Menu

প্রবাস বাংলা ভয়েস ডেস্ক ::  আসবে দেবী মর্তভূমে নাশিতে অসুর শক্তি,/সকল প্রাণে উঠেছে সাড়া পুষ্পাঞ্জলি আর ভক্তি।বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসের প্রভাব মানুষের মাঝে প্রত্যহ মৃত্যুর আশঙ্কা জাগিয়ে যাচ্ছে। এমন এক বৈশ্বিক মহামারীর মাঝে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম প্রধান উৎসব দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হচ্ছে।

একদিকে মৃত্যুর মিছিল, অন্যদিকে মৃত্যু থেকে রক্ষা পেতে মানুষের চেষ্টা। এ যেন মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে টিকে থাকার সংগ্রাম। এমন পরিবেশে প্রকৃতিতে মহাদেবীর আগমনবার্তা নতুন আশার সঞ্চার করেছে।

আজ বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বের শান্তি ও কল্যাণ কামনা, এ মহামারী থেকে মুক্তির আকাঙ্ক্ষা যেন প্রত্যেক ভক্তের হৃদয়ের আর্তি হয়ে উঠেছে। আমাদের ধর্মীয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অনুভূতি উদ্বেলিত হয়ে প্রাণে প্রাণে আনন্দের দোলা দেয়। মহাশক্তি আনন্দময়ীর জাগরণে ও আগমনে মহানন্দ শক্তির বিশ্বব্যাপী মহালীলা অনুভব করার শুভক্ষণ আসে আমাদের জীবন ও সমাজে।

সে কারণেই সব বিপদ থেকে রক্ষার জন্য মহাদেবীর রণরঙ্গিনী রূপের আরাধনায় আমরা মেতে থাকি। আকাশে-বাতাসে দেবীর আগমনী বার্তা যেমন প্রকাশ পায়, তেমনি এ পৃথিবীতে তার অবস্থান আপামর বাঙালি হৃদয়ে সাহস ও শক্তির উচ্ছ্বাস জাগায়।

দুর্গাদেবী দুর্গতি নাশিনী। দুর্গতি-দুঃখ বিনাশ করে সমৃদ্ধ, যশ-খ্যাতি ও সম্পদশালী সুখী জীবনের প্রত্যাশায় দেবীর চরণে সবাই প্রার্থনা করে। কৃত্তিবাস ওঝা কর্তৃক সংস্কৃত রামায়ণের বাংলা ভাবানুবাদ করে বাংলা ভাষায় রচিত রামায়ণে ত্রেতা যুগে ভগবানের অবতার শ্রীরামচন্দ্র কর্তৃক রাবণ বধের নিমিত্তে অকালে দুর্গাদেবীর যে আরাধনা শুরু হয়েছে; তাই আজকের শারদীয় দুর্গোৎসব।

সীতাদেবীকে উদ্ধারের জন্য রাক্ষসরাজ রাবণকে পরাজিত করার জন্য শক্তি প্রার্থনা করে তিনি দুর্গাদেবীর আরাধনা করেছিলেন। আমাদের বঙ্গদেশে এ মহাদেবীর পূজা প্রচলনের সঙ্গে রাজা ও জমিদারদের নামটা যেভাবে জড়িয়ে আছে, তাতে খুব সহজেই আমরা বুঝতে পারি-প্রচুর অর্থব্যয় করে রাজাদের দ্বারাই এ পূজা করা সম্ভব হতো।

কথিত আছে, ষোড়শ শতকের মধ্যভাগে অবিভক্ত বঙ্গদেশের রাজশাহী জেলার সামন্তরাজ কংসনারায়ণ রায় প্রথম সাড়ম্বরে অনেক টাকা খরচ করে মহাদেবীর পূজা করেছিলেন।

