মো: মাহমুদ হাসান :: লোভ, প্রতিহিংসা পরিহার করে, অন্যায়, অনিয়ম আর দুর্নীতিকে কে প্রশ্রয় না দিয়ে, সৎ ও সুন্দর জীবন যাপনের কথা প্রতিটি ধর্মীয় অনুশাসনেই আছে। হারাম-হালাল, ন্যায়-অন্যায়ের নির্দেশিকা যেমন আছে, মানুষের করণীয়-বর্জনীয় সম্পর্কিত বিধিবিধানও আছে। সমাজে ধর্মীয় অনুশাসন ও বিধি-বিধান অনুসারী মানুষের সংখ্যা বাড়লে, নৈতিক ও সামাজিক অবক্ষয় কমে যাওয়াটাই প্রত্যাশিত। তাই জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে মসজিদ, মক্তব, মাদ্রাসা, মন্দির, প্যাগোডা আর চার্চের সংখ্যা যদি বাড়ে, সামাজিক ও নৈতিক মূল্যবোধ প্রতিরোধে এসব প্রতিষ্ঠান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। এখন থেকে দুই যুগ আগে, আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় দুর্নীতি, অনিয়ম-অনাচারের যে চিত্রটি ছিল, বর্তমানে তা বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। তাহলে কি জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে আমাদের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা সমভাবে বাড়েনি? নাকি নৈতিক মূল্যবোধ সম্পন্ন প্রজন্ম তৈরিতে আমাদের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যর্থ হচ্ছে? হারাম-হালাল, নিয়ম-নৈতিকতার তোয়াক্কা না করে, যে কোন মূল্যে অর্থ উপার্জনের প্রতিযোগিতা বাড়ছে কেন?
মসজিদ, মন্দিরের ব্যবস্থাপনা ও তদারকিতে এক সময় সরকারি অংশগ্রহণ ছিল না বললেই চলে। ধর্ম মন্ত্রণালয় সৃষ্টির পর থেকে এসব প্রতিষ্ঠানে সরকারি দান-অনুদানের প্রকৃতি ও পরিধি বহুগুনে বৃদ্ধি পেয়েছে। তদারকি আর সহযোগিতার জন্য সরকারের বিভিন্ন অঙ্গ প্রতিষ্ঠানও রয়েছে। উদ্দেশ্যটি দ্বিমুখী, একদিকে মহান সৃষ্টিকর্তার সন্তুষ্টি অর্জন যেমন সম্ভব হবে, অন্যদিকে ধর্মীয় বিধি-বিধান অনুসারীদের সংখ্যা বাড়লে সমাজে আইনের শাসন বাস্তবায়নও সহজতর হবে। ভালো প্রজন্ম তৈরি হলে, ভালো সমাজ তৈরী হবে। বেহাল দশার এ সমাজে আজ আমরা যা দেখছি, এর সবই তো তার বিপরীত। দুর্নীতিবাজ, প্রতারকদের সংখ্যা বাড়ছে। মাদকপ্রেমী, মাদকসেবী আজ ঘরে ঘরে। ইয়াবা ব্যবসায়ীদের অর্থ বৃত্তের কাছে শিক্ষিত সচেতন সাধারণ মানুষগুলো অসহায়। গরিব কৃষকের টাকায় ড্রয়ার ভরে সাব রেজিস্টার, কানন গো! মাদকাসক্ত সন্তানের কাছে পিতা-মাতা অসহায়, গার্লফ্রেন্ড, বয়ফ্রেন্ডের দৌরাত্ম্যে ঘরে ঘরে অস্থিরতা। তাহলে আমাদের হাজার বছরের ধর্মীয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতীক প্রতিষ্ঠানগুলো কি যথাযথ ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হচ্ছে? সমস্যাটি তাহলে কোথায়?
