বাংলানিউজসিএ ডেস্ক :: ’৫২-এর ছাত্র-জনতার আন্দোলনের পর ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের সূত্র ধরে ১৯৭০ সালে পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে বাধ্য হয়। নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের রায়ের প্রতিফলনের কারণে পূর্ব পাকিস্তান তথা বাঙালিদের ক্ষমতালাভের প্রশ্ন দেখা দেয়।
এ রায়ের স্বীকৃতি হিসেবে পূর্ব পাকিস্তান থেকেই দেশের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার সুস্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যায়।
কিন্তু পাকিস্তানের ষড়যন্ত্রের রাজনীতির নিয়মই ছিল পূর্ব পাকিস্তান তথা এদেশের জনগণকে প্রাপ্য সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত করে জোরজবরদস্তির রাজনীতি চালু রাখা।
যেহেতু নির্বাচনের রায়ে পূর্ব পাকিস্তানের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রশ্ন দেখা দেয় অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তান থেকেই প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনের সম্ভাব্য প্রার্থী ছিলেন বঙ্গবন্ধু, সেহেতু ইয়াহিয়া খান মহাষড়যন্ত্রের জাল বুনে নির্বাচনের রায় স্থগিত করে বাঙালিদের বিরুদ্ধে ২৫ মার্চ কালরাতে অতর্কিতে ভয়াবহ নিধনযজ্ঞের সূচনা করে।
এ পরিপ্রেক্ষিতে বাঙালিদের অকুতোভয় নির্ভীক সাহসী নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে আটক করা হয়। কিন্তু দূরদর্শী নেতা বঙ্গবন্ধু ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ স্বাধীনতার পূর্বাভাস হিসেবে এক দিকনির্দেশনামূলক ভাষণে বলে দিয়েছিলেন যে, ‘তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো। … এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
এ ভাষণে জাতি, ধর্ম, বর্ণ, নির্বিশেষে বাঙালি জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়ে আন্দোলন-সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে। কিন্তু অবিসংবাদিত নেতা আমাদের মধ্যে সশরীরে উপস্থিত না থাকার কারণে আমরা যারপরনাই কিছুটা হতবিহ্বল হয়ে একটা শূন্যতা অনুভব করছিলাম। আমাদের অস্ত্র ও সেনাবাহিনী বলতে কিছু নেই। এ আন্দোলন-সংগ্রাম টিকে থাকবে তো? এমন একটা ধোঁয়াশার সৃষ্টি হয়েছিল।
হতাশার অন্ধকার দূর হয়ে কুষ্টিয়ার মেহেরপুর আম্রকাননে মুজিবনগর সরকার গঠনের সুসংবাদ আমাদের মাঝে আশার আলো জ্বালিয়ে দেয়। শুকিয়ে যাওয়া তৃষ্ণার্ত গলায় এক ফোঁটা পানি পাওয়া যায় যেন। আমরা গা-ঝাড়া দিয়ে সতেজ ও সক্রিয় হওয়ার পথ খুঁজে পাই। আমরা এতদিন দেশের জন্য যে সংগ্রাম-আন্দোলন করেছি, তা বাস্তবায়নের উজ্জ্বল সম্ভাবনা দেখা যায় মুজিবনগর সরকার গঠনের মধ্য দিয়ে।
১৭ এপ্রিল ১৯৭১ মুজিবনগর সরকার গঠন আমাদের জন্য ছিল মুক্তিযুদ্ধ চালিয়ে নেয়ার এক মহান অনুপ্রেরণা। মন্ত্রিসভার সদস্যদের শপথ গ্রহণের মধ্য দিয়ে এদিন থেকেই দেশের জনগণ একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কর্তৃত্ব লাভ করে। এককথায় ঐতিহাসিক অস্থায়ী মুজিবনগর সরকার গঠনের মাধ্যমে বাঙালি জাতি একটি মুক্ত, স্বাধীন আবাসভূমি প্রতিষ্ঠা করে এক স্বপ্নিল বাংলাদেশ গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখে।
বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রপতি এবং তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী এবং সৈয়দ নজরুল ইসলামকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি বানিয়ে যাত্রা শুরু হয় বাংলাদেশের প্রথম সরকারের। এ সরকারের নেতৃত্বেই পরিচালিত হতে থাকে মুক্তিযুদ্ধ এবং দীর্ঘ নয় মাস পর ’৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর আমরা অর্জন করি স্বাধীনতা। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান কারাগার থেকে ফিরে আসেন স্বাধীনতাপ্রাপ্তির ২৫ দিন পর ’৭২-এর ১০ জানুয়ারি।
কিন্তু স্বাধীনতার ৪৮ বছর পরও কি আমরা আমাদের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে পেরেছি? ’৭৫ থেকে টানা ২১ বছর বাংলাদেশ চলেছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিপরীত স্রোতে। হত্যা করা হয়েছে বঙ্গবন্ধুসহ জাতীয় চার নেতাকে।
দিক নির্দেশনাশূন্য এক দিশেহারা জাতি ছিলাম আমরা ’৯৬ সাল পর্যন্ত। যদিও গত ১০ বছরে দেশ অনেকটা এগিয়ে গেছে, তথাপি মুক্তিযুদ্ধের প্রধান আদর্শ- অর্থনৈতিক বৈষম্য দূরীকরণ- সেই লক্ষ্য আমরা অর্জন করতে পারিনি। দেশের অর্থনীতি শক্ত হয়েছে বটে, কিন্তু বৈষম্য দূর হয়নি। তার চেয়ে বড় কথা, মানবিক মূল্যবোধের সূচকে অনেক নেমে গেছি আমরা। ফেনীর নুসরাত জাহান রাফির নির্মম হত্যাকাণ্ড আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থী একটি ঘটনা।
আজ মুজিবনগর সরকার দিবসে আমাদের নতুন করে ভাবতে হবে আমরা আদৌ কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছতে পেরেছি কিনা। যদি না পেরে থাকি, তাহলে ’৭১-এর ১৭ এপ্রিলের মতো আমাদের নতুন করে আবার শপথ নিতে হবে। ৩০ লাখ মানুষের রক্ত বৃথা যেতে পারে না।
বাংলানিউজসিএ/ঢাকা/ ১৭ এপ্রিল ২০১৯/এমএম