Menu

জাতীয় অর্থনীতির পরিসংখ্যান অনুযায়ী মাথাপিছু আয় বেড়েছে। অব্যাহত প্রবৃদ্ধি আমাদের অর্থনৈতিক ভিত্তির শক্ত অবস্থানকেই নির্দেশ করছে, যদিও এর সুষম বণ্টন নিয়ে নানামুখী প্রশ্ন আছে। অর্থনৈতিক অগ্রগতির সাথে সাথে সামাজিক অস্থিরতার ইতিহাস প্রতিটি উন্নত সমাজব্যবস্থায়ই বিদ্যমান ছিল। পুঁজিবাদী বা ধনতান্ত্রিক সমাজে বিত্ত বৈভবের প্রতি অব্যাহত আকর্ষণ বা প্রতিযোগীতা নতুন কিছু নয়। তবে সামাজিক, ধর্মীয় ও পারিবারিক মূল্যবোধকে বিসর্জন দিয়ে অর্থনীতির অব্যাহত অসুস্থ প্রতিযোগিতা দিয়ে একটি উন্নত টেকসই সমাজব্যবস্থা বাস্তবায়ন কোনভাবেই সম্ভব নয়।

গত ক’দিন যাবত বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যম ও পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত দু’টি সংবাদ, ভীষণ মানসিক পীড়া আর উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠেছিল। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অর্জন করা মেধাবী তরুণ বগুড়ার ছেলে আলমগীর মাত্র দু’বেলা খাবারের বিনিময়ে ছাত্র পড়ানোর বিজ্ঞাপন সেঁটেছে দেয়ালে। মেধাবী এই তরুণটি অন্নকষ্টে দেয়ালিকার আশ্রয় নিয়েছে বলে অনেকেই বিশ্বাস করলেও কেউ কেউ যখন এতে রাজনীতির সংশ্রব খোঁজার চেষ্টা করেছেন, সচেতন মহলে উদ্বেগের শুরুটা তখনই। বাসন্তীকে জাল পেছিয়ে ৭৫-এ যে কালিমা লেপন করা হয়েছিল, কেউ কেউ এমন ষড়যন্ত্রের গন্ধও খোঁজে বেরিয়েছেন।

সত্যিকারের ক্ষুদার্ত একজন মেধাবী তরুণ যদি অপ-রাজনীতির শিকার হয়ে যান, এমন ভাবনায় আমার মতো অনেককেই খুঁড়ে খুঁড়ে খাচ্ছিল। বিধাতার অসীম কৃপা আর বগুড়া পুলিশের তৎপরতায় প্রমাণিত হয়েছে, এতে কোন অপ-রাজনীতি ছিল না। সরকারের স্বদিচ্ছা আর বাংলাদেশ পুলিশের মধ্যস্থতায় আটারো হাজার টাকা বেতনের চাকুরির সুবাদে সমস্যাটির আপাত সমাধান হলেও প্রশ্ন থেকে যায়, এটি কি সমাজ ব্যবস্থার একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা মাত্র?

অন্যদিকে নীলফামারীর মেধাবী তরুণ, হতদরিদ্র পরিবারের সন্তান নিপুণ মাত্র আট মিনিট দেরীতে উপস্থিত হওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি থেকে বঞ্চিত হয়েছিল। এক্ষেত্রে বিধিবিধানের কঠোরতায় কোন অশ্রদ্ধা না থাকলেও তথ্য ও যোগাযোগের সমন্বয়হীনতা প্রশ্নাতীত ছিলো না। প্রচার আছে, বাংলাদেশের ১৭ কোটি মানুষ ইন্টারনেট সেবার আওতাভুক্ত!! যথাযথ কর্তৃপক্ষ একবারও কি ভেবে দেখেছেন, ১৮ কোটি জনসংখ্যার দেশে কত পারসেন্ট জনগোষ্ঠী স্মার্ট ফোন ব্যবহারের সক্ষমতা রাখেন? কত সংখ্যক মানুষ সার্বক্ষনিক ওয়াইফাই বা ডাটা সুবিধা গ্রহণে অর্থনৈতিকভাবে সক্ষম?

আত্নীয় পরিজন, বন্ধু-বান্ধবসহ অনেককেই জানি যারা একটি স্মার্ট ফোন ব্যবহারের সক্ষমতা রাখেন না, আবার স্মার্ট ফোন থাকলেও ডাটা সুবিধা গ্রহণের সক্ষমতা নেই। একটা যথাযথ জরিপ পরিচালনা ব্যতিত সবাইকে ডাটা সুবিধা গ্রহণের আওতাভুক্ত হিসেবে ধরে নেয়া কি বাস্তবতা বিবর্জিত নয়? বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি যুদ্ধে উত্তীর্ণ হওয়া মোটেও কোন সহজ বিষয় নয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যাণে ভাইরাল হয়ে আর যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের মহানুভবতায় একজন নিপুণের ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলেও এমন আরও অনেক হারিয়ে যাওয়া নিপুণদের দায়িত্ব কে নেবে?

