প্রবাস বাংলা ভয়েস ডেস্ক :: দেশে করোনার লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি অত্যন্ত উদ্বেগের বিষয়। তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, বাংলাদেশে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ প্রথম ঢেউয়ের চেয়ে অনেক ভয়াবহ এবং তা দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার আশঙ্কা বেশি। স্প্যানিশ ফ্লু-র ক্ষেত্রেও দ্বিতীয় ঢেউটি প্রথম ঢেউয়ের চেয়ে অনেক ভয়াবহ ছিল। এ সংকট থেকে উত্তরণের জন্য প্রয়োজন সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতির কারণগুলোর বিশ্লেষণ এবং দ্রুত এর বিজ্ঞানভিত্তিক সমাধান।
সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতির কারণ
গত বছরের ৮ মার্চ দেশে প্রথম রোগী শনাক্তের পর থেকে জুলাই-আগস্ট মাস পর্যন্ত আক্রান্তের হার বাড়তে থাকে। এরপর সেপ্টেম্বর থেকে তা কমতে শুরু করে এবং এ বছরের শুরুতে অনেকটা নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। মার্চ থেকে অতি উচ্চ হারে সংক্রমণ ও মৃত্যুহার বাড়তে থাকে। লকডাউন শুরু হওয়ার পর মানুষ টেস্ট কম করায় দৈনিক শনাক্তের সংখ্যা দেখে সংক্রমণের প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যাচ্ছে না। তবে দৈনিক মৃত্যুসংখ্যা, শনাক্তের হার এবং হাসপাতালে ভর্তির সংখ্যা-এ সূচকগুলোর গতিপ্রকৃতি দেখে এটি স্পষ্ট যে, সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের বাইরে।
করোনার ঊর্ধ্বগতির কারণ মূলত দুটি। প্রথমত, দেশে অধিক সংক্রমণক্ষম ভ্যারিয়েন্টগুলোর প্রবেশ এবং দ্বিতীয়ত, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলায় মানুষের অনীহা। সীমান্ত সময়মতো কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ না-করায় দেশে বিপজ্জনক ভ্যারিয়েন্টগুলো প্রবেশ করেছে। দেশে দক্ষিণ আফ্রিকা ও যুক্তরাজ্যের ভ্যারিয়েন্ট ব্যাপক হারে ছড়িয়ে পড়ার প্রমাণ পাওয়া গেছে।
আইসিডিডিআর,বির এক গবেষণা অনুযায়ী, মার্চের চতুর্থ সপ্তাহে সংস্থাটির করা নমুনা পরীক্ষার প্রায় ৮১ শতাংশ ক্ষেত্রে দক্ষিণ আফ্রিকার ভ্যারিয়েন্টের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। দক্ষিণ আফ্রিকার ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণ ক্ষমতা বেশি এবং অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিন এ ভ্যারিয়েন্টের বিপক্ষে তেমন কার্যকর নয়। পাশাপাশি জিনোম সিকোয়েন্সিং ও সার্ভিলেন্সের সীমাবদ্ধতার কারণে দেশের আগের ধরনটি মিউটেশন হয়ে মারাত্মক সংক্রমণ করছে কি না, সে বিষয়েও নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না।
পাশাপাশি এ বছরের শুরুতে সংক্রমণের হার কমে আসায় এবং ভ্যাকসিনের আবির্ভাবের কারণে অধিকাংশ মানুষের মাঝে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলায় অনীহা পরিলক্ষিত হয়। জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে নানা ধরনের সামাজিক অনুষ্ঠান এবং জনসমাগমের আয়োজন করতে দেখা যায়। পাশাপাশি পর্যটনকেন্দ্রগুলোয়ও দেখা যায় উপচে পড়া ভিড়। এ ধরনের অনিয়ন্ত্রিত জমায়েত সংক্রমণ বৃদ্ধিতে ভূমিকা রেখেছে।
