“বীরাঙ্গনা” শব্দটি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। এই সময় বাংলাদেশের প্রায় ২-৪ লক্ষ নিরীহ নারী পাকিস্তান সেনাবাহিনী, রাজাকার,আলবদর ও তাদের সহযোগীদের দ্বারা ধর্ষিত হয়। ১৯৭১ সালের ২২ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যুদ্ধকালীন সময়ে লাঞ্ছিত, নির্যাতিত নারীদের অবদানকে জাতীয় পর্যায়ে স্বীকৃতি প্রদানস্বরূপ ‘বীরাঙ্গনা’ খেতাব দিয়েছিলেন; এই খেতাবপ্রাপ্ত নারীদের ‘বীরাঙ্গনা’ বলা হয়।
কিন্তু সামাজিক ও পারিবারিক কারণে কোনো নারীই তখন তাঁদের ওপর ওপর নির্যাতনের ঘটনা প্রকাশ করতে চাইতেন না৷ ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীই প্রথম নারী যিনি তাঁর ওপর নির্যাতনের ঘটনা প্রকাশ করেন৷ বলেন, ‘‘বীরাঙ্গনা লজ্জার নয়, গর্বের৷”
২০১০ সালে তিনি বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান ‘স্বাধীনতা পদক’ পান৷ ২০১৬ সালে বাংলাদেশ সরকার তাঁকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়৷ তাঁর আত্মজীবনী ‘নিন্দিত নন্দন’ প্রকাশিত হয় ২০১৪ সালে একুশের বইমেলায়৷
বিরাঙ্গনাদের নিয়ে আলোচনা করতে গেলে দেখা যায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বাঙালি নারী ধর্ষণের পেছনে তিনটি কারণ কাজ করেছিল-
১) ধর্মীয় কারণ;
২) বাঙালি জাতির প্রতি তীব্র ঘৃণা এবং বাঙালি জাতিকে বিশুদ্ধ করা
৩) অপরাধ প্রবনতা
পাকিস্তানি সৈন্যরা বাঙালি নারী নির্যাতনে ক্ষেত্রে দুই রকম পদ্ধতি অবলম্বন করতোঃ
১) উপস্থিত ধর্ষণ।
২) যৌনদাসী।
উপস্থিত ধর্ষণ:
পাকিস্তান আর্মি, বিহারি, রাজাকার ও দালালরা অধিকৃত বাংলাদেশের শহর এবং গ্রামের বিভিন্ন বাড়িতে বা এলাকায় উপস্থিত হয়ে খুন-লুটপাটের সাথে সাথে সেখানেই নারীদের ধর্ষণ করতো।পাকিস্তানি ও দালালরা রাস্তা থেকে বা কোন জায়গা থেকে বাঙালি নারীদের তুলে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করতো।
নিখোঁজ-গ্রেফতারকৃত পরিবারের সদস্যদের সন্ধানে ও বিপদে পড়ে যারা পাকিস্তান আর্মি-বিহারী ও দালালদের কাছে সহযোগিতা চাওয়ার জন্য যেতো, তাদের অনেককে ধর্ষণ করা হতো।একাত্তরে মোট নির্যাতিত নারীর শতকরা ৭০ ভাগ উপস্থিত ধর্ষণের শিকার।
ওয়ার ক্রাইম ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটির হিসেবে, উপস্থিত ধর্ষণের শিকার নারীর সংখ্যা প্রায় ৩,২৭,৬০০ জন। এদের প্রায় ত্রিশ ভাগ অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়েন।
যৌনদাসী:
যৌনদাসী পদ্ধতিতে নারীকে দীর্ঘদিন বন্দী রেখে ধর্ষণ করা হয়। পাকিস্তান সেনা কর্মকর্তারা তাদের ক্যাম্পগুলোতে এসব নারীদের বন্দী করে রাখতো এবং দিনের পর দিন গণধর্ষণ করতো।এই বন্দিনী নারীদের কোন পোশাক পরতে দেয়া হতো না, যাতে ওরা পালিয়ে যেতে বা আত্মহত্যা না করতে পারে।
