Menu

প্রবাস বাংলা ভয়েস ডেস্ক :: পাকিস্তানের বর্বর সেনাবাহিনী ২৫ মার্চ ঢাকায় গণহত্যা শুরু করার পর প্রথমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং রাজারবাগ ও পিলখানায় হামলা চালায়। এ তিন স্থানে গণহত্যার পর ২৭ মার্চ সবচেয়ে বড় গণহত্যা চালায় পুরান ঢাকার লোহারপুল এলাকার মালাকারটোলায়। তাদের লক্ষ্য ছিল ঢাকার হিন্দু অধ্যুষিত মহল্লাগুলো।

এ গণহত্যায় আমিও আমার দু’ভাইকে হারাই। আমাদের বাড়ি এই মৃত্যুপুরী মালাকারটোলায়। আমাদের বাড়িটি ছিল বাম রাজনীতির একটি কেন্দ্র। আমরা তিন ভাই ও পাঁচ বোন মা-বাবার সঙ্গে সে বাড়িতে থাকতাম। আমার বাবা ও ভাইয়েরা সবাই ছিলেন বাম আদর্শের কর্মী। আমাদের বাড়িতে প্রগতিশীল সংস্কৃতিচর্চার আবহ ছিল। আমি তখন গেন্ডারিয়া হাইস্কুলে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ি।

২৫ মার্চ রাতে গণহত্যা শুরু হওয়ার পর ২৬ মার্চ সারাদিন পুরান ঢাকার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও থানায় হামলা চালিয়ে যাকে যে অবস্থায় পেয়েছে পাকিস্তানিরা, মেশিনগানের ব্রাশফায়ারে হত্যা করেছে। আমরা আতঙ্ক আর কারফিউর কারণে বাড়ি থেকে বের হইনি। ২৭ মার্চ সকালে কারফিউ শিথিল হলে আশপাশের এলাকা দেখতে বের হই। বিধ্বস্ত চেহারা বিভিন্ন এলাকার। শাখারিপট্টীতে অনেক লাশ পড়ে থাকতে দেখি। আমাদের বাড়ির কাছাকাছি সূত্রাপুর থানা, সেখানে গিয়ে দেখি পাকিস্তানিদের মর্টার আর মেশিনগানের গুলিতে পুরো ভবনটি প্রায় বিধ্বস্ত হয়ে আছে।

থানার ভেতরে দেখি এক পুলিশের লাশ পড়ে আছে। পাকিস্তানি সৈন্যবোঝাই গাড়ি লোহারপুলের ওপর দিয়ে যাওয়া-আসা করছে। এরই মধ্যে দেখলাম একদল লোক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও বাড়িতে লুটপাট করছে। অন্যদিকে অসংখ্য মানুষ ঊর্ধ্বশ্বাসে পালাচ্ছে শহর ছেড়ে। এসব দেখে চরম ভয় পেয়ে আবার বাড়ি ফিরে ঢাকা ছেড়ে পালানোর পরিকল্পনা করি।

ঠিক করি পরদিনই আমরা বুড়িগঙ্গা নদী পেরিয়ে বিক্রমপুরের দিকে চলে যাব। এসব ভাবনাচিন্তার মধ্যেই ২৭ মার্চ রাত নেমে আসে। রাতে পাকিস্তান বাহিনী হামলা করতে পারে ভেবে আমি পাশের মুসলমানদের বাড়িতে চলে যাই রাত কাটাতে। আমার বোনরাও অন্য এক বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় নেয়। বাড়িতে থেকে যায় বাবা, ভাই দুলাল ও বিপ্লব।

সন্ধ্যা থেকে আবার কারফিউ শুরু হয়। রাত ১১টার দিকে একদল আর্মি এসে আমাদের বাড়ি ঘেরাও করে। দরজা ভেঙে ঘরে ঢুকে আমার বাবা কালিপদ দে, ভাই দুলাল দে ও ছোট ভাই বিপ্লবকে ধরে নিয়ে যায়। ধরে নিয়ে যাওয়ার আগে পাকিস্তান আর্মি সবাইকে জেরা করে এবং কাপড় খুলে দেখে নিশ্চিত হয় যে তারা সবাই হিন্দু। আমাদের বাড়িতে হামলা করার আগে-পরে আর্মি আরও কয়েকটি বাড়িতে হামলা করে অনেক লোককে ধরে নিয়ে যায়।

সবাইকে নিয়ে যাওয়া হয় লোহারপুলে। সেখানে সবাইকে লাইন দিয়ে দাঁড় করিয়ে একসঙ্গে সবার দিকে মেশিনগান উঁচিয়ে গুলি করা হয়। গুলি খেয়ে সবাই লুটিয়ে পড়ে। তবে সৌভাগ্যক্রমে আমার বাবাসহ আরও দু-তিনজন বেঁচে যান। বাবার গালে ও কানে গুলি লাগে, দু-একজনের গায়ে একেবারেই গুলি লাগেনি।

তারা দোলাই খালের ময়লা পানিয়ে মড়ার মতো পড়ে থাকেন। আহত শরীর নিয়ে আমার বাবাও মাটিতে শুয়ে থাকেন। কয়েক ঘণ্টা কেটে যাওয়ার পর খুব ভোরে ফজরের নামাজের আজানের শব্দ শুনে বাবা উঠতে চেষ্টা করেন। উঠেই তিনি দেখেন আমার ভাই দুলাল দে শুয়ে আছে পাশেই।

তিনি খুব মিহি কণ্ঠে দুলালকে ডাকেন। কিন্তু পরক্ষণেই বুঝতে পারেন দুলাল বেঁচে নেই। এরপর তিনি রক্তাক্ত শরীর নিয়ে ধীরে ধীরে দোলাই খালের পাড় দিয়ে হেঁটে কাছেই আমাদের পরিচিত ডা. আজিজুন্নেসার বাড়িতে গিয়ে ওঠেন। ডা. আজিজুন্নেসা তাড়াতাড়ি একজন লোক দিয়ে বাবাকে মিটফোর্ড হাসপাতালে পাঠান।

সেখানে বাবা প্রায় এক সপ্তাহ চিকিৎসা নিয়ে প্রথমে বিক্রমপুর গিয়ে আমাদের সঙ্গে মিলিত হন। পরে দীর্ঘ পথ পেরিয়ে আমরা সবাই আগরতলায় চলে যাই।

প্রবাস বাংলা ভয়েস/ঢাকা/ ২৭ মার্চ ২০২১ /এমএম


Array