Menu

প্রবাস বাংলা ভয়েস ডেস্ক ::‌ মোবাইলের ক্রিং ক্রিং শব্দে গভীর রাতে মিস্টার আশিকের ঘুম ভেঙে গেল। ফোনের অপরপ্রান্ত থেকে অপরিচিত ব্যক্তি আগামীকাল সকালে শহরতলীর বাসস্টপে টাকা নিয়ে দেখা করতে বলছে। নইলে ফেসবুকে বাজে ছবি ছড়িয়ে দিবে।ফোন রেখে মিস্টার আশিক দ্রুত ফেসবুকে প্রবেশ করতে গিয়ে দেখলেন, লগ ইন করতে পারছেন না। বুঝতে পারলেন তার প্রোফাইল হ্যাক হয়েছে। ভীত মিস্টার আশিক সাইবার ক্রাইম ইউনিটের সহায়তা কামনা করলেন।

বাসার সামনে হইচই শুনে মিস্টার প্রশান্ত জানালা দিয়ে বাইরে তাকালেন। দেখলেন অসংখ্য মানুষ তার বাসার সামনে উন্মত্ত আচরণ করছে। প্রতিবেশী সেলিম সাহেব ফোনে জানালেন আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে ধর্মীয় বিদ্বেষ ছড়ানো হয়েছে। সবাই আপনার বিচার চাইছে। মিস্টার প্রশান্ত বুঝতে পারলেন না কিভাবে এসব হয়েছে। জনরোষ থেকে বাঁচার জন্য তিনি কাতর কণ্ঠে স্থানীয় পুলিশের সহায়তা চাইলেন।

মিসেস তাহমিনা সবে নতুন জীবনে পা রেখেছেন। কিছুদিন থেকে তার স্কুল বন্ধু ফোনে বিরক্ত করছে। আবার কখনো বা ফেসবুকে ইঙ্গিতপূর্ণ পোস্ট দিচ্ছে। আজ জানিয়েছে তার কথা না শুনলে ফেসবুকে তাদের অন্তরঙ্গ ছবি ছড়িয়ে দিবে। নিরুপায় মিসেস তাহমিনা সংসার টিকিয়ে রাখতে র্যাবের সহায়তা চাইলেন।

উপরোক্ত ঘটনাগুলো কাল্পনিক হলেও বর্তমানে এসব খুব স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম তথা ফেসবুক ব্যবহার করে এরকম ঘটনা প্রায় প্রতিদিন আমরা প্রত্যক্ষ করছি। যেমন- ফেসবুক অ্যাকাউন্ট হ্যাক হওয়া, ফেক আইডি খুলে আপত্তিকর ছবি- ভিডিও শেয়ার করে কারো চরিত্র হরণ করা, অন্যকে ফাঁসানোর উদ্দেশ্যে তার ছবি বিকৃত করা বা অন্যের ছবির সঙ্গে তার ছবি জুড়ে দেওয়া, অন্যের তথ্য ও বক্তব্য বিকৃত করে বা আংশিক ব্যবহার করে ব্ল্যাকমেইল করা, হুমকি দিয়ে টাকা আদায় করা, প্রশ্ন ফাঁস করে ফেসবুকে ছড়িয়ে দেওয়া, বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে ফাঁদে ফেলা, ডেটিং বা বন্ধুত্বের আহবানে বিপদে ফেলা, পর্নোগ্রাফি ছড়িয়ে দেওয়া, পুরনো প্রেমের প্রতিশোধ নেওয়া প্রভৃতি।

মোটকথা ফেসবুক বর্তমানে ধর্মীয়, জাতিগত, রাজনৈতিক, সামাজিক, এমনকি ব্যক্তিগত বিদ্বেষ চরিতার্থ করার প্লাটফর্ম হয়ে উঠেছে। মাঝে মাঝে মনে প্রশ্ন জাগে ফেসবুক কি সামাজিক যোগাযোগের ব্যাপ্তি বাড়াচ্ছে; নাকি অসামাজিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠছে!স্টাটিস্টার তথ্য অনুসারে ২০২১ সালে বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যা ছিল ১৬ কোটি ৬৩ লক্ষ। বিটিআরসি বলছে জানুয়ারি ২০২১ এ দেশে ইন্টারনেট গ্রাহকের সংখ্যা ছিল ১১ কোটি ২৭ লাখ।

