প্রবাস বাংলা ভয়েস ডেস্ক :: করোনার ছোবলে দেশের মানুষের দুরবস্থার পাশাপাশি রাজনীতিরও বিপন্ন দশা হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের পারস্পরিক আচার-আচরণ, কথাবার্তা ইত্যাদি অনেকটাই সিকবেডে থাকা রোগীদের মতো। বড় দুটি দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সাধারণ সম্পাদক/মহাসচিব সাহেবরা যখন যেভাবে কথা বলেন, তাতে মনে হয় না তারা এত বড় দুটি দলের সেকেন্ড ইন কমান্ডে থেকে দল দুটিকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। বরং প্রতিদিনই তারা দায়সারা গোছের কিছু কথাবার্তা বলে চলেছেন।
সরকারি দলের সাধারণ সম্পাদক, যিনি সরকারের সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রীও বটে, তিনি যেমন প্রতিদিন একই ধরনের বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়ে চলেছেন, তেমনি বিএনপির মতো বড় দলের মহাসচিবও কিছু ছকবাঁধা বক্তব্য উপস্থাপন করে চলেছেন। তাদের বক্তৃতা-বিবৃতিতে শুধু একে অপরের ওপর দোষারোপ এবং দোষারোপ খণ্ডন করা ছাড়া অন্য তেমন কিছুই থাকে না। এ অবস্থায় তাদের উভয়ের কথাবার্তাতেই মনে হয় দেশে বা দেশের মানুষের অন্য কোনো সমস্যা নেই।
যদিও এতদিন মন্ত্রণালয়সহ অফিস-আদালত- প্রায় সবকিছুই খোলা রেখে রীতিমতো কাজকর্ম চালানো হয়েছে, রাস্তাঘাট-ব্রিজ-কালভার্ট ইত্যাদি সবকিছুর নির্মাণকাজ অব্যাহত রাখা হয়েছে আর এসব করতে সরকারের অঢেল অর্থও ব্যয় করা হয়েছে। এসব ক্ষেত্রে অপচয়ও কম কিছু হয়নি। তাছাড়া অফিস-আদালতে জনহয়রানি, ঘুস গ্রহণ এসব কর্মও অব্যাহত গতিতেই চলেছে। অথচ দল দুটির সেক্রেটারি পর্যায়ের নেতাসহ কারও কথাবার্তা বা বক্তৃতা-বিবৃতিতে এসবের কোনো প্রতিফলন নেই।
দেশের মানুষকে এই করোনা-দুর্যোগের সময়ও যে সরকারি সেবা পেতে কোনো কোনো মন্ত্রণালয় বা অফিস-আদালতে সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে, সেসব নিয়ে কারও কোনো মাথাব্যথা আছে বলেও মনে হয় না। বরং সরকারি দপ্তর-অধিদপ্তর, অফিস-আদালত ইত্যাদি সবকিছু আমলাতন্ত্রের হাতে লিজ দিয়ে সরকারি দল যেমন বগল বাজাচ্ছে, বিরোধী দলও ঠিক তেমনি হেলতে দুলতে যতদিন চলে নীতি গ্রহণ করেছে। তারাও সরকারের বিভিন্ন অসামঞ্জস্য, সরকারি অফিসে ঘুস-দুর্নীতি ইত্যাদি সরকারকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে।
যদিও বাজেট অধিবেশনে সরকারি দলের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য, প্রবীণ সংসদ সদস্য, বঙ্গবন্ধুর একান্ত সহচর তোফায়েল আহমেদ এমপি এবং জাতীয় পার্টির এমপি ফিরোজ রশিদ সরকারি আমলাতন্ত্র সংক্রান্ত কিছু কথা সেদিন সংসদে উত্থাপন করেছেন; কিন্তু সেসবই যে সব কথা নয়, তা বলাই বাহুল্য। বরং সেসব কথার বাইরে আরও যা ঘটে চলেছে, তা সরকারকে জনপ্রিয়তা যাচাই করতে হলে বোঝা যেত।
স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পর একজন ইউএনও ছাগলে গাছ খাওয়ার অপরাধে পার্শ্ববর্তী বাড়ির একজন বয়স্ক মহিলার ছাগল আটকে রেখে পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা করবেন, আর সেই পৌঢ় মহিলা দুই হাজার টাকা নিয়ে গিয়ে তার ছাগল ছাড়িয়ে আনতে অনুনয়-বিনয় করার পরও ইউএনও ছাগল না ছাড়ার কারণে ভুক্তভোগী মহিলা এক বুক কান্না নিয়ে বাড়ি ফিরলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আমরা তা জানতে পেরে ব্যথিত হবো- এমনটি কোনোদিনও ভাবিনি। এ ধরনের ইউএনও, মোবাইল কোর্ট পরিচালনাকারী ম্যাজিস্ট্রেট পদবি পাওয়া সরকারি আমলাদের আরও অনেক কীর্তিকাহিনি জানা থাকলেও এখানে শুধু আরেকটি ঘটনা উল্লেখ করতে চাই।