ছোটবেলায় দেখেছি তিন গ্রামের জন্য টিন,বাঁশের তৈরি দুটো মসজিদ। আজ একই এলাকায় বড় বড় অট্টালিকা সমৃদ্ধ দৃষ্টিনন্দন মসজিদ, মক্তবের সংখ্যা নয়টি। গাণিতিক নয় মসজিদের সংখ্যা বেড়েছে জ্যামিতিক হারেরও ঊর্ধ্ব গতিতে। একজন মানুষ কাপড় সেলাই করতেন। এলাকার মানুষ তাকে মাস্টার টেইলার হিসেবে চিনতেন। রাতের আঁধারে চা বাগানে গিয়ে মদ্য সেবন করতেন। কখনো শোনা যায়নি, কারো কোন ক্ষতি করেছেন। কঠোর পরিশ্রম করেই জীবন ধারণ করতেন। অভ্যাসটা ছাড়তে পারেননি, মৃত্যুর আগ অবধি এলাকার মানুষ থাকে মদ্যপ হিসেবেই জানতেন। আরেকজন খেলাধুলা করতেন, খেলাধুলার পৃষ্ঠপোষকতাও করতেন। উনারও চা বাগানের পাট্টায় যাওয়ার অভ্যাস ছিল। সামাজিক শৃঙ্খলা বহির্ভূত বদ-অভ্যাসের কারণে পুরো ইউনিয়নের মানুষ এ দুজনকে চিনতেন। এছাড়া দীর্ঘ এলাকায় মদ্যপান করেন এমন লোক ছিল বলে জানা নেই।আজ সমাজে এমন কোন পাড়া,মহল্লা নেই, যেখানে মাদক সেবী আর মাদক ব্যবসায়ী নেই। সমাজের উঁচু তলায় তো মাদক এখন ফ্যাশন। দুর্নীতি, অনিয়মে যুক্ত হয়ে অর্থের নেশায় পাগল প্রায় মানুষের ভিড়ে সমাজ আজ ভারসাম্যহীন। চারিদিকে এতোসব ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান আলো ছড়াচ্ছে, সমাজে এর শুভ জ্যোতির লক্ষণ নেই কেন?
সোনা আব্দুল (ছদ্মনাম)!! তার সংগে দু’যুগ আগের পরিচয়। এক সময় আমি তার প্রতিবেশী ছিলাম। পেছনে, ডানে, বামে বড় বড় সব অট্টালিকার মালিক ছিলেন তিনি। বাসা থেকে বের হলেই, সবুজ ইউনিফর্ম পরিহিত একদল সিকিউরিটি তাকে গার্ড অফ অনার দিয়ে এগিয়ে নিয়ে যেতেন। বেশিরভাগ সময় নামাজের আজান হলে এ দৃশ্যটি চোখে পড়তো। ঢাকা শহরের একটি মাত্র আবাসিক এলাকায় একুশটি প্লটের মালিক তিনি। যে আবাসিক এলাকায় তিনি থাকতেন, সেখানে কোন সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজের অস্তিত্ব ছিল না বললেই চলে। দৈব দুর্বিপাকে কিছু ঘটে গেলে, সাধারণ মানুষ তার কাছে সন্তুোষজনক সমাধান পেতেন। এলাকার মানুষ তাকে দানবীর হিসেবে চিনতেন। ঢাকা শহরে একটি পরিকল্পিত আবাসিক এলাকায় দেড় বিঘা জমি ক্রয় করে, মসজিদ নির্মাণ করেছেন। বেশিরভাগ সময় মসজিদে গিয়ে জামাতে নামাজ পড়তেন। ইমাম সাহেবের ঠিক পেছনের আসনটি যেন সব সময় তার জন্যই বরাদ্দ ছিল। একদিন এলাকাবাসী একটি স্কুল নির্মাণের দাবি জানালেন। ভদ্রলোক চিন্তা করার সময়ও নিলেন না। তড়িৎ এলাকাবাসী বাস্তবতা দেখতে পাবেন বলে আশ্বাস দিলেন।