আর বিটিআরসির তথ্য অনুযায়ী, নভেম্বর ২০২১ পর্যন্ত দেশে ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা ছিল ৫ কোটি ২০ লাখ। অর্থাৎ দেশে গড়ে প্রতি দুইজন মোবাইল গ্রাহকের মধ্যে একজন ফেসবুক ব্যবহার করে। এ সময় দেশে মেসেঞ্জার ব্যবহারকারীর সংখ্যা ছিল ৩ কোটি ৭৫ লাখ ২৭ হাজার। সামাজিক যোগাযোগের অনেক মাধ্যম থাকলেও বাংলাদেশে ফেসবুক সবচেয়ে জনপ্রিয়।

ডিসেম্বর ২০২১ এ প্রকাশিত স্ট্যাট কাউন্টারের একটি পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারকারীদের মধ্যে ৯২.৬৪ শতাংশ ফেসবুক, ৫.৪৭ শতাংশ ইউটিউব, ০.৫৮ শতাংশ টুইটার, ০.৪৯ শতাংশ লিঙ্কডইন, ০.৪৩ শতাংশ পিন্টারেস্ট, এবং ০.২৬ শতাংশ ইনস্টাগ্রাম ব্যবহার করে। স্বাভাবিকভাবেই বলা যায় এখানে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে যত ধরনের অসামাজিক কার্যকলাপ ঘটে, তার প্রায় সবই ফেসবুকের মাধ্যমে হয়ে থাকে।

এই বিপুলসংখ্যক ফেসবুক ব্যবহারকারীর বয়স, পেশা, শিক্ষাগত যোগ্যতা, লিঙ্গ, পছন্দ, সম্পর্কে বিস্তারিত জানা না গেলেও সাম্প্রতিক সময়ে ফেসবুকের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া গুজব ও ভুয়া খবরের পর সংঘটিত সংঘর্ষে মৃত্যু, হানাহানির ঘটনা ফেসবুক ব্যবহারকারীদের সাধারণ প্রবণতা সম্পর্কে একটি ধারণা তৈরি করে। রামুর বৌদ্ধ মন্দিরের ঘটনা, ভোলার বোরহানউদ্দিনের ঘটনা, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরের ঘটনা, পদ্মা সেতুর জন্য বলিদান এর মত কল্পিত ঘটনা এরকম কয়েকটি নিদর্শন মাত্র।

সাইবার ক্রাইম অ্যাওয়ারনেস ফাউন্ডেশনের একটি গবেষণা প্রতিবেদন অনুসারে, সোশ্যাল মিডিয়ায় একাউন্ট হ্যাকিং ২০১৯ এর ১৫.৩৫ শতাংশ থেকে প্রায় ১৩ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ২০২১ এ ২৮ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।একই গবেষণায় সাইবার অপরাধের বয়স ভিত্তিক বিশ্লেষণে দেখা গেছে, বেশিরভাগ শিকারের বয়স ১৮ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে, যা মোট শিকারের ৮৬.৯০ শতাংশ।

আর জেন্ডারভিত্তিক পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, সাইবার অপরাধের শিকার ভুক্তভোগীদের ৫১.১৩ শতাংশ নারী এবং ৪৮.৮৭ শতাংশ পুরুষ। ইউল্যাবের একটি গবেষণা বলছে ৭০ শতাংশের ও বেশি কিশোর-কিশোরী অনলাইনে সাইবার স্টকিং, গুণ্ডামি, ব্ল্যাকমেইলের মুখোমুখি হয়েছিল। যেখানে প্রায় ৭৫ শতাংশ ভুক্তভোগী তাদের সিনিয়র বা সহকর্মীদের কাছ থেকে হয়রানির শিকার হয়েছে।

সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেন এর তথ্য অনুসারে নভেম্বর-২০২০ থেকে অক্টোবর-২০২১ পর্যন্ত ফেক আইডি, আইডি হ্যাকিং, ব্ল্যাকমেইলিং, অশ্লীল বিষয়বস্তু সম্পর্কিত ১২ হাজার ৬৪১টি অভিযোগ নথিভুক্ত হয়েছে। উপরোক্ত পরিসংখ্যানগুলো ফেসবুক তথা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে অসামাজিক কার্যকলাপের ভয়াবহ ইঙ্গিত দিচ্ছে।