ঢাকা শহরে মোবাইল কোর্ট পরিচালনাকারী একজন ম্যাজিস্ট্রেট একটি ৬ তলা বাড়িতে গিয়ে রাজউকের কাগজপত্র দেখতে চাইলে বাড়িটির মালিক সম্পূর্ণ অংশ ভাড়া দিয়ে অন্যত্র বসবাস করায় ভাড়াটিয়ার কাছে যেসব কাগজ রাখা ছিল, আইন অনুযায়ী তা বৈধ থাকা সত্ত্বেও কোনো কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে এবং কোনো কথায় কর্ণপাত না করে ভাড়াটিয়াকে ১২ লাখ টাকা জরিমানা করেন।
এত বিরাট অঙ্কের টাকা জোগাড় করা কঠিন হলেও ভাড়াটিয়া বড় ব্যবসায়ী হওয়ায় এবং টাকা পরিশোধ না করলে ম্যাজিস্ট্রেট তাকে গ্রেফতার করে জেলে ঢোকানোর জন্য সঙ্গে থাকা পুলিশকে নির্দেশ দেওয়ায় তিনি বাধ্য হয়ে টাকা সংগ্রহ করে এনে অকুস্থলে পরিশোধ করেন। এভাবে জেলে যাওয়া থেকে রক্ষা পান ভাড়াটিয়া। অতঃপর এ ঘটনার পরদিন বাড়ির মালিক যাবতীয় বৈধ কাগজপত্র নিয়ে সেই ম্যাজিস্ট্রেটকে দেখালে ম্যাজিস্ট্রেট যে উক্তি করেন, তা অত্যন্ত আপত্তিজনক ও বিস্ময়কর। কারণ বাড়ির মালিককে তিনি বলেন, ‘আমরা এতদিন চাকরি করে ঢাকায় একটি ফ্লাট কিনতে পারলাম না, আর আপনি ছয়তলা বাড়ির মালিক’!
এ কথা শোনার পর বাড়ির মালিক তার মন-মানসিকতা বুঝতে পেরে সোজা পূর্তমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে লিখিত অভিযোগ দাখিল করেন এবং তাতেও কাজ না হলে তিনি উচ্চ আদালতে রিট করায় আদালত ম্যাজিস্ট্রেটের কার্যকলাপকে অবৈধ ঘোষণা করে নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। এখন প্রশ্ন হলো, এ ঘটনায় বাড়ির মালিক ও ভাড়াটিয়ার যে ভোগান্তি হলো, তার ক্ষতিপূরণ দেবে কে? বস্তুত এসব ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন সরকারকেই ক্ষতিপূরণ দিতে হয়।
কারণ, নির্বাচনের সময় জনগণ এসব অন্যায়-অবিচারের কথা মনে রেখে ভোট প্রদান করেন। আর যে সরকার এসব বিচার-বিবেকহীন ব্যক্তিকে চেয়ারে বসায়, ভুক্তভোগী ব্যক্তিদের ভোটও তাদের বিরুদ্ধেই পড়ে। ফলে দেখা যায়, একেকটি সরকার এক মেয়াদ পার করতে না করতেই জনপ্রিয়তা হারিয়ে ফেলে।
আমার আজকের লেখায় এসব বিষয় উল্লেখ করার কারণ হলো, বর্তমান অবস্থায় সরকার অত্যন্ত বেশি আমলানির্ভর হয়ে পড়েছে। দেশে এক ধরনের রাজনৈতিক শূন্যতার কারণেই এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। রাজনীতি সঠিক স্থানে না থাকার কারণে রাজনৈতিক নেতাদের অবস্থানও সঠিক স্থানে নেই। রাজনীতিবিদরা সঠিকভাবে তাদের দায়িত্ব-কর্তব্য পালন না করায় বা করতে না পারায় দেশে যে রাজনৈতিক শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে, একশ্রেণির আমলা সেই শূন্যতারই যথেচ্ছ সুযোগ গ্রহণ করে চলেছেন। যদিও অনেক আমলা কর্মচারী তাদের মেধা-দক্ষতার সদ্ব্যবহার করে সরকারি কাজকর্মে সহযোগিতা করে চলেছেন, কিন্তু
বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই একশ্রেণির সরকারি আমলা নিজেদের ব্যক্তিগত ফায়দা হাসিল করছেন। ফলে সরকারের একজন মন্ত্রীকেই জনসমক্ষে বলতে শোনা গেছে যে, বিদেশে অর্থ পাচারকারীদের অধিকাংশই সরকারি চাকরিজীবী।