বেশি দিন লাগেনি। মসজিদ সংলগ্ন ছয়টি প্লট কিনে নিলেন। পিতার নামে স্কুলের সাইনবোর্ড লাগিয়ে দিলেন। বর্তমানে এখানে বহু দল বিশিষ্ট হাই স্কুল এন্ড কলেজ। এমন দানবীরকে সম্মান না করে উপায় কোথায়? তাই স্থানীয় সব প্রতিষ্ঠান, মসজিদ মক্তব স্কুল-কলেজের সভাপতি তিনি। শুধু মন্ত্রী এমপি নয়, দেশের তৎকালীন রাষ্ট্রপতিকেও আমি সোনা আব্দুল এর বাসায় আতিথ্য গ্রহণ করতে দেখেছি। তার বাসভবন টি যেন তৎকালীন গণপুর্ত মন্ত্রী ও সচিবের অবকাশ কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল। একবার তিনি সমস্ত এলাকাবাসীকে খাওয়ানোর মহস্থির করলেন। প্রজেক্ট এর বিশাল মাঠে চলতে থাকলো আয়োজন। স্বেচ্ছাসেবীদের সংখ্যাই হাজারেরও বেশি। তিন দিনব্যাপী চলতে থাকলো উৎসব আয়োজন। সারাদিনব্যাপী চলত খাবার-দাবার, রাতে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। খাবারের মেনু যেন রাজপ্রাসাদের ভোজন বিলাস। কি নেই তাতে? আস্ত রূপচাঁদার ফ্রাই, বড় বড় সাইজের গলদা চিংড়ির ভুনা, মুরগির রোস্ট, গরু খাসির রেজালা আর বাহাড়ি স্বাদের পোলাও। হাজার হাজার মানুষের জন্য এমন বিলাসী আয়োজন আমার জীবনে আর দেখিনি। প্রতি রাতেই দেশ বরেণ্য শিল্পী, কলাকুশলীদের নাচে গানে আনন্দ উৎসবে মেতে উঠতো এলাকাবাসী।
বিশ বছর আগের কথা। কোটি টাকা সোনা আব্দুলের কাছে যেন ডাল-ভাত। শুধু ঢাকা শহর নয়, মুন্সিগঞ্জের পল্লীতে বহু মসজিদ, মাদ্রাসা, এতিমখানার দাতা তিনি। স্কুল কলেজেরও সভাপতি। বিস্ময়ের ব্যাপার, সবাই জানেন তিনি ব্যবসায়ী কিন্তু কিসের ব্যবসা সঠিক ভাবে তা কেউ জানেন না। তবে গুলশান, মগবাজার আর মতিঝিলে তার বিলাসবহুল অফিস দেখার সৌভাগ্য অনেকেরই হয়েছে। একটি বিষয় অনেকের জানা ছিল। এক সময়ে সোনা আব্দুল মগবাজারে হাঁড়ি পাতিলের দোকানের কর্মচারী ছিলেন। ষোল বছর বয়সের দোকান কর্মচারী, ছাব্বিশে এসে শত শত কোটি টাকার মালিক। নামী দামি দানবীর!! এতো টাকার উৎস নিয়ে কারও মাথা ব্যথা নেই। ধর্মীয় আর সামাজিক প্রতিষ্ঠান মানেই সোনা আব্দুল তার সভাপতি, প্রধান উপদেষ্টা বা পৃষ্ঠপোষক!!
২০০৬ সালের ২৬শে জুন। কানাডার স্থায়ী অভিবাসনের উদ্দেশ্যে দেশ ত্যাগ করবো। দীর্ঘদিনের প্রতিবেশী হিসেবে সৌজন্যমূলক বিদায়ী সাক্ষাৎ করতে দান বীরের বাসায় যাই। সংগে দুবাই প্রবাসী এক প্রকৌশলী। চা-নাস্তা শেষে বিদায় মুহূর্তে তিনি একটি ভিজিটিং কার্ড ধরিয়ে দিলেন। দুবাই গেলে তিনি সে ঠিকানায় থাকেন। আমাদের দু’জনকে বললেন, কার্ডে থাকা ফোন নম্বরে ফোন দিয়ে সে ঠিকানায় চলে যেতে। মাস দুয়েক পর দুবাই প্রবাসী প্রকোশলীর কাছে শুনলাম, আন্ডার ওয়ার্ল্ডের ডন খ্যাত দাউদ ইব্রাহিমও সে ঠিকানায় থাকেন। তখন থেকে আমার ঘুর ভাঙে। কে সেই দানবীর সোনা আব্দুল? সেটি বুঝতে আর বাকি থাকে না। ২০২০ সালের ২১ নভেম্বর বিষয়টি আরও পরিষ্কার হয়। পত্র পত্রিকার শিরোনাম ‘ ৬০০শ ভরি স্বর্ণ, কোটি কোটি টাকা আর অত্যাধুনিক অস্ত্রসহ সোনা আব্দুল গ্রেফতার’!! হয়তো রাজনৈতিক হিসাবে কোন ছন্দপতন হয়েছিল। বাংলাদেশের সেদিনের সকল পত্রপত্রিকার শিরোনাম অনুযায়ী তিনি কারাবন্দি হয়েছিলেন। এখন কোথায় আছেন জানিনা। তবে সেদিনের খবরের কাগজে তার সম্পদের যে বিবরণ প্রচারিত হয়েছিল, বোধ করি সে কাহিনী যে কোন মানুষের কল্পনাকেও হার মানাবে!!
