মো. জাকির হোসেন
আদালতের রায় প্রদানের আগে ও পরে মামলার পক্ষ যতটুকু প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করতে পারে কিংবা যে ভাষা ব্যবহার করা সংগত, তা অতিক্রম করে আক্রমণাত্মক প্রতিক্রিয়া প্রকাশের একটি বিনাশী ধারা আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে নতুন মাত্রা ও শঙ্কা তৈরি করেছে। এ ধরনের প্রতিক্রিয়া প্রকাশ
আইনের শাসনের জন্য হুমকিস্বরূপ ও বিচারপ্রক্রিয়াকে চ্যালেঞ্জ জানানোর শামিল। আইনের শাসন ও গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠায় এটি কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না। মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের রায় ঘোষণার পর কোনো পক্ষের রায় প্রত্যাখ্যান, আর কোনো পক্ষের হরতাল আহ্বানের প্রতি বিচারপতিদের দৃষ্টি আকৃষ্ট হলে আদালত এ বিষয়ে মন্তব্য প্রকাশ করে বলেছেন যে এ ধরনের আচরণ আদালত অবমাননার শামিল। তাই সব পক্ষকে বিজ্ঞ আদালত সতর্ক ও সংযত থাকার পরামর্শ দেন। সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী মামলার রায় প্রকাশের পর আওয়ামী লীগ ও মহাজোট সরকারের কতিপয় মন্ত্রী, সংসদ সদস্য ও রাজনৈতিক নেতারা সংসদ ও সংসদের বাইরে যে ভাষায় প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন, তা কেবল অনভিপ্রেত ও অনাকাঙ্ক্ষিতই নয়, বরং কিছু ক্ষেত্রে তা স্পষ্টতই আদালত অবমাননার শামিল ছিল।
২০১৭ সালের ৫ আগস্ট জাতীয় প্রেস ক্লাবে নাগরিক ফোরাম আয়োজিত ‘নিরপেক্ষ, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন : প্রয়োজন রাজনৈতিক ঐক্য’ শীর্ষক আলোচনাসভায় বিএনপি নেতা ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ ষোড়শ সংশোধনী মামলার রায়ে মহাজোট সরকারের একজন মন্ত্রীর প্রতিক্রিয়ার জবাবে বলেছিলেন, সরকার বিচার বিভাগের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নামলে পরাজিত হবে। ষোড়শ সংশোধনী মামলার রায় নিয়ে অর্থমন্ত্রীর প্রতিক্রিয়াকে আদালত অবমাননার শামিল উল্লেখ করে সাবেক এই আইনমন্ত্রী বলেন, ‘অর্থমন্ত্রীর বক্তব্য প্রমাণ করে, বিচার বিভাগের প্রতি তাঁদের কোনো আস্থা নেই। তাঁরা বিচার বিভাগের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করেন না। এখন সরকার যদি মনে করে, তারা বিচার বিভাগের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নামবে, তাহলে আমি বলতে চাই যে সেই প্রতিযোগিতায় আপনারা পরাজিত হবেন। কারণ যারাই বিচার বিভাগের ওপর হাত দিয়েছে, সেই হাত পুড়ে যায়।’ সরকার পরিবর্তন হতে পারে; কিন্তু বিচার বিভাগের অস্তিত্ব, ইজ্জত-সম্মান, মর্যাদা সব সময় থেকেছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। ষোড়শ সংশোধনী মামলার রায়ে মহাজোট সরকার ও সরকারদলীয় নেতাদের প্রতিক্রিয়ায় বিচার বিভাগের স্বাধীনতার নামে বিএনপি উচ্চকিত থাকলেও খালেদা জিয়ার মামলায় বিএনপি বিচার বিভাগের প্রতি আক্রমণাত্মক অবস্থান নিয়েছে। মামলার রায় শোনার জন্য বেগম জিয়া আদালতে যাওয়ার পথে বিএনপির নেতাকর্মীদের সঙ্গে পুলিশের দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়েছে। মামলার রায়কে কেন্দ্র করে পুলিশের পাশাপাশি বিজিবি ও র্যাব নামানো হয়েছে। কিন্তু এত কড়াকড়ির পরও দফায় দফায় সংঘর্ষ দেখে মনে হচ্ছে নিরাপত্তার কড়াকড়ি না থাকলে নাশকতা হতেও পারত। সে ক্ষেত্রে ব্যাপক জানমালের ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা ছিল।