ওয়ার ক্রাইম ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটির মতানুসারে পাকিস্তানিরা যৌনদাসী পদ্ধতিতে প্রায় ১,৪০,৪০০ জন নারীকে নির্যাতন করেছিল এবং এদের ৮০ ভাগই গর্ভবতী হয়ে পড়ে। বন্দী এসব নারীদের চল্লিশ ভাগ যুদ্ধের সময় খুন হয়, কিছু অতিরিক্ত ধর্ষণে মারা যায়। অনেকে আত্মহত্যা করে।
পাকিস্তানিরা পরিকল্পিতভাবে বাঙালি নারীদের বন্দী করে ধর্ষণ করতো, যাতে তারা পাকিস্তানিদের সন্তান গর্ভধারণ করে। এর পিছনে জৈবিক অসৎ উদ্দেশ্যের চেয়ে বেশি কাজ করেছিল বাঙালির প্রতি পাকিস্তানিদের তীব্র ঘৃণা ও ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি। তাই ওরা একাত্তরের যুদ্ধকে জিহাদ মনে করতো এবং যুদ্ধের সময় গণিমতের মাল হিসেবে বন্দী হওয়া নারীদের সাথে তাদের অসম্মতিতে ধর্ষণ করা বৈধ বলেই মনে করতো।
একাত্তরের যুদ্ধে নারী নির্যাতনের অন্যতম কারণ ছিল বাঙালি সমাজের মেরুদণ্ড ভেঙে দেওয়া এবং তাদের ক্ষমতাহীন করার জন্য একটি সুপরিকল্পিত প্রচেষ্টা।
মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর অধিনায়ক ছিলেন জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজী। এই নরপশুর নেতৃত্বেই রাওফরমান, রহিম খান, টিক্কা খানের মত পাকিস্তানী জেনারেল এদেশের উপর চালায় ইতিহাসের জঘন্যতম গণহত্যা এবং এইসব বিকৃত রুচির ও অমানবিক জেনারেলদের পরিকল্পনায় সংঘটিত হয় ধর্ষণের মহোৎসব।
ব্রিগেডিয়ার আবদুল রহমান সিদ্দিকী
তার East Pakistan The End Game বইতে লেখেন, “নিয়াজী জওয়ানদের অসৈনিকসুলভ, অনৈতিক এবং কামাসক্তিমূলক কর্মকাণ্ডে উৎসাহিত করতেন। ‘গতকাল রাতে তোমাদের অর্জন কি আমার বাঘেরা?’ চোখে শয়তানের দীপ্তি নিয়ে জিজ্ঞেস করতেন তিনি। অর্জন বলতে তিনি ধর্ষণকেই বোঝাতেন।”
আর এই ধর্ষণের পক্ষে তিনি যুক্তি দিয়ে বলতেন,
“আপনারা কি ভাবে আশা করেন একজন সৈন্য থাকবে, যুদ্ধ করবে, মারা যাবে পূর্ব পাকিস্তানে এবং যৌন ক্ষুধা মেটাতে যাবে ঝিলমে?”
যুদ্ধের পুরোটা সময় জুড়ে বাঙালী সব ধর্মের নারীদের উপর যৌন নির্যাতন, ধর্ষণ আর হত্যা করা – যা ছিল সুপরিকল্পিত ও ভয়াবহ। আন্তর্জাতিক গবেষক সুজান ব্রাউন মিলার তার “Against Our Will: Men,Women, and Rape” বইতে নারী নির্যাতনকে নানজিঙ্গে জাপানীদের দ্বারা রেপ ও রাশিয়াতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে জার্মানিদের দ্বারা রেপ এর সাথে তুলনা করেছেন। তিনি তার বইয়ে আরোও লিখেছেন, ‘একাত্তরের ধর্ষণ নিছক কোনো ঘটনা ছিল না। সেখানে আট বছরের বালিকা থেকে শুরু করে পঁচাত্তর বছরের নানি—দাদির বয়সী বৃদ্ধাও শিকার হয়েছিল এই যৌন পাশবিকতার। রাতে চলত আরেক দফা নারকীয়তা। কেউ কেউ হয়তো আশিবারেরও বেশি ধর্ষিত হয়েছে। …ঘটনাস্থলে ধর্ষণের পর প্রতি একশ জনের মধ্যে অন্তত দশ জনকে অন্য সেনাদের জন্য তাদের ক্যাম্প বা ব্যারাকে নিয়ে যাওয়া হতো। এই পাশবিকতায় কত জন নারীর মৃত্যু হয়েছে, আর কত জনকে মেরে ফেলা হয়েছে—তার সঠিক সংখ্যা হয়তো কল্পনাও করা যাবে না।’
