বাংলানিউজসিএ ডেস্ক :: আতঙ্কের আরেক নাম ডেঙ্গু। মশাবাহিত এ রোগে শিশুরাই বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। রাজধানী ঢাকায় ছড়িয়ে পড়েছে এই ভীতি। শহর-বন্দর ও গ্রামগঞ্জ সবখানেই ছড়িয়ে পড়তে পারে এর প্রকোপ। বিশেষ করে রাজধানী শহরে মশাবাহিত এই ভাইরাস ব্যাধি প্রকট আকার ধারণ করেছে। ১৭ জুলাইয়ের খবর অনুযায়ী স্বাস্থ্য অধিদফতরের হিসাবে গত ২৪ ঘণ্টায় ১৭১ জন ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়ে বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এছাড়া এ হিসাবে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে তিনজনের মৃত্যুর কথা বলা হয়েছে। তবে সরকারি হিসাবে ডেঙ্গুতে যে কয়জনের মৃত্যুর কথা বলা হয়েছে, প্রকৃতপক্ষে তার সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
চিকিৎসকরা বলছেন, সরকারিভাবে ডেঙ্গু রোগীর যেই পরিসংখ্যান প্রকাশ হচ্ছে, প্রকৃতপক্ষে রোগীর সংখ্যা আরো বেশি হবে। কারণ স্বাস্থ্য অধিদফতর যেসব হাসপাতাল থেকে তথ্য সংগ্রহ করে, তার বাইরেও অন্যান্য হাসপাতাল ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের চেম্বারে ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসা নিয়ে থাকেন। সরকারি সংস্থার এই হিসাব ছাড়া অন্যান্য ক্ষেত্রে ডেঙ্গু যে প্রভাব বিস্তার করে চলেছে সেই হিসাবটা কে দেখবে? ডেঙ্গু বিস্তারের প্রকৃত খবর ছাপিয়ে কিছু সংখ্যক হাসপাতালের খবর জনসম্মুখে তুলে ধরে লাভ নেই। বরং আক্রান্তদের প্রকৃত খোঁজ নিয়ে ডেঙ্গু নিরাময়ে কার্যকরী উদ্যোগ নিতে হবে।
বড়দের পাশাপাশি ডেঙ্গুজ্বরে শিশুরাও আক্রান্ত হচ্ছে। দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে যত মানুষের মৃত্যু হচ্ছে, তার অর্ধেকের বেশি শিশু। যারা দ্বিতীয়বার এ রোগে সংক্রমিত হচ্ছে তাদের অবস্থা অত্যন্ত জটিল। স্বাস্থ্য অধিদফতরের এমারজেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম সরকারি, আধা-সরকারি ও বেসরকারি মোট ৪৭টি হাসপাতালে খোঁজ নিয়ে জানিয়েছে, ডেঙ্গুতে আক্রান্ত শতকরা ৩৪ শতাংশ শিশু। আর নারীদের সংখ্যা প্রায় ৩০ শতাংশ। চলতি জুলাই মাসে হাসপাতালগুলোতে ভর্তি হওয়া এক হাজার ১২৮ জন ডেঙ্গু রোগীর লিঙ্গভিত্তিক পরিচয় বিশ্লেষণ করেছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। এদের মধ্যে ৩৫৮ শিশু ডেঙ্গু রোগী। এছাড়া স্বাস্থ্য অধিদফতর জানিয়েছে, সারাদেশে প্রতিদিন দেড়শ’ জনের বেশি মানুষ ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালমুখী হচ্ছে।
ডেঙ্গু এখনো মহামারী রূপ ধারণ করেনি। সবেমাত্র সর্বাগ্রে বিস্তার ঘটতে শুরু করেছে। ডেঙ্গু মহামারী পর্যায়ে পৌঁছার আগে সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থা ও সাধারণ মানুষকে সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। বাংলাদেশ এখনো ফিলিপাইনের মতো ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়নি। জানুয়ারি থেকে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ৪৫০ জনেরও বেশি মানুষ মারা যাওয়ার পর ‘জাতীয় ডেঙ্গু সতর্কতা’ জারি করেছে ফিলিপাইনের স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ। ২০১৯ সালের প্রথম ছয় মাসে ফিলিপাইন জুড়ে প্রায় এক লাখ মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে, যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৮৫% বেশি। এছাড়া সে দেশের জনসংখ্যার প্রায় ২০ ভাগ লোক বসবাস করা চারটি অঞ্চলে মহামারী ঘোষণা করা হয়েছে। ডেঙ্গু ক্যান্সারের মতো মৃত্যু ভয়ঙ্কর না হলেও এটি একই সঙ্গে অসংখ্য মানুষকে সংক্রমিত করে এবং একটা অংশকে মৃত্যুর দিকে ধাবিত করে। ওয়ার্ল্ড