করোনা সংক্রমণের সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ চিত্র
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের কোভিড মডেল কনসোর্টিয়ামের সঙ্গে করা প্রজেকশন মডেল থেকে (এ লেখার একজন লেখক ওই কনসোর্টিয়াম সঙ্গে জড়িত) দেখা যায়, লকডাউন যদি ১-২ সপ্তাহ থাকে তাহলেও সংক্রমণের যে ঊর্ধ্বগতি তা অব্যাহত থাকতে পারে। যেমন মে মাসের প্রথম/দ্বিতীয় সপ্তাহ নাগাদ দৈনিক শনাক্তের সংখ্যা প্রায় আট-নয় হাজার হতে পারে। তবে পর্যাপ্ত পরীক্ষা করা না-গেলে সে সংখ্যা সরকারিভাবে কমও রিপোর্ট হতে পারে। এ ঊর্ধ্বগতি যদি অব্যাহত থাকে, তাহলে বর্তমানে হাসপাতালে শয্যা ও আইসিইউর যে চাহিদা, তা আরও প্রায় ২০ শতাংশ বাড়তে পারে। যেহেতু ইতোমধ্যেই হাসপাতালের শয্যা ও আইসিইউর সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে; সেহেতু সংক্রমণ আরও বাড়লে পরিস্থিতি অত্যন্ত নাজুক হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
করোনা মহামারি নিয়ন্ত্রণে করণীয়
করোনাভাইরাসের উচ্চ সংক্রমণ, দেশে বিপজ্জনক ভ্যারিয়েন্ট ছড়িয়ে পড়া এবং হাসপাতালগুলো রোগীতে পূর্ণ হয়ে ওঠার পরিপ্রেক্ষিতে দেশে লকডাউন ধরনের বিধি-নিষেধে দেওয়ার বিকল্প ছিল না। তবে যে কোনো দেশের জন্যই লকডাউন বাস্তবায়ন করা অত্যন্ত কঠিন কাজ। এজন্য প্রয়োজন শক্তিশালী পরিকল্পনা, যথাযথ প্রয়োগ এবং সঠিক সমন্বয়।
সম্প্রতি ঘোষিত ‘লকডাউন’ ধরনের বিধিনিষেধে পূর্বপরিকল্পনার ঘাটতি থাকায় দুটো সমস্যা দেখা দিয়েছে। এক. নিম্ন আয়ের মানুষের গ্রামমুখী যাত্রার কারণে গ্রামে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। দুই. লকডাউনের কারণে মানুষ টেস্ট কম করায় বর্তমানে সংক্রমণের প্রকৃত চিত্রটি বোঝা যাচ্ছে না। ভবিষ্যতে সরকারকে আন্তঃজেলা চলাচল নিয়ন্ত্রণ এবং জনগণের মাঝে টেস্ট করার প্রবণতা বাড়াতে বিশেষভাবে পরিকল্পনা নিতে হবে। জনগণের মাঝে টেস্ট করার প্রবণতা বাড়াতে সরকারিভাবে বিনা মূল্যে পিসিআর টেস্ট করা উচিত।
ভারতের মতো বাংলাদেশেও অ্যান্টিজেন টেস্ট করার সংখ্যা অনেক বাড়ানো উচিত। পাশাপাশি ঈদের সময় আবারও সব ধরনের জনসমাগম সম্পূর্ণ নিষেধ করে বিধিনিষেধ আরোপ করতে হবে। বিভিন্ন দেশে বড় ধরনের ধর্মীয় ও সামাজিক উৎসবের (ক্রিস্টমাস, ইস্টার) সময় সংক্রমণ অনেক বেড়ে গেছে। এ কারণে ইতালি, কানাডাসহ বিভিন্ন দেশ এসব সামাজিক উৎসবের আগে সাময়িক লকডাউনসহ নানা নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে।
বাংলাদেশের আর্থসামাজিক বিবেচনায় দু-তিন সপ্তাহের বেশি লকডাউন দেওয়া কঠিন হবে। তাই দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। সংক্রমণ কিছুটা কমে এলে দীর্ঘমেয়াদে দুই ধরনের পরিকল্পনা করতে হবে। প্রথমটি হলো সামাজিক এবং দ্বিতীয়টি অর্থনৈতিক।