“কোনো কোনো মেয়েকে পাকসেনারা এক রাতে ৮০ বারও ধর্ষণ করেছে।”
-মালেকা খান, যুদ্ধের পর পুনর্বাসন সংস্থায় ধর্ষিতাদের নিবন্ধীকরণে যুক্ত সমাজকর্মী বলেন,
“আমাদের সংস্থায় আসা নারীদের প্রায় সবারই ছিল ক্ষত-বিক্ষত যৌনাঙ্গ। বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে ছিড়ে ফেলা রক্তাক্ত যোনিপথ, দাঁত দিয়ে ছিড়ে ফেলা স্তন, বেয়োনেট দিয়ে কেটে ফেলা স্তন-উরু এবং পশ্চাৎদেশে ছুরির আঘাত নিয়ে নারীরা পুনর্বাসন কেন্দ্রে আসতো।”
-ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটির “যুদ্ধ ও নারী” গ্রন্থে বলা হয় এক একটি
গণধর্ষণে ৮/১০ থেকে শুরু করে ১০০ জন পাকসেনাও অংশ নিয়েছে।”
উপস্থিত ধর্ষণের’ শিকার হয়েছেন, এমন অনেকে সামাজিক ও পারিবারিক নিন্দার কথা চিন্তা করে নিপীড়নের কথা প্রকাশ করেননি; এমন অনেক পরিবার আছে, যাঁদের নারী সদস্যরা নিপীড়িত হবার পর ভারতে চলে গেছেন, এছাড়া পাকিস্তানে অনেক নারীকে অপহরণ করে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর অনেক সহায় সম্বলহীন ধর্ষিতা নারীদের গর্ভবতী অবস্থায় রাস্তায় রাস্তায় ঘুরাঘুরি করতেও দেখা যেত। এই সমস্ত বীরাঙ্গনা নারীদের দূর্দশার অন্ত ছিল না। আত্নীয়স্বজন, সমাজের কাছে ছিল পরিত্যক্ত।নীলিমা ইব্রাহিমের লেখা ‘আমি বীরাঙ্গনা বলছি’ যুদ্ধের সময়কার নারীদের উপর নির্যাতনের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।
সাতজন বিরাঙ্গনার সাক্ষাৎকার নিয়েই রচিত হয় এই বইটি। বইটিতে পাকিস্তানী হানাদারদের জঘন্যতম বর্বরতার পাশাপাশি আমাদের সমাজের অযাচিত রক্ষণশীল মনোভাবকেও তুলে ধরা হয়েছে।
২০১৪ সালের ২৭ জানুয়ারি হাইকোর্টের একটি আদেশের পর বীরাঙ্গনারা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি পেতে শুরু করে এবং ২০১৫ সালের ২৩ অক্টোবর বাংলাদেশ সরকার প্রথমবারের মতো ৪৩ জন বীরাঙ্গনাকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। এ পর্যন্ত ৪০০ বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধার মর্যাদা পেয়েছেন যা কিনা মোট সংখ্যার তুলনায় অনেক কম। ইতিমধ্যে বহু বিরাঙ্গনা মারাও গিয়েছেন।
স্বীকৃত বীরাঙ্গনাদের প্রত্যেকে মাসিক ১২ হাজার টাকা ভাতা পাবেন। এ ছাড়া, তাদের সন্তান ও নাতি-নাতনিদের জন্য সরকারি চাকরিতে বিশেষ কোটা সুবিধা থাকবে।একাত্তরে বাঙালি নারীর প্রতি যে পাশবিক নির্যাতন পাকিস্তানিরা করেছে, তা মানব ইতিহাসে ক্ষমার অযোগ্য এক নজিরবিহীন ঘটনা।
লেখক: নীলুফা আলমগীর, কবি ও লেখক ক্যালগেরি, কানাডা
প্রবাস বাংলা ভয়েস/ঢাকা/ ৩১ মার্চ ২০২১ /এমএম