তৃতীয় ঘটনাটি বড়ই হ্রদয় বিদারক। একজন মধ্যবয়সী ব্যবসায়ী ফেসবুক লাইভে এসে নিজের মাথায় পিস্তল চালিয়ে আত্নহত্যার নিষ্ঠুরতম পথটি বেঁচে নিয়েছেন। ধানমন্ডির বিলাসবহুল ফ্ল্যাটের একাকী জীবনে হাফিয়ে উঠে এমন পথ বেঁচে নেয়া সমাজ জীবনে লুকিয়ে থাকা সংকটের কোন বিভৎস বহিঃপ্রকাশ নয় তো? এক সময়ের কৃষি ভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থায় পরিবর্তন হচ্ছে বহুমাত্রিক। মুক্তবাজার অর্থনীতির প্রতিযোগিতায় পরিবার প্রথায় আসছে পরিবর্তন। যৌথ পরিবারের বিলুপ্তি ঘটিয়ে নিউক্লিয়ার ভাবনা শক্তিশালী হচ্ছে। গ্লোবালাইজেশনের সুযোগে তরুণদের একটি বড় অংশ গ্রাম ছেড়ে শহরে, শহর ছেড়ে পাড়ি দিচ্ছে উন্নত বিশ্বে। সন্তানদের উপর প্রবীণদের নির্ভরশীলতার আদি সংস্কৃতির রীতিনীতি বিলুপ্ত হচ্ছে দ্রুত গতিতে। শহুরে জীবনের নানা সুবিধা আর রাজনীতি কে পূজি করে বিত্তশালীরা আরও বিত্তশালী হয়ে উঠছে, অপরদিকে কৃষি নির্ভর সমাজ প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে ক্রমান্বয়ে হতাশাগ্রস্ত হয়ে উঠছে। পরিবর্তনের এমন নানামুখী প্রবণতায় সামাজিক অস্থিরতার পাশাপাশি ব্যক্তি ও সমাজে ‘বিচ্ছিন্নতাবোধ’ প্রবল হয়ে উঠছে। যার অবশ্যম্ভাবী পরিণতিতে মানসিক ব্যাধিগ্রস্ততা কে বাড়িয়ে দিচ্ছে।

ফরাসি সমাজ বিজ্ঞানের জনক এমিল দুরখেইমের মতে, ‘আত্নহত্যা একটি মানসিক ব্যাধি, এর কারণও সমাজের মধ্যেই নিহিত, বিচ্ছিন্নতা যার প্রধান উপাদান।’ অর্থনৈতিক অগ্রগতির সাথে সাথে দ্রুত পরিবর্তনশীল অবস্থার সংগে খাপ খাওয়াতে না পেরে বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজ থেকে শহুরে সমাজ অবধি সকল স্তরেই বিচ্ছিন্নতাবোধের চরম প্রভাব লক্ষ্যনীয়। অর্থনৈতিক সক্ষমতার চরম বৈষম্যে একশ্রেণির জনগোষ্ঠী চরম মানসিক উদ্বিগ্নতার শিকার। আবার গ্লোবালাইজেশনের সুযোগে তরুণদের অতি ব্যক্তি-কেন্দ্রীকতায় সিনিয়র সিটিজেনদের নিঃসঙ্গতায় জন্ম হচ্ছে বিচ্ছিন্নতাবোধ।

ক্ষমতাবানদের সম্পদশালী হওয়ার প্রবণতা ক্ষমতাহীনদের মানসিক অস্থিরতাকে বাড়িয়ে দিচ্ছে বহুগুণে। শিল্প ভিত্তিক অর্থনীতির দাপটে কৃষি নির্ভর গ্রামীণ সমাজে বিরাজ করছে অস্থিরতা। অবারিত অর্থের সুযোগে একশ্রেণির তরুণ দামী ভদকায় শান্তি খুজে বেড়ায়। আবার দরিদ্র কৃষকের সন্তান বাবার জমি বিক্রি করে শিক্ষা জীবন শেষে চাকুরি না পেয়ে হতাশায় আচ্ছন্ন হয়ে অন্ধকার পথকে বেঁচে নেয়। সমাজবিজ্ঞানী এমিল দুরখেইম তার বিখ্যাত গবেষণামূলক গ্রন্থ ”The Suicide”এ বিভিন্ন তথ্য উপাত্তের ভিত্তিতে বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন, সমাজের বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গে যখন সংহতির অভাব প্রকট হয়ে উঠে তখনই আত্নকেন্দ্রীক আত্নহত্যা (Egoistic suicide) এবং নৈরাজ্যমূলক আত্নহত্যার (Anomic suicide) প্রবণতা বেড়ে যায়। ধানমন্ডিতে ঘটে যাওয়া ঘটনাটিকে বিচ্ছিন্নভাবে না দেখে সমাজ ব্যবস্থার পরিবর্তনে সংহতী বা বন্ধনের অভাবে সামাজিক সমস্যার একটি দৃষ্টান্ত হিসেবে দেখাটাই সমীচীন।

