জয়দীপ সান্যাল, ক্যালগেরি, আলবার্টা, কানাডা :: সংবাদপত্র আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রায় প্রতিদিনই দেখা যায় নারী ধর্ষণের ভয়াবহ বিবরণ । অভিযুক্তদের অনেকের নাম রয়েছে বর্তমানে ক্ষমতাসীন দল ও তার ছাত্র-যুব সংগঠনের খাতায়। মিডিয়ায় ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জনমানুষ প্রতিবাদী হয়ে উঠলে নেতৃত্বের সর্বোচ্চ পর্যায়ের হস্তক্ষেপে কিছু নিপীড়ক দল থেকে বহিষ্কৃত ও বিচারাধীন হতে দেখা যায় কখনো কখনো।
সিলেটের মুরারী চাঁদ (এম,সি) কলেজের সাম্প্রতিক ঘটনা এর-ই পুনরাবৃত্তি মনে করি। এ ব্যাপারে ক্ষমতায় থাকতে বর্তমান বিরোধী জোট ও অঙ্গ সংগঠন সমূহের ভূমিকাও সুখকর নয়। স্বাধীনতা বিরোধী দলগুলোর নেতা-কর্মী ও সহযোগীদের পাশবিকতা শুধু ইতিহাসে লিপিবদ্ধ নয়, যুদ্ধাপরাধের বিচারে প্রমানিত সত্য। ঘটনার সত্যতা আছে কিনা জানিনা, নারী নির্যাতনের অভিযোগ উঠেছে নতুন প্রজন্মের অনেকের ভরসা স্থল, সাধারণ ছাত্র পরিষদের কিছু নেতৃবর্গের বিরুদ্ধেও, তাঁদের এক সদস্যার মাধ্যমে।
পরিবার, শশুরালয়, আত্নীয়, সহপাঠী, সহকর্মী, শিক্ষক, মাদ্রাসা-শিক্ষক, ধর্মীয় গুরু, বাস/ স্কুটার চালক, হেল্পার, সহযাত্রী, পথচারী, সর্বত্রই বাংলার নারী ও শিশু আজ লালসার শিকার। ভুক্তভোগী পরিবার ও সুহৃদের পাশাপাশি সাধারণের প্রশ্ন এ নিপীড়নের শেষ কবে? কিভাবে?
বাংলাদেশের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ এবং এর সংশোধনী-২০০৩ যথেষ্ট শক্তিশালী । এর ৯(১) উপ ধারায় ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড। ৯(২) উপধারা অনুযায়ী ধর্ষণের ফলে বা পরবর্তীতে ধর্ষকের কার্যকলাপের কারণে নির্যাতিতা নিহত হলে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। আসলে ধর্ষিতার মানসিক মৃত্যু ঘটে যখন তাঁর অসম্মতিতে (অনধিক ১৬ বছরের শিশুর ক্ষেত্রে সম্মতি থাকলেও) নারীত্বের চরম অবমাননা ঘটে ।
মানসিক মৃত্যু বা হৃদয়ের ক্ষরণ আমৃত্যু বয়ে যেতে হয় একজন নির্যাতিতাকে, তাঁর শারীরিক ক্ষতি না ঘটে থাকলেও। এই বিবেচনায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০-এর ৯ (১) উপধারায় ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডের পরিবর্তে মৃত্যু দণ্ড করা যেতেই পারে । ২০০২ সালে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যু দণ্ডের আইন হবার পরে এসিড নিক্ষেপের হার উল্লেখযোগ্য মাত্রায় কমেছিল বলে নারী ও শিশু ধর্ষণ নির্মূলে এই দাবী ক্রমশঃ জোরদার হয়ে উঠছে বলে মনে হয় ।
শুধুমাত্র মৃত্যুদণ্ডের আইন বা দ্রুত বিচারের ব্যবস্থা নিলেই কী এ-জঘন্য নিপীড়ন থেকে রক্ষা পাবে জাতি? দেশের বাইরে, বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যে নারী নির্যাতনের চরম শাস্তির বিধান থাকা সত্বেও সেখানে কর্মরতা অনেক বাঙালী নারীর পাশবিক নিপীড়নের সংবাদ দেখি প্রায়ই। সবিনয়ে জানতে চাই, কানাডায় বসবাসরতা বাঙালী নারী নির্যাতনের খবর পেয়েছি আমরা ক’টা?
