Menu

প্রবাস বাংলা ভয়েস ডেস্ক ::  ভাষাসৈনিক এ এম ফোরকান উদ্দীন চৌধুরী ভাষা আন্দোলনে এক স্মরণীয় নাম। আজ ১৩ই জানুয়ারী, ২০২১ তাঁর জন্ম শতবার্ষিকী। ১৯২১ খৃঃ ১৩ই জানুয়ারী তিনি সন্দ্বীপে জন্ম গ্রহন করেন। তাঁর বাবার নাম মুজাফ্ফর হুসেন চৌধুরী এবং মায়ের নাম আসিয়া খাতুন চৌধুরাণী। ১৯৪০ খৃঃ তিনি সন্দ্বীপ ইংলিশ হাই স্কুলের প্রথম ব্যাচে মেট্রিক পাশ করেন। তাঁর আইএ পাশ (১৯৪২) এবং বিএ পাশ (১৯৪৪) কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে। অতঃপর কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষাতাত্বিক অধ্যাপক ডঃ সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের অধীনে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে এমএ ক্লাশে ভর্তি হ’ন।

ইতোমধ্যে ১৯৪৭ খৃঃ ভারতবর্ষ বিভক্তির কারণে তাঁকে কোলকাতা ছাড়তে হয়, তাই কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর আর এমএ সম্পূর্ণ হয়নি। অতঃপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জ্ঞানতাপস অধ্যাপক ডঃ মুহম্মদ শহিদুল্লাহর তত্বাবধানে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে এমএ-তে ভর্তি হ’ন। ফোরকান চৌধুরী যখন কোলকাতা থেকে ঢাকা পৌঁছেন, নূতন পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দূ হবে, তা নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছে। বিতর্ক থেকে ভাষা আন্দোলন – এম আর আখতার মুকুল (ভাষা আন্দোলন থেকে স্বাধীনতা)-এর মতে ভাষা আন্দোলন দু’ দফায় হয়েছিল –প্রথম দফা ১৯৪৮ খৃঃ এবং দ্বিতীয় দফা ১৯৫২ খৃঃ।

ফোরকান চৌধুরী এ দু’ দফা ভাষা আন্দোলনেই সম্পৃক্ত ছিলেন। প্রথম দফার সূচনা পাকিস্তান সৃষ্টির প্রাক্কালে ডঃ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার জোরালো যৌক্তিকতা সমৃদ্ধ লেখনীর (দৈনিক আজাদ, ২৩শে জুলাই ১৯৪৭) মাধ্যমে। পাকিস্তান সৃষ্টির পরপরই ১লা সেপ্টেম্বর ১৯৪৭ খৃঃ ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা’-এর সপক্ষে অধ্যাপক আবুল কাশেম গঠন করেন তমুদ্দন মজলিশ। সহপাঠী বন্ধু শাহেদ আলী তমুদ্দন মজলিশের একজন নেতৃস্থানীয় সদস্য –তাঁর মাধ্যমে ফোরকান চৌধুরীর তমুদ্দন মজলিশ এবং এর ভাষা আন্দোলন সংক্রান্ত কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ততা। ১৯৪৮ খৃঃ ২৪শে মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে জিন্নাহ’র “উর্দূ এবং একমাত্র উর্দূই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা“ ঘোষণার প্রতিক্রিয়ায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যে ছাত্ররা আবদুল মতিনের নেতৃত্বে তৎক্ষণাৎ সমস্বরে ‘নো’ ‘নো’ বলে প্রতিবাদ করে উঠেছিলেন – বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে এমএ ক্লাশের ছাত্র ফোরকান চৌধুরীও তাঁদের মধ্যে ছিলেন। এ ঘটনার পর চার বছর ধরে আন্দোলন বায়ান্ন’র ২১ শে ফেব্রুয়ারী’র সেই মর্মন্তুদ ঘটনার দিকে এগুতে থাকে। এর মধ্যে তিনি ১৯৪৯ খৃঃ পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকারের হিসাব রক্ষণ দপ্তরে (সেন্ট্রাল সেক্রেটারিয়েট –ইডেন বিল্ডিং) কাজে যোগ দেন এবং ১৯৫০ সালে এম এ পাশ করার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে ভর্তি হ’ন। এমএ পাশের পর স্যার সলিমুল্লাহ মুসলিম হল থেকে ইকবাল হলে স্থানান্তুরিত হলেও নিয়মিত যোগাযোগ/ যাতায়াত ছিল ভাষা আন্দোলনের কেন্দ্র স্যার সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের তাঁর পূর্বতন ঠিকানায়।

