বক্তৃতা, সরকারি বিজ্ঞাপন, টকশো, মিডিয়াসহ— এমনকি নীতিনির্ধারণী আলোচনায় সবচেয়ে উচ্চারিত শব্দগুলোর একটি। উন্নয়ন শব্দ নিয়ে চলে শব্দবাজি, চলে ক্ষমতা টিকিয়ে থাকার বা যোগ্যতা দেখানোর। কার জন্য উন্নয়ন, কীসের উন্নয়ন, উন্নয়ন কি শুধু অর্থের হিসেবে আর ডলারে? উন্নয়ন কি শুধু ইট-কাঠ-পাথরের আর যন্ত্রমানব কলকারখানার? উন্নয়ন কি শুধু কৃষিজমি ধ্বংস করা, নদী-নালা-খাল-বিল এবং প্রাকৃতিক যত উৎস আছে তা বিনষ্ট করা? কৃষকের জীবনে উন্নয়ন কি শুধুই স্বপ্ন দেখনোর মতোই হয়ে থাকবে?
আমরা যখন উন্নয়নের কথা বলি, সেই উন্নয়নে কি সবার উন্নয়ন থাকে? উন্নয়ন শব্দটি সব শাসকের একটি অন্যতম হাতিয়ারও বটে। কিন্তু সেই উন্নয়নে কৃষকের জীবনে উন্নয়ন এখনো এক স্বপ্ন। কৃষিপ্রধান বাংলাদেশের প্রায় ৬০ শতাংশের বেশি মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কৃষির ওপর নির্ভরশীল। উন্নয়ন নিয়ে সব শাসক নানা বাহাদুরি দেখালেও আজও কৃষক সবচেয়ে অনিশ্চিত অবহেলিত অবস্থানে রয়েছেন। ঠিক রাজশাহীর কৃষক উজালের মতো। তারা বছরে দুই কিংবা তিনবার ফসল ফলান। কিন্তু বাজারে তাদের সেই ফসলের দাম ওঠে না উৎপাদন খরচের সমানও। সার, বীজ, কীটনাশক, পানি, শ্রম— সবকিছুর ব্যয় বেড়েছে, কিন্তু দাম বাড়েনি কৃষকের সবজি, ধান, পাট, গম, আলু, ডাল কিংবা দুধের। এ জন্য উজালের মতো শত শত কৃষককে মৌসুম শেষে গোয়ালের গরুটি বিক্রি করে বা নতুন করে উচ্চ হারে ক্ষুদ্রঋণের জালে পড়ে যেতে হচ্ছে। একসময় তার শেষ সম্বল জমিটুকুও বিক্রি করতে হয়। এভাবে কৃষক তার জমি হারাচ্ছে, ধনীক শ্রেণি বা এক ধরনের ব্যবসায়ী শ্রেণি সব জমির মালিক হচ্ছে, তারা বাজার দখল করে আরেক ধরনের সংকট সৃষ্টি করবে। গ্রামের একজন কৃষক, ধান উৎপাদন করে কেজিপ্রতি পান ২০-২৫ টাকা। অথচ সেই ধান থেকে উৎপাদিত প্যাকেটজাত চাল বিক্রি হয় ৬০-১৬০ টাকায়। মাঝখান থেকে লাভ করে মধ্যস্বত্বভোগী, পাইকার ও প্রসেসিং কোম্পানিগুলো। কোম্পানি যখন সেই ধান বা গম থেকে তৈরি করে আটা, সুজি, বা স্ন্যাকস তখন তার দাম হয় তিনগুণ বা তারও বেশি। কোম্পানিগুলো তাদের পণ্যের দাম বাড়ায় ইচ্ছামতো যখন-তখন, মূল্য বাড়ানোর নেই কোনো নিয়মনীতি। থাকলেও তা কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যায় না। এমনিকি কোম্পানির এসব পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি হলেও মিডিয়াতে কৌশলে সেসব এড়িয়ে যাওয়া হয়, সেগুলোর শিরোনাম হয় না। অন্যদিকে কৃষকের পণ্যের দাম একটু বাড়লেই তা নিয়ে মিডিয়ায় চলে হইচই। কৃষকের প্রাপ্তি থাকে শূন্যের কোটায়। কৃষকদের স্বপ্নপূরণে কোনো কালেই এখন পর্যন্ত কোনো সরকার কৃষকের মতো করে সমস্যা সমাধানে এগিয়ে আসেনি, যা হয়েছে তার প্রায় সবই ওপর থেকে চাপিয়ে দেওয়ার মতো করে।