যা হোক, খালেদা জিয়ার মামলার রায় হয়েছে। তারেক জিয়াসহ অন্যান্য আসামিকে ১০ বছরের কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ড এবং বেগম জিয়াকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড প্রদান করা হয়েছে। বিএনপির আইনজীবীরা আদালতের রায়কে প্রত্যাখ্যান করেছেন। মিথ্যা মামলায় রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে খালেদা জিয়াকে সাজা দেওয়া হয়েছে বলে দাবি করেছেন। আদালতের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করেছেন, স্লোগান দিয়েছেন। বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রিজভী আহমেদ বলেছেন, চাকরি বাঁচাতে একজনকে খুশি করতে বিচারক এমন রায় দিয়েছেন। এ রায়কে তিনি প্রত্যাখ্যান করেছেন। কোন মামলা সত্য, না মিথ্যা, তা প্রমাণের জায়গা রাজনৈতিক দলের অফিস বা মাঠ-ময়দান নয়, এটি প্রমাণের জন্য একমাত্র উপযুক্ত স্থান আদালত। মামলার সত্য-মিথ্যা প্রমাণের দায়িত্ব রাজনৈতিক দলের নেতাদের ওপর নয়, বরং তা বিচারক ও আইনজীবীর ওপর।
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলার রায় যদিও একটি বিচারিক আদালতের মাধ্যমে ঘোষিত হয়েছে, বাস্তবে আমাদের উচ্চ আদালতেরও সম্পৃক্ততা রয়েছে এ মামলায়। বিএনপির আইনজীবীরা বিচারিক আদালতের বাইরে উচ্চ আদালতের শরণাপন্ন হয়েছেন ১৩ বার। মামলার শুরুতেই উচ্চ আদালতে চ্যালেঞ্জ করেছেন মামলা বাতিলের জন্য। আদালত বিএনপির আইনজীবীদের যুক্তিতর্কে সন্তুষ্ট না হয়ে মামলা চলতে বাধা নেই বলে আদেশ দিয়েছেন। এরপর ন্যায়বিচার না পাওয়ার আশঙ্কায় বিএনপির আইনজীবীরা উচ্চ আদালতে বিচারক পরিবর্তনের আবেদন করলে উচ্চ আদালত তিনবার তিনজন বিচারক পরিবর্তন করে দেন। চতুর্থবার বিচারক পরিবর্তনের আবেদন করলে উচ্চ আদালত তাতে রাজি হননি। দ্রুত বিচার আদালতের মামলা ৬০ কর্মদিবসের মধ্যে নিষ্পত্তির বিধান থাকলেও ১০ বছরব্যাপী ২৬১ কর্মদিবসে ৩২ জন সাক্ষীর সাক্ষ্যের ভিত্তিতে মামলার রায় প্রদান করা হয়। বিএনপির আইনজীবীরা ১৫৫ বার সময় প্রার্থনা করেছেন। দীর্ঘদিন ধরে সাক্ষীদের জেরা করেছেন। খালেদা জিয়া ও তাঁর আইনজীবীরা ২৮ দিন ধরে শুধু আত্মপক্ষ সমর্থনের যুক্তিতর্ক তুলে ধরেছেন। এর পরও কেন বিচারকের প্রতি ক্ষোভ? কেন বিচার ব্যবস্থার প্রতি হুমকি! বিচারের রায়কে কেন্দ্র করে বিএনপি এমন এক পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে যে নাশকতা ঠেকাতে পুলিশের পাশাপাশি বিজিবি, র্যাব নামাতে হলো। শঙ্কার কালো ছায়ায় তল্লাশির নামে সাধারণ মানুষ হয়রানির শিকার হলো। অনেক মানুষ বিনা দোষে, অপ্রয়োজনে গ্রেপ্তার হলো। পরিবহনব্যবস্থায় অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়ে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড স্থবির হলো। সাধারণ মানুষ অসহনীয় দুর্দশার শিকার হলো।
