যে কোন দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বৈদেশিক মুদ্রা বা ফরেন রেমিট্যান্স গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। পৃথিবীর বহুদেশে আজ বাংলাদেশীদের বসবাস। কেউ ব্যক্তিগত বিনিয়োগ, কেউ বা সঞ্চয়, আবার কেউ বা আত্নীয় পরিজনের প্রয়োজনে নিজ দেশে টাকা পাঠান। তথ্য প্রযুক্তির ব্যাপক প্রসারে একদা’র সময় সাপেক্ষ ও জটিল এই প্রক্রিয়াটি আজ খুবই সহজ ও অর্থনৈতিক ভাবে খরচ সাশ্রয়ী। পৃথিবীর যে কোন প্রান্ত থেকে বাংলাদেশের যে কোন অজ পাড়াগাঁয়ে আপনজনের হাতে অর্থনৈতিক সাহায্য তুলে দিতে আজ সময় লাগে মাত্র সর্বোচ্চ দশ মিনিট। নিরাপদ, খরচ সাশ্রয়ী ও সহজ লভ্য এই প্রক্রিয়াটি অনুসরণ না করে কানাডার মতো দেশে বসবাসকারী অনেক বাংলাদেশী এখনো হুন্ডির মাধ্যমে দেশে রেমিট্যান্স পাঠাতে আগ্রহী-এর কারণটি কি অর্থনৈতিক, সামাজিক নাকি যথাযথ সচেতনতার অভাব?
বিগত সাত বছর যাবত রেমিট্যান্স সার্ভিসের ব্যবস্থাপনার সাথে আমার সরাসরি সংশ্লিষ্টতা। এই সেবায় এক সময়ে ওয়েস্টার্ন ইউনিয়ন ও মানিগ্রাম সার্ভিসের চাহিদা প্রথম ও দ্বিতীয় অবস্থানে থাকলেও, গত তিন বছর যাবত এ অবস্থানটিতে ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। প্রক্রিয়াগত জটিলতা, বিনিময় হার, সার্ভিস ফি, রেমিট্যান্স পরিশোধের উপায়, এবং সেবার মান ইত্যাদি কারণে রিয়া রেমিট্যান্স (RIA Money Transfer) সার্ভিসের চাহিদা এখন সবার শীর্ষে। সুখের বিষয় হচ্ছে বাংলাদেশ সরকার বিভিন্ন বানিজ্যিক ও তফসিলী ব্যাংক সমুহকে গ্রামমুখী হওয়ার বাধ্যবাধকতা আরোপ করায়, গ্রামীণ এলাকায় ব্যাংকিং সেবার এখন যৌবনকাল চলছে। অনেকেই প্রশ্ন করতে পারেন, এটি কি অনুমান নির্ভর নাকি বাস্তব সম্মত? এ প্রশ্নের উত্তরে রেমিট্যান্স পাঠানোর প্রক্রিয়াটির একটির সংক্ষিপ্ত আলোচনা আবশ্যিক মনে করছি।
যখন কোন সেবা গ্রহীতা কোথাও অর্থ প্রেরণ করতে চান, এর প্রাথমিক শর্ত হচ্ছে, রেমিট্যান্স সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের সাথে একটি প্রোফাইল একাউন্ট খুলতে হয়। সেই ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট দেশের সরকার কর্তৃক ইস্যুকৃত ছবিযুক্ত পরিচয় পত্র প্রদান বাধ্যতামূলক। সাথে পেশা, জন্মতারিখ, বর্তমান ঠিকানাসহ আরও কিছু প্রয়োজনীয় তথ্য সরবরাহ করতে হয়। এন্টি মানি লন্ডারিং (AML Certified) প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত এবং ফিনট্রাক ( FINTRAC- The Financial Transactions & Reports Analysis Centre of Canada) এর বিধি–বিধান সম্পর্কে সুস্পষ্ট অভিজ্ঞতা সম্পন্ন একজন কর্মী যখন নিশ্চিত হন, গ্রাহক রেমিট্যান্স প্রেরণ করার যোগ্য, তখন রেমিট্যান্স গ্রহীতার তথ্য ও সংশ্লিষ্ট দেশ/স্থানের সেবা প্রদানকারী এজেন্সির তথ্য অনুসন্ধান করে প্রেরণকারীর পছন্দ অনুযায়ী আর্থিক সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানটি নির্বাচন করতে হয়। এক্ষেত্রে প্রেরণকারী একাউন্ট ডিপোজিট, ক্যাশ পিক-আপ, হোম সার্ভিস, মোবাইল ডিপোজিট (বিকাশ, রকেট, ইউ-পে ইত্যাদি) এর মতো যে কোন একটি অপশন বেঁচে নিতে পারেন।