হেলথ অর্গানাইজেশনের তথ্য অনুসারে, বিশ্বব্যাপী প্রতি বছর ডেঙ্গু সংক্রামিত প্রতি ১০ লাখ মানুষের মধ্যে আনুমানিক পাঁচ লাখ মানুষকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয় এবং এদের সাড়ে ১২ হাজার জন মারা যায়।
ডেঙ্গু হলো ফ্ল্যাভিভাইরিডি পরিবার ও ফ্ল্যাভিভাইরাসের অন্তর্ভুক্ত মশাবাহিত আরএনএ ভাইরাস। এটি ডেঙ্গুজ্বরের জন্য দায়ী। এডিস ইজিপ্টি মশা এই ভাইরাসের বাহক। একই মশা ইয়েলো ফিভার ভাইরাস, জিকা ভাইরাস, চিকুনগুনিয়া ভাইরাসেরও বাহক। ডেঙ্গুজ্বর একটি সংক্রামক ট্রপিক্যাল ডিজিজ যা ডেঙ্গু ভাইরাস-এর কারণে হয়। এতে যে উপসর্গগুলো দেখা দিতে পারে, তার মধ্যে অন্যতম প্রচণ্ড জ্বর, মাথাব্যথা, পেশি ও গাঁটে ব্যথা। স্বল্প ক্ষেত্রে অসুখটি প্রাণঘাতী ডেঙ্গু হেমোর?
অনুচক্রিকার কম মাত্রা এবং রক্ত প্লাজমার নিঃসরণ অথবা ডেঙ্গু শক সিন্ড্রোম-এ পর্যবসিত হয়। ডেঙ্গু প্রজাতি এডিস বিভিন্ন প্রকার মশা দ্বারা পরিবাহিত হয়। যেহেতু এর কোনো ভ্যাকসিন নেই তাই মশা বৃদ্ধির অনুক‚ল পরিবেশ ও মশার সংখ্যা বৃদ্ধি হ্রাস এবং মশার কামড়ের সম্ভাবনা কমানোর মাধ্যমে ডেঙ্গু প্রতিরোধ করা সম্ভব।এডিস মশার আক্রমণে ডেঙ্গু রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটে। এটি একটি মশাবাহিত রোগ। রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইইডিসিআর সূত্র মতে, এখন এডিস মশার প্রজনন মৌসুম। এখনই এই মশা নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়বে।
বর্তমান আবহাওয়াও এই মশা প্রজননে অনুক‚ল পরিবেশ তৈরি করছে। ডেঙ্গুবাহী এডিস মশা এ সময়টায় বংশ বৃদ্ধি ঘটিয়ে থাকে। এডিস মশার ডিম ছয় মাস পর্যন্ত শুকনো স্থানে বেঁচে থাকতে পারে। এ মশা সাধারণত জমাট বাঁধা পরিষ্কার পানিতে ডিম ছাড়ে। এদের বংশ বৃদ্ধির উপযুক্ত স্থান হচ্ছে চারপাশে পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে থাকা বৃষ্টির পানি ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন পাত্র কিংবা গোসলখানার বালতি, ট্যাঙ্ক, ক্যান, খোলা কৌটা-বোতলসহ গর্ত, নালা-নর্দমায় জবাটবদ্ধ পানি। তাই মশার বংশবৃদ্ধি রোধে জনসচেতনতাসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাকে এগিয়ে আসতে হবে। সাধারণ মানুষকে তার চারপাশের আঙ্গিনা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার পাশাপাশি নাগরিক সেবা নিশ্চিত করা মাধ্যমগুলোর পক্ষ থেকে যথাসময়ে মশা নিধনসহ কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণে জোর তৎপরতা চালানো প্রয়োজন।
ডেঙ্গু প্রতিরোধে সাবধানতা বেশি প্রয়োজন। সেটা রাষ্ট্র কিংবা ব্যক্তি যে পর্যায়েই হোক। তবে আমরা ব্যক্তি হিসেবে কতটা সচেতন। বাড়ির চারপাশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে আমরা কয়জন ভ‚মিকা রাখি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘এপ্রিল থেকে অক্টোবর ডেঙ্গু ছড়ানোর বাহক এডিস মশার উপদ্রব বাড়ে। থেমে থেমে বৃষ্টির কারণে বিভিন্ন স্থানে জমে থাকা পানি এডিস মশার প্রজননের জন্য উপযোগী। এডিস মশার বংশবিস্তার ঠেকাতে বাড়ির আশপাশসহ পানি জমে থাকা স্থানগুলো পরিষ্কার রাখার পরামর্শ তাদের।’