শৈশবে দেখেছি, সমাজের সবচেয়ে ভালো মানুষটি মসজিদ,মাদ্রাসা,মক্তব,মন্দির পরিচালনা কমিটির সভাপতি হয়। সৎ, শিক্ষানুরাগী মানুষগুলো স্কুল-কলেজের ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকেন। এক সময়ে ডাক্তার আলাউদ্দিন, ছাত্তার মেম্বার, ছানু মেম্বারের মতো মানুষেরা এসব প্রতিষ্ঠানের সভাপতি হতো। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সারাদেশে আজ সে স্থানগুলো বিত্তশালী দানবীর বা রাজনৈতিক প্রতিপত্তি শালীদের দখলে। রাজনৈতিক প্রতিপত্তির জন্যও বিত্তের প্রয়োজন। চাকুরিজীবীরা সুনির্দিষ্ট আয়ের মানুষ। সীমিত আায়ে দুর্মূল্যের বাজারে ধনাঢ্যদের মতো তাদের দানবীর হওয়ার উপায় নেই। তবুও হাট ঘাটে আজ হাজার হাজার চাকুরিজীবী দানবীর। মূলতঃ এরা সকলেই সোনা আব্দুলদের স্বগোত্রীয় মানুষ।
তোয়ালে মোড়ানো চেয়ার কে না ভালোবাসে! সম্মান মর্যাদার প্রতি আকর্ষণ তো চির শাশ্বত। নতুন প্রজন্ম মসজিদ, মক্তবে গেলে তাদের চোখের সামনে সোনা আব্দুলদের চেহারা ভেসে উঠে। সমাজে সম্মানিত হওয়ার অভিপ্রায়ে এঁরা ধর্মীয় অনুশাসনকে ভুলে গিয়ে সোনা আব্দুল হতে চায়। এক লক্ষ চল্লিশ হাজার টাকা পেনশন পেয়ে, স্কুল মাস্টার সৃষ্টিকর্তার কৃপা লাভের অভিপ্রায়ে লক্ষ টাকা মসজিদে দান করেন। নিজেকে চিকিৎসা বঞ্চিত করে, পরকালে শান্তির প্রত্যাশায় খোরশেদ আলী মেম্বার জমি বিক্রির লক্ষ লক্ষ টাকা মসজিদকে অনুদান দেন। সেই দাতারা সম্মানিত হয় না। অনৈতিক উপায়ে অর্জিত লাখ লাখ টাকা দানকারী মানুষকে সম্মান জানাতে ওরা ফেসবুকে লাইভ করে। তাই ধর্মীয় অনুশাসন নয়, সোনা আব্দুলরা এখন পছন্দের শীর্ষে। সমাজে ধর্মীয় অনুশাসনের প্রতিফলন দেখতে হলে, এসব প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা থেকে সোনা আব্দুলদের তাড়াতে হবে। অন্যতায় নৈতিক মূল্যবোধ সম্পন্ন একটি সুন্দর সুখী সমাজ ব্যবস্থার স্বপ্ন হবে পরাভুত।
লেখক: কলামিস্ট, উন্নয়ন গবেষক ও সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষক
প্রবাস বাংলা ভয়েস /ঢাকা/ ১৬ মার্চ ২০২৪ /এমএম