বাংলাদেশে রেমিট্যান্স সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের শাখা সমূহ অনুসন্ধান করতে গিয়ে দেখেছি, আজকাল বাংলাদেশের যে কোন প্রত্যন্ত অঞ্চলেও ব্যাংকিং সেবা গ্রহণের সুযোগ বিদ্যমান। পার্বত্য এলাকার বরকল, টেকনাফের বাহারছড়া, পাথরঘাটার কাকছিড়া, দিরাইয়ের নাচনি’র মতো প্রত্যন্ত অঞ্চলেও আজ ব্যাংকিং সেবা সম্প্রসারিত হয়েছে। বিভিন্ন বানিজ্যিক ব্যাংকের এজেন্ট ব্যাংকিং ব্যবস্থা ও মোবাইল ব্যাংকিং এটিকে জনগণের দুয়ারে পৌঁছে দিয়েছে। আর সবচেয়ে সুখের কথা হচ্ছে, বাংলাদেশের সব কয়টি তফসিলি ও বানিজ্যিক ব্যাংক রিয়া রেমিট্যান্স সার্ভিসের বানিজ্যিক অংশীদার। এতো সবের পরেও যেটি সবচেয়ে আশ্চর্যজনক, বাংলাদেশী কানাডিয়ানদের অনেকেই ব্যাংকিং ব্যবস্থার পরিবর্তে ঝুঁকিপূর্ণ উপায়ে অর্থ প্রেরণে সাচ্ছন্দ্যবোধ করেন।
পরিসংখ্যান কানাডার তথ্য অনুযায়ী জনসংখ্যার ভিত্তিতে কানাডার তৃতীয় বৃহত্তম শহর ক্যালগেরি। এ শহরে আনুমানিক বিশ হাজারের মতো বাংলাদেশী বসবাস করেন। তুলনামূলকভাবে যে সংখ্যাটি ফিলিপিনো বংশোদ্ভূত অভিবাসী জনগোষ্ঠীর প্রায় সমান, কিন্তু রেমিট্যান্স প্রেরণের পরিসংখ্যানটি পর্যালোচনা করলে এর কোন সামঞ্জস্য খুঁজে পাওয়া ভার। এটি সত্যি যে, ফিলিপিনোদের অনেকে ওয়ার্ক পারমিট নিয়ে এদেশে কাজ করেন। পুরো অর্জিত অর্থই কি এরা নিজ দেশে প্রেরণ করেন নাকি এর অন্তরালে অন্য কোন কারণ নিহিত আছে?
জানুয়ারী ২০২২ এর রেমিট্যান্স তথ্যঃ
রিয়া( RIA) রেমিট্যান্স সার্ভিস
এডিএস এক্সিম লিমিটেড
ক্যালগেরি কানাডা
|
দেশের নাম |
প্রেরণকারীর সংখ্যা |
শতকরা হার |
|
ফিলিপাইন |
৪৯৭ |
৭৩% |
|
মেক্সিকো |
৮১ |
১২% |
|
কলাম্বিয়া |
৬১ |
৯% |
|
অন্যান্য দেশ (বাংলাদেশ সহ) |
৪২ |
৬% |
মোট রেমিট্যান্স প্রেরকের সংখ্যা =৬৮১
উপরের সারনীতে প্রদত্ত তথ্য বিশ্লেষণে এটি স্পষ্ট রেমিট্যান্স প্রেরণকারীদের তালিকায় ফিলিপিনোরাই শীর্ষে। বাংলাদেশসহ অন্যান্য দেশে জানুয়ারি মাসে রেমিট্যান্স প্রেরকের সংখ্যা মাত্র ৪২ জন শতকরা হারে যা ৬%। আরও নির্দিষ্ট করে উল্লেখ করতে হলে, বাংলাদেশীদের সংখ্যা মাত্র ৭ জন, শতকরা হারে যা ১.০২%। তাহলে বাংলাদেশীরা কি স্বদেশে অর্থ পাঠায় না, নাকি এদেশে আয় রোজগারে অন্যদের চেয়ে অনেক পিছিয়ে?
গর্বের সাথে উল্লেখ করতে চাই, কেলগেরীর বাংলাদেশী কমিউনিটি অন্য যে কোন কমিউনিটির চেয়ে শিক্ষা- দীক্ষা,জ্ঞান-গৌরবে অনেক সমৃদ্ধ। আমার ষোল বছরের জীবনে একজনকেও পাইনি যিনি রিফিউজি, ওয়ার্ক পারমিট বা রাজনৈতিক আশ্রয়ে এখানে অভিবাসী হয়েছেন। কিছু নগন্য সংখ্যক ছাত্র থেকে এখানকার অভিবাসী হলেও বাকিরা পেশাজীবি হিসেবে স্কিলড মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের আওতায়ই এখানকার অভিবাসী হয়েছেন, যাদের মধ্যে প্রকৌশলীদের সংখ্যাটিই সবচেয়ে বেশি,দ্বিতীয় অবস্থানে হয়তোবা ভূতাত্ত্বিকরা আছেন। এমন সমৃদ্ধ একটি কমিউনিটির আয় রোজগার কম, সেটি বলার উপায় কোথায়? তবে দুঃখজনক সত্য হলো, অনেক বাংলাদেশী এখনো অবৈধ পথে হুন্ডি প্রক্রিয়ায় দেশে অর্থ প্রেরণের পথকেই খুঁজে বেড়ান। গনপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ঘোষিত ২.৫% প্রণোদনা, উচ্চ বিনিময় হার আর নামমাত্র ন্যুনতম সার্ভিস চার্জের বিনিময়ে মাত্র দশ মিনিটে, যেখানে অত্যন্ত নিরাপদ উপায়ে অর্থ প্রেরণের ব্যবস্থা আছে, সেখানে কেন কষ্টার্জিত অর্থকে ঝুঁকিতে ফেলে এটি কোনভাবেই আমার বোধগম্য হয় না!!
