আহসান রাজীব বুলবুল :: ছোট্ট শিশুটি, ছিলাম মায়ের বুকে। ভাবতে অবাক লাগে কত ছোট ছিলাম আমরা। মা-যে বুকে তুমি ঘুম পাড়াতে, আঁচলে জড়িয়ে তুমি বলতে– “ঘুমপাড়ানি মাসি পিসি মোদের বাড়ি এসো” সত্যি কি মা মাসি পিসি এসে আমাদের ঘুম পাড়িয়ে দিত?
তোমার বুকে মাথা রেখে গান শোনাতে শোনাতে ঘুম পাড়িয়ে দিতে,চোখে দিতে কাজল, আর কপালে দিতে কালো টিপ যাতে কারো কু- নজরে না পড়ি।আদর করে দিতে চুমু।
যক্ষের ধনের মতো আগলে রাখতে। খিলখিল করে হাসলে আরো হাসানোর কি চেষ্টা ছিল তোমার! তোমার বুকে এত ভালোবাসা এত শান্তি পৃথিবীর কোথাও কি আছে?
হেমন্তের আবাহনে বাংলার মাঠে প্রান্তরে এখন নবান্ন। ঘরে ঘরে পিঠা-পুলির উৎসব। শীত আসলেই বাঙ্গালী হৃদয়ের মন জেগে ওঠে রসনার পিঠাপুলির দিকে।সোনালী ধান, ঢেকিতে পাড়ি দিয়ে চালের গুঁড়া, আর পাটালি গুড় দিয়ে ভাপা পিঠা। রাতে মা বলতো গরম পিঠা খেতে হলে জেগে থাকো বাবা।
পাহাড়ের পাদদেশ, বৃক্ষের ছায়ারাজি, ঝর্ণাধারা আর বরফাচ্ছন্ন কানাডার প্রবাস জীবনে বড় অগোছালো সময়ের সিঁড়িতে বসে অশ্রুসিক্ত নয়নে আজ সব মনে পড়ে মা।
মনে পড়ে সেই ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত ঘুমের কাতরে সারা রাতের জেগে থাকা রাস্তার পাগলির সকালে টং এর দোকানে চায়ের কাপে পাউরুটি ভিজিয়ে খাওয়া, রাতের কথা ভেবে পাগলিটির হাতের সঙ্গে শীতে সারা শরীর কেঁপে উঠার কথা। ক্লান্ত শরীরে তাঁর চেহারায় স্পষ্ট অর্ঘূম রাতের ক্লান্তিহীন সংগ্রামের কথা।
অন্যদিকে চাকচিক্য নিয়ন আলোয় আলোকিত বিশালকায় হলরুমে গ্লাসের শব্দের সাথে বেজে উঠছে গান, আর হৈ-হুল্লোড় নাচের দৃশ্য। দিনের আলোয় উদ্ভাসিত সব শ্রেণী-পেশার চেনা মুখগুলো রাতের আলোয় যেন অচেনা। নামিদামি ফাইভস্টার হোটেলসহ প্রায় অনেক নামিদামি হোটেলগুলোতেই চলে রাতের বানিজ্য। রাতের এই বানিজ্যে অংশ নেয় সমাজের তথাকথিত সুশীল ব্যক্তিত্বরা। ধর্ষকের জামিন থেকে শুরু করে বিদেশে অর্থ পাচার- কি নেই এই রাতের বাণিজ্য ?