বিচারের দীর্ঘ প্রক্রিয়া ও তুলনামূলক কম মাত্রার শাস্তির বিধান থাকা সত্বেও কানাডায় নারী নির্যাতন প্রায় সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে। অভিবাসী ও নাগরিকের পাশাপাশি কানাডায় বৈধ ভাবে কর্ম/ অধ্যয়নরতা সব নারী ও শিশু প্রচলিত আইনে রাষ্ট্রের সর্বাধিক অধিকার বহন করে। রাষ্ট্র ও শাসন ব্যবস্থার পাশাপাশি স্কুল-বিশ্ববিদ্যালয় ও অনানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যবস্থায় নারীর মান ও মর্যাদাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়। নারীর
ক্ষমতায়ন শুধু কানাডার সংবিধানেই লেখা নেই, এর প্রকৃত বাস্তবায়ন উপলব্ধি করা যায় পরিবার থেকে শুরু করে প্রায় সর্বত্র। প্রাপ্তবয়স্ক নারীরা স্বাধীনতা ভোগ করে পোশাক পরিধানে, কাজে, খেলাধুলায় এবং সর্বোপরি নিজের গর্ভের সিদ্ধান্তে। যৌন নির্যাতনকারীর কোন প্রকার প্রশ্রয় দূরে থাক নৈতিক স্খলনের অভিযোগ প্রমানিত হলে এদের ঠাঁই হয়না কোন রাজনৈতিক দল, উপাশনালয়, শিক্ষা ও কর্ম স্থলে।
বছর ছ’য়েক আগে একজন যুবা-সহকর্মীর পিঠে বিনা সম্মতিতে হাত দেবার অপরাধে এক সম্ভবনাময়, স্থানীয় (বংশ পরম্পরায় কানাডিয়ান) তরুণ প্রকৌশলীকে তাৎক্ষনিকভাবে বরখাস্তের আদেশ প্রত্যক্ষ করেছি আমি। পোশাকের ধরণ বা সাজ শ্লীলতাহানী কিংবা নির্যাতনের অজুহাত হিসেবে বিবেচিত হয়না এখানে । মধ্যরাতেও ট্রেনে, বাসে চড়ে নিরাপদে বাসায় ফিরে তরুণীরা কাজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও লাইব্রেরী থেকে । পরিবার থাকে নিশ্চিন্ত। সমাজ ও সভ্যতা এতেই অভ্যস্ত।
এবার ফিরি বাংলাদেশের বাস্তবতায় করণীয় প্রসঙ্গে। সবার আগে ক্ষমতাসীন দলকে ধর্ষণে সংশ্লিষ্ট বা সহায়তাকারী নেতা/ সদস্যদের সাময়িক বহিস্কার ও আইনে সোপর্দ নিশ্চিত করতে হবে অভিযোগ প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে। আদালতে অভিযোগ প্রমানিত হলে শাস্তির মাত্রা যাই হোক, নীতিস্খলনের দায়ে আজীবনের জন্য সদস্যপদ বাতিল করতে হবে ।
হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী, বঙ্গবন্ধুর গড়া সংগঠন গুলোতে এসব নরাধম প্রশ্রয় পেতে পারেনা কোন অজুহাতেই। এক-ই ব্যবস্থা নিতে হবে অন্য সব রাজনৈতিক দলেও । এক দল থেকে বহিষ্কৃত যেন আরেক দলে বা অঙ্গ সংগঠনে ঠাঁই না পায়। নির্বাচন কমিশন ও আদালত এসব দুরবিত্তের ডিজিটাল, বায়োমেট্রিক ডাটাবেস সরবরাহ করে সাহায্য করতে পারে সব রাজনৈতিক দলগুলোকে ।
সংশ্লিষ্ট আইনের সংস্কারের মাধ্যমে এদেরকে প্রাথমিক সদস্য পদ সহ যে কোন সাংগঠনিক পদের অযোগ্য ঘোষণা না করা হলে নির্বাচন কমিশন দলীয় রেজিস্ট্রেশন বাতিল বা স্থগিত করার ক্ষমতা থাকতে হবে। ছাত্র সংসদ, স্থানীয় সরকার ও জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এসব দুরবিত্তের প্রার্থিতার অযোগ্য বিবেচিত হবে। সরকারী চাকরীর প্রার্থিতা বাতিলে একই ধরনের আইন নিয়ে ভাববার সময়ও এসে গেছে ।