ইতিহাস থেকে জানা যায়, সেই পূজায় তৎকালীন আট লাখ টাকা খরচ করা হয়েছিল। রাজা কংসনারায়ণের দেখাদেখি পশ্চিমবঙ্গের ভাদুড়িয়ার জমিদার জগৎ নারায়ণ ওই বছরই নয় লাখ টাকা খরচ করে মহাসমারোহে বাসন্তীপূজা করেছিলেন। কিন্তু এ বাসন্তীপূজা দুর্গাপূজার মতো জনপ্রিয় হয়নি।

কলকাতার শোভাবাজার রাজবাড়ির রাজা নবকৃষ্ণদেব ১৭৫৭ সালে অনেক টাকা খরচ করে দুর্গাদেবীর পূজা করেছিলেন। তার এ পূজা দেখার জন্য লর্ড ক্লাইভ নিজে এসেছিলেন এবং তিনিও নাকি আর্থিক সহযোগিতা করেছিলেন।

ষোড়শ শতকে শুরু হওয়া এ দশভুজার আরাধনা তখন শুধু রাজা ও জমিদারদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। সাধারণ মানুষ পূজার কয়েকদিন একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য মন্দির প্রাঙ্গণে যাওয়ার সুযোগ পেত। বাকি সময় রাজা ও জমিদাররা নিজেদের নিমন্ত্রিত অতিথি ও আত্মীয়দের নিয়ে পূজার দিনগুলো কাটাত।

তাহলে সাধারণ মানুষ কীভাবে দুর্গাপূজা করার সুযোগ পেয়েছে? অর্থাৎ, আমরা যাকে বারোয়ারি পূজা বলে থাকি তা কীভাবে শুরু হয়েছে? সাধারণ মানুষ রাজবাড়ির প্রতিমা দেখে, প্রসাদ পেয়ে আনন্দিত হলেও তাদের মনের মধ্যে মহাদেবীর আরাধনার আকাঙ্ক্ষা কোনোভাবেই নিবৃত হতো না। অনেক অর্থের প্রয়োজন হওয়ায় সবার পক্ষে মায়ের মূর্তি গড়ে পূজা করার সুযোগ ছিল না। কিন্তু ভক্তের আকাঙ্ক্ষা কি মহাদেবী অপূর্ণ রাখতে পারেন?

জানা যায়, পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলায় ১৭৯০ সালে বারো ব্যক্তি মিলিত হয়ে নিজেদের অর্থে সম্মিলিতভাবে দুর্গাপূজা করার মনস্থির করেন। সে অনুসারে তারা প্রত্যেকে অনুদান দিয়ে তহবিল গঠন করেন। এককভাবে পূজা করতে চাইলে অনেক টাকার প্রয়োজন, যা সবার পক্ষে করা সম্ভব নয়। তাই তাদের এ উদ্যোগ স্থানীয়দের কাছে অনুপ্রেরণার উৎস হয়েছিল। সম্মিলিত উদ্যোগে মন্দির, প্রতিমা তৈরি, সাজসজ্জা, সবাইকে নিমন্ত্রণ এবং সবার অংশগ্রহণে পূজার আনন্দ যেন বহুগুণ বেড়ে যায়। জাতি, বর্ণ ও শ্রেণি নির্বিশেষে সবার অংশগ্রহণে পূজামণ্ডপ হয়ে ওঠে পবিত্র এক তীর্থক্ষেত্র।

১২ ব্যক্তির উদ্যোগে এ পূজা শুরু হওয়ায় তখন একে বারোয়ারি পূজা নামে অভিহিত করা হয়। কিন্তু আজ বারোয়ারি পূজা শুধু বারোজনের উদ্যোগ কিংবা বারোজনের সামর্থ্যরে মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। এখন তা সর্বসাধারণের পূজা। বারোয়ারি শব্দটি কালক্রমে সার্বজনীনত্ব পায়। যদিও উভয় শব্দের মধ্যে অর্থের কোনো পার্থক্য নেই। তাই বারোয়ারি শব্দটি আজ সার্বজনীন শব্দের সঙ্গে এক হয়ে সমার্থক হয়ে উঠেছে।