যে বিচারক বেগম জিয়ার মামলার বিচার করেছেন, তিনি তো কেবল এ মামলার বিচারের জন্য সরকার কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত হননি, বরং বেগম জিয়ার শাসনামলে ১৯৯৩ সালের ১ এপ্রিল তিনি বিচারক হিসেবে যোগদান করেন। দীর্ঘ ২৫ বছর ধরে তিনি হাজার হাজার মামলার রায় দিয়েছেন। কোনো দিন একবারের জন্যও তাঁর রায় নিয়ে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ শুনিনি। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলার বিচারক আমার সহপাঠী হওয়ার সুবাদে দীর্ঘ ৩৩ বছর ধরে তাঁর সঙ্গে পরিচয়, বন্ধুত্ব। বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে বা পরবর্তী সময়ে কখনোই তাঁকে কোনো রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হতে দেখিনি। তাহলে কেন পক্ষপাতিত্বের প্রশ্ন আসছে? কেন বিএনপি নেতারা বলছেন প্রধানমন্ত্রী যেমন চেয়েছেন, রায় তেমনই হয়েছে? এ দেশ কি তবে ভদ্র, শালীন, নিরপেক্ষ মানুষের জন্য ক্রমেই সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে? তর্কের খাতিরে বিএনপির যুক্তিকে যদি সত্যি ধরে নিই, তাহলেও প্রশ্ন থেকে যায়। বিচারিক আদালতের রায়ই তো শেষ কথা নয়। এরপর হাইকোর্ট বিভাগে আপিল করার, হাইকোর্ট বিভাগের রায়ে সন্তুষ্ট না হলে আপিল বিভাগে আপিল করার, আপিল বিভাগের রায়ের পর রিভিউ এবং সর্বশেষ রাষ্ট্রপতির মার্জনার সুযোগ রয়েছে। হাইকোর্ট বিভাগে আপিল দায়েরের জন্য বিএনপির আইনজীবীরা রায় ঘোষণার পরপরই বিচারিক আদালতের রায়ের সার্টিফায়েড কপির জন্য আবেদন করেছেন। আপিল দায়েরের সঙ্গে সঙ্গে বেগম জিয়ার জন্য জামিনের আবেদন করা হবে এবং আশা করা যায় তিনি জামিনও পাবেন। বেগম জিয়াকে আগামী নির্বাচন থেকে দূরে রাখার জন্য এমন রায় দেওয়া হয়েছে বলে বিএনপি নেতারা আশঙ্কা প্রকাশ করছেন। বিএনপি নেতাদের এরূপ আশঙ্কার কারণ হলো আমাদের সংবিধানের ৬৬(২)(ঘ) অনুচ্ছেদে বর্ণিত আছে, ‘কোন ব্যক্তি সংসদের সদস্য নির্বাচিত হইবার এবং সংসদ সদস্য থাকিবার যোগ্য হইবেন না, যদি তিনি নৈতিক স্খলনজনিত কোন ফৌজদারি অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হইয়া অন্যূন দুই বৎসরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন এবং তাঁহার মুক্তিলাভের পর পাঁচ বৎসরকাল অতিবাহিত না হইয়া থাকে।’ বিচারিক আদালতের রায়ে সাজা হলেই তিনি নির্বাচনের অযোগ্য হবেন কি না, এ বিষয়ে আমাদের আদালতের দুই রকম নির্দেশনা রয়েছে। তাই এ বিষয়ে আইনি লড়াইয়ের সুযোগ থাকছে। তদুপরি বিচারিক আদালতের দণ্ডাদেশ স্থগিত করার ক্ষমতা হাইকোর্ট ডিভিশনের রয়েছে।
বেগম জিয়াই একমাত্র রাজনীতিক বা প্রধানমন্ত্রী নন, যাঁর সাজা হলো। আমাদের দেশে সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী, অত্যন্ত জনপ্রিয় মুখ্যমন্ত্রী জয়ললিতাসহ ভারতের অনেক রাজ্য সরকার প্রধান, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইতালিসহ অনেক গণতান্ত্রিক দেশের সরকার ও রাষ্ট্র প্রধানরা দুর্নীতির দায়ে দণ্ডপ্রাপ্ত হয়েছেন। বেগম জিয়াসহ বিএনপি নেতারা প্রায়ই বলে থাকেন, বিএনপি ক্ষমতায় গেলে এ সরকারের প্রধানসহ অনেকের বিচার করা হবে। তাহলে বিএনপিকে নজির সৃষ্টি করতে হবে তারা আদালতের রায়ের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। বিএনপি যদি আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে আইনি লড়াইয়ের পরিবর্তে রাজনৈতিক যুদ্ধ ঘোষণা করে, তাহলে ভবিষ্যতে তারা ক্ষমতায় গেলে এটি নজির হয়ে বুমেরাং হয়ে ফিরে আসবে। আর এটি যদি চলতে থাকে, তা গণতন্ত্র, আইনের শাসন ও বিচার বিভাগের জন্য ভয়ানক অশনিসংকেত।
লেখক : অধ্যাপক, আইন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
zhossain@justice.com