সব দলের ছাত্র-যুব নেতাদের একসাথে কর্মসূচী দিতে হবে নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধ্বে, দল, মত, ধর্ম ও আঞ্চলিকতার পক্ষ না নিয়ে । ছাত্ররা দৃঢ় ভাবে রুখে দাঁড়ালে কার সাধ্য হবে ছাত্রী ও নারীর অবমাননা করার ? প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পাঠক্রমে সহপাঠী নারীর সম্মান ও মর্যাদা বিষয়ক শিক্ষা বাধ্যতামুলক করতে হবে। নিপীড়ক শিক্ষক ও ধর্মগুরুদের ক্ষেত্রে শিক্ষালয়, উপাসনালয়, মাদ্রাসা ও সব ধর্ম শিক্ষালয়কে হতে হবে আরও কঠোর। ছাত্রীর ও নারীর নিরাপত্তায় তাঁদেরও দায়িত্ব অপরিসীম সরকার ও আইন রক্ষাকারী বাহিনীর সমান্তরালে।
সময় মত সম্মানের সাথে ধর্ষিতার ডাক্তারি পরীক্ষার প্রয়োজন সবার আগে। ন্যায় বিচারের স্বার্থে ও নিরাপরাধীর হয়রানি রোধে নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠানে ডি,এন,এ, সহ আধুনিক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে ধর্ষক শনাক্ত করতে হবে। আই, সি, ডি, ডি,আর, বি অথবা অনুরূপ বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের সাহায্য নেওয়া হলে এসব পরীক্ষায় স্বচ্ছতা বজায় থাকবে। রাজনৈতিক, আর্থিক, সামাজিক ও ধর্মীয় প্রভাবশালী ধর্ষক যেন রাষ্ট্রীয় বা সামাজিক আনুকূল্য না পায়।
রাষ্ট্র, সরকার,রাজনীতিক ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর উপর দায় চাপিয়ে পার পাওয়া যাবেনা । শুধু জীবিকার জন্য পড়া লেখা নয়, শিক্ষা নিতে হবে নারী বান্ধব মানসিকতা ও নৈতিকতা উন্নয়নের জন্য। কেবল মাত্র শিক্ষালয়, সচিবালয়, পুলিশ বাহিনী, প্রতিরক্ষা বাহিনীর উচ্চ পদে, বিচারকের আসনে, স্থানীয় সরকারে, জাতীয় সংসদে, মন্ত্রীপরিষদে নারীর সংখ্যা বৃদ্ধি করে তাঁদের ক্ষমতায়ন করা যাবেনা। জাতির কাজে ও আচরণে নারীর স্বাধীনতায় বিশ্বাস থাকতে হবে। মেনে চলতে হবে সংশ্লিষ্ট আইন ও আস্থা থাকতে হবে বিচার প্রক্রিয়ায়। নারীকেও হতে হবে সাহসী, আইন ও অধিকার সচেতন।
পরিশেষে রাজশাহী প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের পরম শ্রদ্ধেয় ডঃ মতলুব আলী খান স্যারের (তৎকালীন বি,আই,টি-র যন্ত্রকৌশল বিভাগের প্রধান ও অবসরপ্রাপ্ত) এক বিশেষ উক্তি স্মরণ করি । চতুর্থ বর্ষের Industrial Management পড়ানোর সময় উন্নয়ন ও শিল্পায়নের পূর্ব শর্ত, মান সম্পন্ন শিক্ষার (Quality-Education) উদাহরণ হিসাবে উনি ক্লাসে বলেছিলেনঃ জাপানে নাইট ক্লাবে গভীর রাতে, উদ্যম নৃত্যের সময় বিদ্যুৎ বন্ধ হয়ে অন্ধকার নেমে আসলেও কোন নারী লাঞ্ছিত হয়না।
শিশু কাল থেকে সেখানে ছেলেদের শিক্ষা, নিজের মা ও বোনের মতোই প্রতিটি নারী সমান সম্মানের, শ্রদ্ধার ও মমত্বের। এ-উদাহরণ তিনি দিয়েছিলেন যৌবনে জাপানে তাঁর সুদীর্ঘ শিক্ষাকালের বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে। বাংলাদেশে উন্নয়ন ও শিল্পায়ন প্রচেষ্টার সার্বিক সাফল্য কামনা করি। তবে এর জন্য দরকার শিক্ষার মান উন্নয়ন ও নারীর ক্ষেত্রে পুরুষের তথা সমাজের মানসিকতার শুভ পরিবর্তন।
প্রবাস বাংলা ভয়েস/ঢাকা/ ০৮ অক্টোবর ২০২০/এমএম