ঢাকায় ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বেড়ে যাওয়ায় প্রশ্ন উঠছে দুই সিটি কর্পোরেশনের কার্যক্রম নিয়ে। ইতোমধ্যে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনে ৩ জন এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটিতে ২ জনের মৃত্যু খবর পাওয়া গেছে। এ ব্যাপারে ঢাকার দুই সিটি ও নগরবাসীর মধ্যে চলছে পাল্টাপাল্টি অভিযোগ। ঢাকা দুই সিটির স্বাস্থ্য বিভাগ বলছে, অনিয়ন্ত্রিত হারে ডেঙ্গু বাড়ার মূল কারণ হিসেবে জনসচেতনতার অভাবই দায়ী। স্বাস্থ্য বিভাগের মতে, ডেঙ্গুর প্রকোপ কিংবা প্রাদুর্ভাব নিয়ন্ত্রণে নিয়মিত ওষুধ ছিটানো হলেও শুধু জনসচেতনতার অভাবেই এটি নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। এর জবাবে নগরবাসী বলছেন উল্টো কথা।
তাদের অভিযোগ, মশা নিয়ন্ত্রণে সিটি কর্পোরেশন সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করছে না। নগরীর কোনো ওয়ার্ডে গত দেড়-দু’বছরে মশা নিধন কর্মীদের দেখা যায়নি বলে মত তাদের। আবার কোথাও কোথাও একবার ওষুধ ছিটালেও দীর্ঘদিন ধরে আর ওষুধ ছিটানোর কোনো লক্ষণ থাকে না। তারা বলছেন জনসচেতনতার ওপর দায় চাপিয়ে দুই সিটি ডেঙ্গুর প্রকোপ নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার দায় এড়াতে পারে না। আসলে এ ব্যর্থতা কার? সিটি কর্পোরেশন, সরকার না জনগণের! ঢাকা শহরের ডেঙ্গু সংক্রমিত হওয়ার খবর রাজধানীবাসীকে ভাবিয়ে তুলছে। ডেঙ্গু বিস্তারের উৎকণ্ঠিত সংবাদ দেখে মনে হচ্ছে- মশার উর্বর ভূমি গ্রামের কাদা, গর্ত ও নর্দমাযুক্ত অপরিচ্ছন্ন পরিবেশে বংশবৃদ্ধি করা ভাইরাসবাহী এই ক্ষুদ্র পতঙ্গটি গ্রাম ছেড়ে শহরে গিয়ে বাসা বেঁধেছে। ইট, বালু, কংক্রিটের শক্ত শহরে পরিত্যক্ত পানিতে প্রজননক্ষম মশারা মানুষকে কামড়িয়ে দেহে ছড়িয়ে দিচ্ছে ভাইরাস।
আর এ থেকেই ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। এখন প্রশ্ন হচ্ছে- তাহলে শহুরে পরিবেশ কি মশা বংশবৃদ্ধির উপযুক্ত স্থান? উত্তরটা হবে- শহর বলেই কি সেখানে পানি থাকবে না, অবশ্যই সেখানে পানি থাকবে। যেমন- ড্রেন, বিল্ডিংয়ের ছাদ, বাসা-বাড়ির যত্রতত্র বৃষ্টির পানি জমাট বেঁধে থাকতে পারে। আর সেই মশা নিরাপদ জায়গাতেই মশকদল ঝাঁকে ঝাঁকে বসে বংশবৃদ্ধির কাজটা বেশ আরাম-আয়েসেই সম্পন্ন করবে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে মশক নিধনে কার্যকরী কোনো পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে না। যাতে করে ভাইরাসবাহী এডিস মশার উপদ্রব বাড়ছে। আর ডেঙ্গুতে সংক্রমিত হচ্ছে মানুষ। এগুলো দেখার কেউ নেই।
ডেঙ্গু সংক্রান্ত এক রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ না থাকায় আদালত অসন্তোষ প্রকাশ করে বলেন, ‘মহামারি হতে বাকি নেই। বারবার বলার পরও ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সিটি কর্পোরেশন ব্যবস্থা নেয়নি। এরই মধ্যে ২১-২২ জন মারা গেছেন। কয়েক হাজার অসুস্থ। কিন্তু আপনারা বলছেন, কিছু হয়নি। কী করে একজন মেয়র বলেন যে কিছু হয়নি!’ আদালত বলেন, ‘মানুষ মারা যাচ্ছে। আর বলছেন, দুশ্চিন্তা নেই! কিন্তু যার সন্তান গেছে সেই বোঝে কী গেছে তার।
বাংলানিউজসিএ/ঢাকা / ২৩ জুলাই ২০১৯/ এমএম