এলো ২১শে ফেব্রুয়ারী, ১৯৫২ –ভাষা আন্দোলনের দ্বিতীয় দফার রক্তাক্ত পর্যায়। ফোরকান চৌধুরী আগের দিনই শুনেছেন ১৪৪ ধারা জারির খবর; কিন্তু গভীর রাতে খবর এলো, ছাত্ররা ১৪৪ ধারা ভাংবে এবং মিছিল করবেই। যাই হোক, সকালে বন্ধু খালেক নেওয়াজ খান সহ আমতলায় পৌঁছলেন। আনুমানিক বেলা সাড়ে ১১ টার দিকে গাজীউল হকের সভাপতিত্বে ছাত্রসভা শুরু হয়। সিদ্ধান্ত হলো ১০ জন করে মিছিল মেডিক্যাল ব্যারাক হয়ে এসেম্বলি হলের (জগন্নাথ হল) দিকে যাবে –উদ্দেশ্য, এসেম্বলি হল গামী এমএলএ দের পথরোধ করে “রাষ্ট্রভাষা বাংলা”-র পক্ষে প্রতিশ্রূতি আদায়। পরিস্থিতি সুশৃংখলই ছিল; কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যে বিশৃংখল হয়ে গেলো। পুলিশের লাঠিচার্জ , কাঁদানে গ্যাস, মুহুর্মুহু গুলিবর্ষণ, আহত ও রক্তাক্ত দেহ এখানে সেখানে। ফোরকান চৌধুরী অল্পের জন্য প্রাণে রক্ষা পেলেন; কিন্তু পড়ে গিয়ে কিছুটা আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে একজনের সাহায্যে তিনি কোন রকমে ঢাকা মেডিক্যল কলেজ হাস্পাতালের ইমারজেন্সীতে পৌঁছেন।

সেখানে ইন্টারনী ডাঃ আসাদুল হক (ঐদিন তিনিই সাংবাদিকদের শহীদ রফিকের মাথার ঝুলন্ত খুলির ছবি তুলতে দিয়েছিলেন/ পরবর্তীতে মেজর ডাঃ আসাদ, ১৭ই এপ্রিল ১৯৭১ খৃঃ পাক-সেনাদের গুলিতে শহীদ) সহ ডাক্তারদের দেখেন আহতদের প্রাণপণে বাঁচানোর চেষ্টা করছেন। ডাঃ আসাদের বাড়ী সন্দ্বীপ, তাই পূর্ব পরিচিত। ডাঃ আসাদ কিছু চিকিৎসা দিয়ে ফোরকান চৌধুরীকে কিছুক্ষন বিশ্রামের জন্য তাঁর হোস্টেল রুমে পাঠিয়ে দিলেন। পরে কারফিউ জারির সংবাদে ইকবাল হলে না ফিরে সন্ধ্যা নাগাদ ফোরকান চৌধুরী অতি কষ্টে ফুফা মুহম্মদ আমিনুল্লাহর আজিমপুর কলোনীর বাসায় পৌঁছুলেন। ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণতো বটেই, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকারের হিসাব রক্ষণ বিভাগের একজন সদস্য ফোরকান চৌধুরীর সামান্য সংশ্লিষ্টতাও প্রমাণিত হলে তা ‘গুরুতর শাস্তিযোগ্য অপরাধ’ বিবেচিত হতো। তাই ফুফা তাঁকে বিশ্ববিদ্যালয় আবাসিক হলে যেতে না দিয়ে কিছুদিনের জন্য নিজের বাসায় রেখে দেন। কারন বিশ্ববিদ্যালয় হল গুলোতে সম্ভাব্য তল্লাশীর আগাম সংবাদ একজন সরকারী গোয়েন্দা কর্মকর্তা হিসেবে মুহম্মদ আমিনুল্লাহর কাছে ছিল। এভাবে তিনি পুলিশী হয়রানি এবং আইনী জটিলতা এড়াতে সক্ষম হ’ন।

পেশাগত কর্মক্ষেত্র পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকারের হিসাব রক্ষণ দপ্তরে হলেও ভাষাসৈনিক ফোরকান চৌধুরীর আগ্রহের কেন্দ্রে ছিল বাংলা ভাষা ও সাহিত্য এবং দেশ ও জন্মস্থান। ব্যক্তিজীবনে নিরহঙ্কারী ও প্রচারবিমুখ ফোরকান চৌধুরী ছিলেন অত্যন্ত বিদ্যোৎসাহী, সমাজহিতৈষী, বন্ধুবৎসল এবং সদালাপী। যাঁরা তাঁর সংস্পর্শে এসেছিলেন তাঁরা এখনো তাঁকে শ্রদ্ধায় স্মরণ করেন। ১৯৭৭ সালের ৬ই মে তিনি জান্নাতবাসী হ’ন। মৃত্যুকালে তিনি স্ত্রী ফরিদা খাতুন
চৌধুরী এবং দুই ছেলে ও এক মেয়ে রেখে যান।

ভাষাসৈনিক মরহুম ফোরকান চৌধুরীর জন্ম ও মৃত্যু দিবসে কানাডায় কর্মরত তাঁর ছেলে ডাঃ ফারুক চৌধুরী এবং দেশে কর্মরত তাঁর ছেলে ডাঃ চৌধুরী ফরিদ ও মেয়ে শামসুন নাহার চৌধুরী দোয়া মহফিলের আয়োজন করে থাকেন – যা কোভিড-১৯ এর কারনে এবছর সম্ভব হয়নি। মরহুমের স্ত্রী এবং ছেলে মেয়ে মহান আল্লাহ তা’য়ালার কাছে মরহুমের আত্মার মাগফিরাত কামনা করে দো’য়া করার জন্য সবাইকে বিনীত অনুরোধ করছেন।

প্রবাস বাংলা ভয়েস/ঢাকা/ ১৪ জানুয়ারি ২০২১ /এমএম


Array