সময়ের প্রবাহে আজ ব্যক্তি উদ্যোগে অনুষ্ঠিত পূজার চেয়ে সার্বজনীন বা বারোয়ারি পূজায় মানুষের অংশগ্রহণ অনেক বেশি। আনন্দ ও বিনোদন আজ বারোয়ারি পূজায় বেশি। কালের চক্রে রাজা ও জমিদারদের পূজার আয়োজন ক্রমে ক্রমে ফিকে হয়ে এলেও বারোয়ারি পূজার আয়োজনের জৌলুস যেন দিন দিন বেড়েই চলেছে। এখন বারোয়ারি পূজায় সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তিরা যুক্ত থাকেন। সমাজের সব স্তরের মানুষের মধ্যে সম্প্রীতির ঐক্য, ভ্রাতৃত্ববোধ ও সহযোগিতামূলক মনোভাব সৃষ্টিতে বারোয়ারি পূজার অবদান অনস্বীকার্য।

আজ দেশের সর্বত্র বারোয়ারি পূজা বা সার্বজনীন দুর্গোৎসবের আয়োজন করা হয়। অবশ্য অনেকে ব্যক্তি উদ্যোগেও মায়ের আরাধনা করে থাকে। তবে তাদের অধিকাংশই নিজেদের পারিবারিক ঐতিহ্যকে বজার রাখার জন্যই করে। এদের সংখ্যা খুব কম। এখন দুর্গাপূজা করার জন্য যে অর্থের প্রয়োজন হয়, তা এক ব্যক্তির পক্ষে দেয়া সম্ভব হলেও দেন না। কেননা দুর্গাপূজার আনন্দ এখন আর পরিবারকেন্দ্রিক নেই।

দুর্গা উৎসব যেমন সার্বজনীন হয়েছে, তেমনি এর আনন্দও সার্বজনীন। সমাজের সব শ্রেণির মানুষ তাতে অংশ নেয়ার সুযোগ পাওয়ায় এ উৎসব সবার। সবাই ভাবে এ পূজায় তারও সামান্য অবদান রয়েছে। আর এ কারণেই সেই ব্যক্তির দায়িত্ববোধ ও অন্যের সঙ্গে ভ্রাতৃত্ববোধে যুক্ত থাকার প্রয়োজনীয়তা তিনি বুঝতে পারেন। এভাবে দেশের প্রতিটি পূজামণ্ডপ আজ সবার জন্য উন্মুক্ত। যাদের মধ্যে মহাদেবীর আরাধনার আগ্রহ রয়েছে, দশভুজার রাতুল চরণে পুষ্পাঞ্জলি দেয়ার আকুতি রয়েছে; তারা সবাই আজ ধর্মের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে ঐক্য, প্রেম ও ভ্রাতৃত্ববোধ জাগরণের চেষ্টা করেন।

এ ভ্রাতৃত্ববোধ অটুট থাকলে সমাজ থেকে সব ধরনের অশুভ শক্তির নাশ হবে এবং শুভ শক্তির উত্থান ঘটবে। আজ সময় এসেছে প্রাণে প্রাণে যুক্ত হওয়ার। প্রয়োজন দেখা দিয়েছে একই বীণায় সম্মিলিত প্রাণের সুর উত্থিত করার। দেহের আসুরিক শক্তির বিনাশের সঙ্গে সমাজ ও রাষ্ট্রের সব অশুভ শক্তির বিনাশ হোক; ন্যায়, সত্য ও সুন্দরের উত্থান ঘটুক-এটাই মহাদেবী মহামায়ার কাছে আমাদের প্রার্থনা।

ড. সনজিত পাল : সিনিয়র শিক্ষক, সেন্ট গ্রেগরি হাইস্কুল অ্যান্ড কলেজ

প্রবাস বাংলা ভয়েস/ঢাকা/ ২৪  অক্টোবর ২০২০/এমএম


Array