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের জীবনেও যেন রূপ বদলায়। দিন যায়, থাকে কথা, থাকে না সময়, মাস আর বছর। মায়ের বুকে মাথা রাখা সেই ছোট্ট শিশুটি একদিন বড় হয়। চিন্তা-চেতনায় আসতে থাকে পরিবর্তন। ক্ষমতা, লোভ আর দুর্নীতিতে বড় হওয়া সেই ছোট্ট শিশুটি একদিন কাঁচের ভাঙ্গা আয়নায় নিজেকে দেখে চমকে ওঠে। চেনা অচেনার হাত ধরে উল্টো পথে হাঁটতে থাকে। যদি কখনও দেখা মেলে নিজের অস্তিত্বের আঁকড়ে ধরা খড়কুটোর।
হায়রে মানুষ! রঙ্গীন চশমার দিন শেষ হতে না হতেই আসে নতুন দিন। চিন্তা-চেতনায় আসে পরিবর্তন ।অস্তিত্বের রহস্যময়তা ও কালস্রোতে কুটের মতো ভেসে যাওয়া বেদনাহত জীবন খুঁজতে থাকে ভেতরের মানুষটাকে। খুঁজতে থাকে খেলার পিছনের খেলাকে। সময়ের সিঁড়িতে জীবনকে তো আর আটকানো যায় না। জীবনটা হয় ইতিহাস।
রাস্তার পাগলির ঐ দশা আর নিয়ন আলোয় চাকচিক্য হলরুমের আওয়াজ এক সময় মানুষকে তাড়িয়ে বেড়ায়। জীবন সায়াহ্নে এসে চেতনারও যে পরিবর্তন হয়, তা তার কোনো কাজেই আসে না ।নিজের চেনা মুখ হয়ে যায় অচেনা।
জীবনের স্বাদ নিতে আসা সেই মুখোশকে কখনই ভেতর থেকে বিচ্ছিন্ন করা যায় না।
তারপরও মানুষ থেমে থাকেনা। মানুষ থেকে জন্ম নেয় আরেকটি মানুষ। মানুষের ক্ষতি করা, একজন আরেকজনের পেছনে লাগে, সম্পর্ক নষ্ট করা, হিংসা বিদ্বেষ, লোভ লালসার উন্মমত্ততায় হারিয়ে ফেলে নিজেকে।
সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশের কিছু ঘটনা তাই মনে করিয়ে দেয়। চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ার ইয়াসমিন আর বিশ বছর আগে ঘটে যাওয়া দিনাজপুরের ইয়াসমিনের উপরে অত্যাচার নির্যাতনের খবর শিরোনাম হলেও হাজারো ইয়াসমিনরা সুশীল সমাজের রাতের বাণিজ্যে হারিয়ে যায়।
দুর্জন বিদ্বান হলেও পরিত্যাজ্য। জি কে শামীম, গোল্ডেন মনির, ওসি প্রদীপ, এসআই আকবর,সাহেদের মতো নরপশুরা লিড নিউজ হলেও ব্যাকগ্রাউন্ডে এদের মদদদাতারা ধরা ছোঁয়ার বাইরেই থেকে যায়।
মনে পড়লো সেই বিখ্যাত নর্তকী ইসাডোনার কথা, তিনি জর্জ বার্নার্ডশ কে লিখলেন- ভাবুন তো, আপনি আর আমি যদি একটা শিশুর জন্ম দেই, ব্যাপারটা কি চমৎকারই না হবে! সে পাবে আমার রূপ আর আপনার মত মেধা। জর্জ বার্নার্ডশ জবাবে লিখলেন–যদি আমার রূপ আর আপনার মতো মেধা পায়, তবে?
করোনা ভাইরাস সংক্রমিত হওয়ার বয়স নয় মাস হতে চলেছে। ভেবেছিলাম মহামারীর এই দুর্যোগের সময়েও একশ্রেণীর মানুষের মনুষ্যত্বের পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটবে, বিকৃত মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসবে। তা তো হয়ই নি, বরং হয়েছে তাঁর উল্টো টা।
দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপক পরিবর্তন, নৈতিক শিক্ষা আর আত্মিক পরিশুদ্ধতা না আসলে যথানিয়মে ঘুম পাড়ানোর সেই মাসি পিসিরা আবার এসে আমাদের ঘুম পাড়িয়ে দিবে। পুনরুত্থান ঘটতে থাকবে সেই একই স্রোতধারায়।
লেখক: প্রধান সম্পাদক, প্রবাস বাংলা ভয়েস।
প্রবাস বাংলা ভয়েস/ঢাকা/ ২২ নভেম্বের ২০২০/এমএম