শুধুমাত্র অর্থনীতির সুচকে ঈর্ষান্বিত অর্জন, রাষ্ট্রীয় সক্ষমতাকে বাড়াবে বটে, তবে সেই সাথে কাঙ্খিত সামাজিক অগ্রগতি না হলে সেই উন্নয়ন টেকসই হবে না। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নয়নের সাথে সাথে সমাজ গবেষণায়ও সমভাবে মনোযোগী হওয়া চাই। দুঃখজনক হলেও সত্যি, আমাদের দেশের নীতি-কৌশলের নির্ধারকরা ব্যবসায়ী, শিল্পপতি, প্রকৌশলী, চিকিৎসকের মতো কারিগরি পেশাগুলোকে উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য মনে করলেও নীতি নির্ধারণে সমাজতাত্ত্বিক বা সমাজবিজ্ঞানীদের ভূমিকাকে গুরুত্বপূর্ণ মানতে নারাজ। বিষয়টি শুধু দুঃখজনক নয়, উদ্বেগজনকও বটে।

দ্রুত অর্থনৈতিক সক্ষমতা অর্জন করতে গিয়ে বাংলাদেশের সমাজব্যবস্থা কি ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ছে? বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা আর উচ্চ মাধ্যমিক অবধি অবৈতনিক শিক্ষা শুধুমাত্র এসব সামাজিক কর্মকান্ড কি সামাজিক ভারসাম্য রক্ষায় যথেষ্ট? মাদক, দুর্নীতি নির্মূলে শুধুমাত্র প্রশাসনিক পদক্ষেপই কি স্থায়ী সমাধান? উন্নয়নশীল দেশে জাতিসংঘ ঘোষিত এসডিজি অর্জনে কাগুজে পরিসংখ্যানই কি টেকসই উন্নয়নে অপরিহার্য? এসব প্রশ্নের বাস্তব সম্মত উত্তর পেতে প্রয়োজন ব্যাপক ভিত্তিক সামাজিক গবেষণা। সামাজিক গবেষণায় প্রাপ্ত ফলাফলের ভিত্তিতে নীতি নির্ধারণে প্রয়োজন মেগা-সামাজিক উন্নয়ন পরিকল্পনা ও এর যথাযথ বাস্তবায়ন। রীতিনীতি, সংস্কৃতি আর মূল্যবোধে প্রতিটি সমাজব্যবস্থাই ভিন্ন। তাই কোন আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রেসক্রিপশন বা কোন উন্নত দেশের সুনির্দিষ্ট মডেল অনুসরণ করে গৃহীত নীতি-পরিকল্পনা বাংলাদেশের সমাজব্যবস্থার ভারসাম্য রক্ষায় সংগতিপূর্ণ নাও হতে পারে।

বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বাস্তবায়নে বর্তমান সরকার বদ্ধপরিকর বলেই বিশ্বাস করি। যদি তাই হয়, বঙ্গবন্ধু তো কৃষক, শ্রমিক মেহনতী মানুষের ভাগ্যন্নোয়নের মাধ্যমে একটি শোষণহীন সুখী, সমৃদ্ধ সমাজব্যবস্থার স্বপ্ন দেখেছিলেন। তাই তো তিনি দৃপ্ত কন্ঠে ঘোষণা করেছিলেন, ‘পৃথিবী দুই ভাগে বিভক্ত, শোষক আর শোষিত ; আমি শোষিতের পক্ষে’। যে উন্নয়ন বৈষম্য কে বাড়িয়ে দিয়ে সামাজিক অস্থিতিশীলতার কারণ হতে পারে, পরিবর্তনের সঙ্গে সমন্বয়হীনতার কারণে সামাজিক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে বিছিন্নতাবোধ তৈরি হতে পারে,সে উন্নয়ন কি বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সাথে মানানসই? অর্থনৈতিক অগ্রগতির সাথে সাথে বহুমূখী টেকসই সামাজিক উন্নয়ন পরিকল্পনা ও এর যথাযথ বাস্তবায়ন ছাড়া একটি সুখী, সুন্দর, উন্নত সমাজব্যবস্থা বাস্তবায়ন অসম্ভব। তাই সামাজিক ভারসাম্য রক্ষায় সমাজবিজ্ঞানীদের অংশগ্রহণে ব্যাপক ভিত্তিক সামাজিক গবেষণার এখনি শ্রেষ্ঠ সময়। আর জাতীয় সামাজিক কর্ম পরিকল্পনা গ্রহণে গবেষণা ভিত্তিক তথ্য উপাত্তের সর্বোত্তম ব্যবহারই হতে পারে সামাজিক ভারসাম্য রক্ষার শ্রেষ্ঠতম উপায়।

লেখকঃ কলামিস্ট, উন্নয়ন গবেষক ও সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষক

প্রবাস বাংলা ভয়েস/ঢাকা/ ০৫ ফেব্রুয়ারি  ২০২২ /এমএম

 


Array