গবেষণায় দেখা গেছে, করোনাভাইরাস বেশি ছড়ায় জনসমাগম থেকে। তাই দৈনিক সংক্রমণের হার ১০ শতাংশের নিচে নেমে আসার আগপর্যন্ত সব ধরনের সামাজিক অনুষ্ঠান, কমিউনিটি সেন্টার, পিকনিক, বিনোদনমূলক কার্যক্রম, রাজনৈতিক জনসভাসহ সব ধরনের জনসমাগম নিষিদ্ধ করতে হবে। অর্থাৎ, দীর্ঘ সময়ের জন্য জনসমাগম ও সামাজিক অনুষ্ঠানের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে হবে। তবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে সীমিত আকারে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড চালানো যেতে পারে। এক্ষেত্রে একাধিক শিডিউলে রোটেশনের ভিত্তিতে অনধিক ৫০ শতাংশ মানুষ দিয়ে অফিস-আদালত, কলকারখানা চালু রাখা যেতে পারে। এর ফলে মানুষের উপস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা যাবে, অন্যদিকে পরিবহণ সমস্যাও লাঘব হবে।
বিভিন্ন দেশের অভিজ্ঞতা
বিভিন্ন দেশের গৃহীত পদক্ষেপ বিশ্লেষণ করে এ বিষয়টি খুবই পরিষ্কার যে, করোনা নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রয়োজন ধাপভিত্তিক প্রতিরোধ ব্যবস্থা (Phased Approach)। স্বাভাবিক জীবনযাত্রা থেকে হঠাৎ করে লকডাউন-এ পদ্ধতিতে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। অধিকাংশ দেশ জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিয়ে একটি ডিসিশন-ম্যাট্রিক্স তৈরি করেছে, যা সংক্রমণের মাত্রার সঙ্গে সঙ্গে কার্যকরী সিদ্ধান্ত আগে থেকেই নির্ধারণ করে রাখে। এর ফলে সংক্রমণের মাত্রা পরিবর্তন হলে দেশগুলো খুব দ্রুত সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে। বিভিন্ন দেশের গৃহীত পদক্ষেপ পর্যবেক্ষণ করে বাংলাদেশের জন্য নিচের ‘ধাপভিত্তিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা’ অনুসরণ করা যেতে পারে-
প্রথম ধাপ (রেস্ট্রিকশন: দৈনিক শনাক্তের হার ৫-১০ শতাংশ): ঘরের বাইরে জনসমাগম ১০০ জন এবং অভ্যন্তরীণ জমায়েত ৫০ জনের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা। স্বাস্থ্যবিধি মেনে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ও অফিস-আদালত পরিচালনা করা।
দ্বিতীয় ধাপ (নিয়ন্ত্রণ: দৈনিক শনাক্তের হার ১০-২০ শতাংশ অথবা কোভিড রোগীর জন্য বরাদ্দকৃত আইসিইউ ৬০ শতাংশের চেয়ে অধিক পূর্ণ): সব ধরনের জনসমাবেশ, সামাজিক ও বিনোদনমূলক কার্যক্রম নিষিদ্ধ; আন্তঃজেলা চলাচল সীমিত করা; ব্যবসাগুলোকে বিধিনিষেধের আওতায় পরিচালিত করার অনুমতি দেওয়া। সংক্রমণের মাত্রা বিবেচনা করে বিভিন্ন জেলায় অঞ্চলভিত্তিক বিধিনিষেধ আরোপ করা।
তৃতীয় ধাপ (লকডাউন: দৈনিক শনাক্তের হার ২০ শতাংশের বেশি ও ঊর্ধ্বমুখী এবং কোভিড রোগীর জন্য বরাদ্দকৃত আইসিইউ ৮০ শতাংশের চেয়ে অধিক পূর্ণ): জরুরি কাজে নিয়োজিত ব্যক্তি/প্রতিষ্ঠান ছাড়া সব ভ্রমণ, ব্যবসা ও অন্যান্য কর্মকাণ্ড এবং জনসাধারণের চলাচলের ওপর সম্পূর্ণ নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে কমপক্ষে দুই সপ্তাহের জন্য দেশজুড়ে লকডাউন।
হাসপাতালগুলোর সক্ষমতা বাড়ানো
মহামারি নিয়ন্ত্রণের একটি মৌলিক নীতি হলো সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করার ওপর সর্বাত্মক গুরুত্বারোপ করা, যাতে হাসপাতাল/আইসিইউতে সেবা দিতে হবে এমন রোগীর সংখ্যা দেশের হাসপাতালগুলোর সামর্থ্যরে বাইরে চলে না-যায়। মহাখালীতে নতুন করোনা হাসপাতাল স্থাপন একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ; কিন্তু সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব না-হলে ভবিষ্যতে একসঙ্গে এত মানুষকে চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হবে না। ক্রমবর্ধমান রোগীর চিকিৎসা নিশ্চিত করতে ঢাকা, চট্টগ্রামসহ অধিক সংক্রমিত এলাকায় ‘ফিল্ড হাসপাতাল’ স্থাপন করতে হবে।