কিন্তু তাই বলে বিদেশে অর্থ পাচারকারীদের তালিকায় রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ যে পিছিয়ে রয়েছেন, এমনটি বলারও কোনো সুযোগ নেই। কারণ বিদেশে সন্তান বা পরিবারের অন্য সদস্য পাঠিয়ে তাদের নামে ব্যবসা-বাণিজ্য-বাড়িঘর ইত্যাদি গড়ে
তুলে একশ্রেণির রাজনৈতিক ব্যক্তিও প্রচুর অর্থ বিদেশে পাচার করে নিয়ে সেখানে আরাম-আয়েশের ব্যবস্থা করে রেখেছেন। আর এভাবে কিছু সরকারি আমলা এবং রাজনৈতিক ব্যক্তি যুগ যুগ ধরে
তাদের অপকর্ম অব্যাহত রাখার কারণে এক্ষেত্রে আমলাচক্র নাকি রাজনৈতিক ব্যক্তিরা এগিয়ে- সেটিও একটা প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে।
উপসংহার টেনে বলতে চাই, স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দী পর দেশে এসব ঘটনা ঘটানো বা ঘটতে দেওয়া উচিত ছিল না। কোনোমতেই একশ্রেণির সরকারি আমলাকে অপকর্ম, দুর্নীতি করার সুযোগ দেওয়া উচিত হয়নি। আবার টেন্ডারবাজ, অস্ত্রবাজ, দুর্নীতিবাজ, সন্ত্রাসী ইত্যাদি শ্রেণির হাতেও রাজনীতির টিকিট তুলে দেওয়া ঠিক হয়নি।
বতর্মান অবস্থায় রাজনীতির টিকিটধারী ওই শ্রেণির ব্যক্তিরা যারা রাজনীতি করে খান, তাদের ক্ষমতা খর্ব করতে গিয়ে যা করা হচ্ছে বা হয়েছে, সে বিষয়টিও আরেকবার ভেবে দেখা প্রয়োজন বলে মনে করি। কারণ গোড়ায় গলদ রেখে একশ্রেণির রাজনীতি করে খাওয়া লোকের হাতে টিকিট ধরিয়ে দিয়ে যেভাবে তা সংশোধনের চেষ্টা করা হচ্ছে, সে কাজটিও ভুল কিনা সে বিষয়টিও ভেবে দেখা প্রয়োজন।
কিছুদিন আগে পৌর আওয়ামী লীগের একজন ওয়ার্ড সভাপতি আমাকে জানালেন, তার সামনেই একজন ইউএনও বলেছেন, ‘সরকারি ক্যাডার সার্ভিসের একজন ইউএনওর ওপর উপজেলা চেয়ারম্যান মাতব্বরি করতে চায়, সাহস কত’! আবার ক্যাডার সার্ভিসে কর্মরত আমার এক আত্মীয় বললেন, ‘অবৈধ পথে অর্জিত অর্থ কোথায় কিভাবে রাখা যায়, একশ্রেণির সরকারি আমলার সেটাই এখন প্রধান সমস্যা।
বর্তমান অবস্থায় টাকা রোজগার কোনো সমস্যা নয়, কারণ তাদের সামনে টাকার স্রোত বয়ে চলেছে। সরকারি আশ্রয়ণ প্রকল্পে পর্যন্ত যেসব ইট, কাঠ ইত্যাদি মালামাল ব্যবহার করা হয়েছে এবং হচ্ছে তাতেও বরাদ্দকৃত অর্ধেক অর্থই লোপাট হয়ে যাচ্ছে। সুতরাং অল্প কিছুদিন পরই ভূমিহীন মানুষের মধ্যে বণ্টনকৃত এসব ঘরবাড়ির বেহাল দশা দেখতে পাওয়া যাবে।’
এ বিষয়ে একটি উপজেলার প্রশাসনিক কর্মকর্তাও আমাকে জানিয়েছেন কিভাবে একজন ইউএনও সবাইকে পাশ কাটিয়ে ইটখোলা মালিককে ডেকে এনে নিজেই তৃতীয় শ্রেণির ইট কিনে সেসব দিয়ে আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর তৈরি করিয়ে তা প্লাস্টার ও রং করে ঢেকে দিয়ে প্রকল্পের টাকা ভাগাভাগি করে নিয়েছেন। এসব নিয়ে এই পরিসরে আর কিছু বলার সুযোগ নেই বিধায় এ বিষয়ে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করার পাশাপাশি রাজনীতি যাতে যথাস্থানে ফিরে আসে সে বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানাচ্ছি।
ড. মুহাম্মদ ইসমাইল হোসেন : কবি, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট
প্রবাস বাংলা ভয়েস/ঢাকা/ ০৪ জুলাই ২০২১ /এমএম