করোনার কারণে সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও প্রযুক্তি নির্ভরতা বেড়েছে। করোনায় গৃহবন্দি অবস্থায় অনলাইন কেনাকাটা, জুম মিটিং, অনলাইন ক্লাস এর সঙ্গে সঙ্গে ফেসবুক আসক্তি ও বৃদ্ধি পেয়েছে। এই সুযোগে কখনো অজ্ঞতা, কখনো অসচেতনতা , আবার কখনোবা কৌতূহলের বশবর্তী হয়ে কিশোর-কিশোরীরা অনলাইনে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে। ফলে পারিবারিক কাঠামোয় যেমন ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে; তেমনি সামাজিক অস্থিরতা ও বৃদ্ধি পাচ্ছে।ফেসবুকের মাধ্যমে এ ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের ক্রমবৃদ্ধির কারণ মনোবিদদের বিশ্লেষণের বিষয়। তবে অপরাধের ধরণ অনুযায়ী জনসচেতনতা তৈরি করা ও অপরাধ প্রতিরোধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণে সক্রিয় হতে পারলে হয়তো কিছুটা সুফল পাওয়া যেত।

আইসিটি বিভাগ প্রণীত সাইবার সিকিউরিটি স্ট্র্যাটেজির আলোকে সরকার নিরাপদ সাইবার স্পেস সংস্কৃতি গড়ে তোলার জন্য যে কর্মসূচি গ্রহণ করেছে তার অভিঘাত সমাজে তেমন দৃশ্যমান নয়। তাই অনলাইন প্রাইভেসি ও অনলাইন শিষ্টাচারসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া অনাকাঙ্ক্ষিত সংবাদ থেকে সঠিক সংবাদ আলাদা করতে পারার দক্ষতা ভিত্তিক কর্মসূচি প্রয়োজন।

এক্ষেত্রে শিক্ষা মন্ত্রণালয়, আইসিটি বিভাগ, এটুআই ও ফেসবুকের অংশীদারিতে প্রণীত ‘উইং থিংক ডিজিটাল’ কর্মসূচি সামাজিক যোগাযোগের দায়িত্বশীল ব্যবহারের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। অপরাধীদের আইনের আওতায় আনতে ও ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষকে প্রতিকার প্রদানে ইতোমধ্যে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮ প্রণয়ন করা হয়েছে। তবে বাস্তবতা হচ্ছে ভুক্তভোগীদের অধিকাংশই জানে না এর বিরুদ্ধে কিভাবে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হয়।ভুক্তভোগীদের অভিযোগ অনেক সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে জানিয়েও কোনো প্রতিকার পাওয়া যায় না। আবার অনেক সময় লোকলজ্জা ও জানাজানির ভয়ে ভুক্তভোগীরা আইনি প্রতিকারের পথ থেকে দূরে থাকেন।

তাই অমিত সম্ভাবনার এই যোগাযোগ মাধ্যম থেকে অসামাজিক কার্যকলাপ দূর করে সামাজিকতার পথে আনতে সঠিক আইনের যেমন প্রয়োজন; তেমনি প্রয়োজন আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগ। আইনি প্রতিকারের সহযোগিতা যেমন প্রয়োজন; তেমনি প্রতিকারের উপায় সম্পর্কে প্রচারণা প্রয়োজন। সাইবার লিটারেসি বৃদ্ধি প্রয়োজন। সঙ্গে সঙ্গে সাইবার অপরাধের মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার করা প্রয়োজন। ফেসবুক কেন্দ্রিক সাইবার অপরাধ নিয়ন্ত্রণে ফেসবুক কর্তৃপক্ষকেও জবাবদিহির আওতায় নিয়ে আসা প্রয়োজন। তবেই ফেসবুক আরও বেশি জনবান্ধব এবং আরও বেশি সামাজিক হয়ে উঠবে।

লেখক: অধ্যাপক মো. আব্দুল হাই, ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগ, সরকারি আজিজুল হক কলেজ, বগুড়া।

প্রবাস বাংলা ভয়েস/ঢাকা/ ১৮ জানুয়ারি  ২০২২ /এমএম

 


Array