বর্তমানে জেলা ও বিভাগগুলো থেকে রোগীরা ঢাকায় চলে আসায় রাজধানীতে প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি হচ্ছে এবং রাস্তাতেই অনেক রোগীর অবস্থা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। ক্রমবর্ধমান কোভিড রোগীর চিকিৎসা নিশ্চিত করতে জেলা সদরের সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালগুলোয় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। জেলা পর্যায়ের হাসপাতালগুলোয় হাই-ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা অক্সিজেন সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে।
আইন অমান্যে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা
কেউ বিধিনিষেধ অমান্য করলে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। তবে নিম্ন আয়ের মানুষকে জরিমানা না-করে কেবল মৌখিকভাবে সতর্ক করা উচিত। একদিকে ফ্রি মাস্ক বিতরণ করতে হবে, অন্যদিকে মাস্ক না-পরলে জরিমানা করতে হবে। এক্ষেত্রে ভারতের উত্তর প্রদেশের উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে-উত্তর প্রদেশে মাস্ক ছাড়া কেউ বাইরে এলে প্রথমবার ১০০০ এবং দ্বিতীয়বার ১০০০০ রুপি জরিমানার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
জনসচেতনতা বৃদ্ধির জন্য স্থানীয় নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের সম্পৃক্ত করা
করোনা নিয়ন্ত্রণে জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ জরুরি। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ক্ষেত্রে জনগণকে অনুপ্রাণিত করতে সরকারের নীতিনির্ধারক, প্রচারমাধ্যম, স্বেচ্ছাসেবক, স্থানীয় নেতৃবৃন্দ, জনস্বাস্থ্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গসহ সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে। মানুষের মধ্যে সাবধানতা তৈরি করতে বিপজ্জনক ভ্যারিয়েন্টগুলো সম্পর্কে জনগণকে সম্যকভাবে অবগত করা প্রয়োজন।
অধিক পরিমাণ জিনোম সিকোয়েন্সিং
বিপজ্জনক ভ্যারিয়েন্টগুলো শনাক্ত করার জন্য দেশে অধিক পরিমাণ জিনোম সিকোয়েন্সিং করতে হবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও অধিক পরিমাণে জিনোম সিকোয়েন্সিং করার উপদেশ দিয়েছে। এ ছাড়া বিভিন্ন ভ্যারিয়েন্ট দ্বারা অধিক সংক্রমিত এলাকা বা জেলা চিহ্নিত করতে এবং এসব এলাকায় করোনার বিস্তার রোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য বিশদভাবে ভ্যারিয়েন্ট সার্ভেইল্যান্স করা প্রয়োজন।
নিম্ন আয়ের মানুষকে সহায়তা