প্রায়শই এমন অনেকের সংগেই সাক্ষাৎ হয়, যারা কানাডা সরকার কর্তৃক ইস্যুকৃত ছবি যুক্ত পরিচয় পত্র দিয়ে একাউন্ট প্রোফাইল খুলতে রাজী নন, আলোচনা শেষে বুঝা যায় উনারা হুন্ডি প্রক্রিয়ায় বিশ্বাসী। যখন আমাদের রেমিট্যান্স সার্ভিসের প্রক্রিয়াটি ব্যাখ্যা করা হয়, তখন কেউ কেউ সেবা প্রদানকারী কর্মীকে মৌখিক ভাবে নাজেহাল করতেও পিছপা হন না। ইদানীং হঠাৎ করেই হুন্ডির চাহিদাটি মনে হয় বড় বেশী বেড়ে গেছে।
গেল বছর এক ব্যক্তিগত সফরে টরন্টো গিয়ে বুঝতে পারি, হুন্ডি সেখানে ডাল-ভাত, চাইলেই হাতের কাছে পাওয়া যায়। টরন্টো শহরে গাড়িতে করে এক জায়গায় বেড়াতে যাচ্ছি, সফর সঙ্গী একজন অত্যন্ত প্রগতিশীল দেশপ্রেমিক মানুষ, একটি প্রগতিশীল সংগঠনের কানাডা শাখার দায়িত্বেও আছেন। পথিমধ্যে এক জায়গায় থামলেন, বিনয়ের সাথে বললেন, পাঁচ মিনিট সময় নেবেন, দেশে টাকা পাঠাবেন। বিস্ময়ের সাথেই লক্ষ্য করলাম তিনি গাড়িতেই বসে আছেন। কয়েক মিনিটের মধ্যেই এক ভদ্রলোক আসলেন, উনার হাতে দু’হাজার ডলার আর একটি ফোন নম্বর দিয়ে আল্লাহ হাফেজ বললেন। কথা প্রসঙ্গে জানতে পারি, উনি দেশে কোন এক নিকটাত্মীয়ের কাছে টাকা পাঠিয়েছেন। জানা শোনা প্রায় সবাই নাকি এভাবেই টাকা পাঠান! বুঝতে বাকি থাকে না হুন্ডি নামক মানি লন্ডারিংয়ের ব্যবসা টি সেখানে বেশ ভালোভাবেই শেকর গেঁড়েছে।
যদিও ক্যালগেরি শহরে এমন খোলামেলা দৃশ্য কখনো চোখে পড়েনি, তবে আজকাল প্রচুর রেমিট্যান্স প্রেরক ফোন করে টাকা পাঠাতে চান। প্রক্রিয়ার কথা জানালেই, উষ্মা প্রকাশ করে বলেন, “আমি অমুখ (!!) ভাইয়ের রেফারেন্সে ফোন করেছি, তমুকের (!!) কাছে এই নম্বরে টাকাটা পৌঁছে দেবেন, আমি কাল সকালে নগদ নিয়ে আসবো। আপনি তা না করে আমাকে হাইকোর্ট দেখান!” পাঠক আপনারাও বিস্মিত হবেন, এই রেফারেন্সের তালিকায় ধর্ম কর্ম করা সজ্জন মানুষ যেমন আছেন, এমন মানুষও আছেন, যারা পেশাজীবি ও কমিউনিটি সংগঠনের নেতৃত্ব দিচ্ছেন, বর্তমান শেখ হাসিনা সরকারের উন্নয়ন কর্মকান্ড নিয়ে বক্তৃতা বিবৃতি করে বেড়ান, নিজেদের আওয়ামী সরকারের উন্নয়নের ফেরিওয়ালা হিসেবে দেশপ্রেমিক বলেও দাবী করেন। কাজেই কানাডা থেকে বাংলাদেশের রেমিট্যান্সের চিত্রটি মোটেও সচেতনতা বোধের অভাব নয়, এর পেছেন যুক্তি নির্ভর কোন অর্থনৈতিক কারণ-ও নেই, এটি সামজিক ও রাষ্ট্রীয় দায়বদ্ধতার অভাবহেতু নিজস্ব স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্যেরই প্রতিফলন, নিজেদের নৈতিক মূল্যবোধের পরিবর্তন ছাড়া এমন অশুভ চিত্র বদলে দেয়া কঠিন!!
লেখকঃ কলামিস্ট, উন্নয়ন গবেষক ও সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষক
প্রবাস বাংলা ভয়েস/ঢাকা/ ১৭ মার্চ ২০২২ /এমএম