অঞ্চলভিত্তিক কৃষিশিল্প নিয়ে কোনো কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। কৃষিশিল্পের নাম করে যা হয়েছে, সেই কৃষিশিল্পও কোম্পানিগুলোর দখলে। তাহলে কৃষকের জায়গা কোথায়? বাংলাদেশে কৃষিশিল্পের নামে কৃষি প্রক্রিয়াজাত শিল্প এগমিল, ডেইরি প্রসেসিং, খাদ্য উৎপাদন, প্যাকেজিং ইত্যাদি যা গড়ে উঠেছে, তাতেও রয়েছে সমস্যা। এই শিল্পগুলোতে কৃষকের কোনো অংশগ্রহণ নেই বললেই চলে। এখানে কৃষক হয়ে থাকেন কাঁচামাল সরবরাহকারী অথচ প্রক্রিয়াজাত করে বিক্রি করে বিপুল মুনাফা করে বড় বড় কোম্পানিগুলো। অনেক সময় এসব কাঁচামাল কিনতেও কোম্পনিগুলো কৃষকদের হয়রানি ও ঠকানোর খবরও উঠে এসেছে নানাভবে। একদিকে কৃষক তার উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করতেও সিন্ডিকেটের শিকার হচ্ছেন। অন্যদিকে কৃষক তার ফসল উৎপাদনে সার বীজ, রাসায়নিক কীটনাশক, পানি কিনতেও সিন্ডিকেটের কবলে পড়ছেন, প্রতারিত হচ্ছেন। সাম্প্রতি শেষ হওয়া আলু মৌসুমে বীজ আলু নিয়ে সিন্ডিকেট করেছিল এসব অসাধু ব্যাবসায়ী। ৬০ টাকার বীজ আলু কিনতে হয়েছে ৯০ থেকে ১০০ টাকা বা তারও বেশি। অন্যদিকে রাসায়নিক কীটনাশকের দাম বেড়েছে। এসব সমস্যা সমাধানে সরকার তেমন কোনো উদ্যোগও নেয়নি।
দীর্ঘ সময়ের পর গণ-অভ্যুস্থানের মাধ্যমে আমরা একটি সরকার পেয়েছি। যাদের কাছে আমাদের কৃষকদের প্রত্যাশা ছিল অনেক স্বচ্ছ। অনেকটা সময় পেরিয়ে গেছে। সরকার নানা ধরনের উন্নয়ন নিয়ে কথা বলছে, নানা উন্নয়নের প্রকল্প সামনে আনছেন। এই দীর্ঘ সময়ে আমরা সরকারের উন্নয়ন কর্মসূচিতে কৃষককে কম দেখতে পেয়েছি, কৃষকদের নিয়ে কোনো কথা বলা হয়নি। আমরা উন্নয়নকে শুধু যদি আগের সরকারের মতো শহরের উঁচু বিল্ডিং, স্যাটেলাইট বা এক্সপ্রেসওয়েসহ কলকারখানায় রাখি, তাহলে কৃষিপ্রধান বাংলাদেশে কৃষকের স্থান কোথায়। একটি কৃষি মন্ত্রণালয়ের প্রধান হিসেবে আমরা একজন কৃষিবিদকে আজও নির্দিষ্ট করতে পারলাম না। একটি কৃষিপ্রধান বাংলাদেশ নিয়ে এই অবহেলার কারণ কি? আমরা বলতে পারি— এ অবস্থার পরিবর্তন জরুরি। আমরা রাত পোহালেই বাহারি সব পশ্চিমা করপোরেটের বাহারি উন্নয়ন প্রকল্পের গল্প শুনছি। নিঃসন্দেহে সেটি তখনই আরও ভালো লাগবে, যখন এখানে কৃষকের স্বাধীনতা, কৃষকের কথাগুলোও যুক্ত হবে। সারাদিন রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে, শীত গরমকে উপেক্ষা করে, মাথার ঘাম পায়ে ফেলে যে কৃষক রাত-দিন পরিশ্রম করে আমাদের জন্য খাদ্য উৎপাদন করছে, সেই কৃষক যখন অবসরে এই মিডিয়ার সামনে এসে তাদের নিয়ে সরকারের কোনো ভাবনা শুনতে পায় না, তখন বড়ই হতাশ হয়ে যায় কৃষক। কৃষকের প্রত্যাশা পূরণে প্রয়োজন কৃষকদের মতো করে চিন্তা এবং নীতির পরিবর্তন। দিনে দিনে এভাবে উজ্জ্বলের মতো কৃষক সবকিছু নিঃশেষ হলে, নিঃশেষ হবে আমাদের স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকার সক্ষমতা। আমরা আমাদের খাদ্যের স্বাধীনতা, উৎপাদনের স্বাধীনতা, বাজার স্বাধীনতা, নিজের পরিবেশের স্বাধীনতা, বীজের স্বাধীনতা হারাতে চাইনা। এগুলোতে কোন করপোরেটাইজেন চাই না। এগুলোই আমাদের বেঁচে থাকতে সহায়তা করবে। এগুলোই আমাদের আরও স্বতন্ত্র ও বৈচিত্র্যময় করে তুলবে। উন্নয়ন হোক বৈচিত্র্যময়, সবাইকে নিয়ে।
লেখক: নৃবিজ্ঞানী ও পরিবেশ আইন গবেষক
বাংলাদেশ রিসোর্স সেন্টার ফর ইন্ডিজিনাস নলেজ-বারসিক
ইমেইল: shahidul546mh@gmail.com
প্রবাস বাংলা ভয়েস /ঢাকা/ ১৮ এপ্রিল ২০২৫ /এমএম