উন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে তথা বাংলাদেশে নিম্ন আয়ের মানুষের সংখ্যা অনেক বেশি। তা ছাড়াও দেশের শহরগুলোয় নিম্ন আয়ের ও ভাসমান লোকের সংখ্যাও অনেক বেশি। লকডাউন দেওয়ার ফলে এ ব্যাপক জনগোষ্ঠী শহর থেকে গ্রামমুখী হয়। এর প্রধান দুটি কারণ: এক. শহরে আয়ের ব্যবস্থা না-থাকা এবং দুই. শহরে বিপদে সহায়তা পাওয়ার সম্ভাবনা অত্যন্ত কম থাকা। তাই যে কোনো লকডাউনে শহর থেকে গ্রামমুখী মানুষের ঢল নামে, যা সংক্রমণ আরও বাড়িয়ে দিতে পারে। তাই শুধু গ্রাম নয়, শহরের নিম্ন আয়ের মানুষের তালিকা করাও অত্যন্ত জরুরি; যাতে তাদের প্রয়োজনীয় সহযোগিতা দেওয়া যায়। পাশাপাশি নিম্ন আয়ের মানুষকে টিসিবি থেকে কার্ড তৈরি করে তাদের কাছে কম মূল্য নিত্যপণ্য বিক্রি করা যায়। এ তালিকা করার জন্য প্রয়োজনে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ও এনজিওর সহযোগিতা নেওয়া যেতে পারে।
মহামারি নিয়ন্ত্রণে ভ্যাকসিন
মহামারি নিয়ন্ত্রণের কার্যকরী সমাধান হলো বড় জনগোষ্ঠীকে টিকার আওতায় আনা। ইতোমধ্যে ইসরাইল এবং মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত দেশ যুক্তরাজ্য বিশাল জনগোষ্ঠীকে ভ্যাকসিন প্রদানের মাধ্যমে মহামারিকে অনেকটা নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়েছে। বিভিন্ন দেশ বয়স্ক এবং নানা জটিল রোগে আক্রান্ত মানুষকে ভ্যাকসিনের আওতায় এনে মৃত্যুহার অনেকটা কমাতে পেরেছে। বাংলাদেশেও অধিকাংশ বয়স্ক ও জটিল রোগে আক্রান্ত মানুষকে ভ্যাকসিন দিলে করোনাজনিত মৃত্যুহার কমে আসবে। ভ্যাকসিন গ্রহণে অনীহা দূরীকরণে বিজ্ঞানভিত্তিক তথ্য পৌঁছে দেওয়া অত্যন্ত জরুরি।
টিকা প্রয়োগের ক্ষেত্রে বেশিরভাগ দেশই একাধিক ভ্যাকসিনকে তাদের কর্মসূচির আওতায় রেখেছে। বাংলাদেশ জনসন অ্যান্ড জনসনসহ বিভিন্ন উৎস থেকে ভ্যাকসিন সংগ্রহের জন্য কূটনৈতিক তৎপরতা চালাতে পারে। আবিষ্কৃত সব ভ্যাকসিনের মাঝে ‘জনসন অ্যান্ড জনসনে’র ভ্যাকসিনটি দক্ষিণ আফ্রিকার ভ্যারিয়েন্টের বিপক্ষে সবচেয়ে বেশি (মারাত্মক রোগের বিরুদ্ধে ৮২ শতাংশ) কার্যকর।
আমাদের অবশ্যই অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিন গ্রহণ করা অব্যাহত রাখতে হবে। কারণ, এটি করোনার অরিজিনাল স্ট্রেইন এবং অন্য ভ্যারিয়েন্টগুলো থেকে প্রতিরক্ষা দেয় এবং দক্ষিণ আফ্রিকার ভ্যারিয়েন্ট দ্বারা গুরুতর অসুস্থতার বিরুদ্ধে সুরক্ষা প্রদানে সহায়ক বলে ধারণা করা হচ্ছে।
শেষ কথা
দেশের আর্থসামাজিক বাস্তবতায় দীর্ঘমেয়াদে লকডাউন কার্যকর করা অত্যন্ত কঠিন। তাই নিজেদের প্রতিরক্ষার জন্য সবাইকে কঠোরভাবে মেনে চলতে হবে স্বাস্থ্যবিধি-মাস্ক পরা, হাত ধোয়া, জনসমাগম এড়ানো এবং সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা। এ সহজ কিন্তু বিজ্ঞানসম্মত উপায়গুলো শতবছর আগে স্প্যানিশ ফ্লু মহামারি নিয়ন্ত্রণে কার্যকর হয়েছিল এবং করোনার সব বিপজ্জনক ভ্যারিয়েন্টকে এসব স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার মাধ্যমে প্রতিরোধ করা সম্ভব।
ডা. শাহরিয়ার রোজেন : জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ এবং সিনিয়র পলিসি বিশ্লেষক, কানাডা
ড. শাফিউন নাহিন শিমুল : সহযোগী অধ্যাপক, স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
প্রবাস বাংলা ভয়েস/ঢাকা/ ২৪ এপ্রিল ২০২১ /এমএম





