বাংলানিউজসিএ ডেস্ক :: করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত বাংলাদেশের ক্ষুদ্র ও মাঝারি কৃষকদের সহায়তা করার জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্প্রতি ৫ শতাংশ সুদে ৫ হাজার কোটি টাকার একটি প্রণোদনা ঘোষণা করেছেন।
প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী বাংলাদেশ ব্যাংক গত ২০ এপ্রিল ২০২০ তারিখে একটি সার্কুলারের মাধ্যমে নিজস্ব তহবিল থেকে ‘নিম্ন আয়ের পেশাজীবী, কৃষক ও প্রান্তিক/ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের জন্য পুনঃঅর্থায়ন স্কিম, ২০২০’ নামে ৫ হাজার কোটির পরিবর্তে ৩ হাজার কোটি টাকার একটি আবর্তনশীল পুনঃঅর্থায়ন স্কিম চালু করেছে।
শুরুতে এই ঋণ কার্যক্রমের বাস্তবায়ন নিয়ে বিভিন্ন পর্যায়ে নানা ধরনের ধোঁয়াশা থাকলেও দ্রুততার সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংক সামগ্রিক বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া ঘোষণা করেছে। সার্কুলার অনুয়ায়ী মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটি কর্তৃক সনদপ্রাপ্ত ক্ষুদ্রঋণ সংস্থাগুলো নিম্ন আয়ের পেশাজীবী, কৃষক এবং প্রান্তিক ও ক্ষুদ্রব্যবসায়ীর কাছে এই ঋণের টাকা পৌঁছে দিবে।
তবে সে ক্ষেত্রে লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, গ্রাহক পর্যায়ে ঋণের সুদের হার প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী ৫ শতাংশ আর থাকছে না। সেটা হয়ে গেল ৯ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংক প্রথমে অর্থায়নকারী ব্যাংকগুলোকে ১ শতাংশ সুদে উক্ত টাকা দিবেন। ব্যাংকগুলো ৩.৫ শতাংশ সুদে ক্ষুদ্রঋণ প্রদানকারী সংস্থাগুলোকে তা দিবে। আর ক্ষুদ্রঋণ সংস্থাগুলো গ্রাহকের কাছ থেকে এই ঋণের জন্য সুদ আদায় করতে পারবে সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ। অর্থাৎ এখানে মুনাফা হিসাবে অর্থায়নকারী ব্যাংকগুলো পাবে ২.৫ শতাংশ এবং ক্ষুদ্রঋণ সংস্থাগুলো পাবে ৫.৫ শতাংশ।
সার্কুলার অনুযায়ী এই স্কিমের আওতায় ক্ষুদ্রঋণ হিসাবে একক গ্রাহকের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ঋণের পরিমাণ হবে ৭৫ হাজার টাকা এবং ৫ সদস্যবিশিষ্ট গ্রুপের ক্ষেত্রে হবে সর্বোচ্চ ৩ লাখ টাকা; যার মেয়াদ হবে গ্রেস পিরিয়ডসহ এক বছর। আর ক্ষুদ্র উদ্যোক্তার ক্ষেত্রে এককভাবে এই ঋণের পরিমাণ হবে ১০ লাখ টাকা এবং ৫ সদস্যবিশিষ্ট গ্রুপের ক্ষেত্রে হবে সর্বোচ্চ ৩০ লাখ টাকা এবং মেয়াদ হবে গ্রেস পিরিয়ডসহ সর্বোচ্চ ২ বছর। উভয় ক্ষেত্রে গ্রাহককে সাপ্তাহিক ও মাসিক কিস্তিতে পরিশোধ করতে হবে। এই ৩ হাজার কোটি টাকার ঋণ স্কিমের ৭৫ ভাগ যাবে ক্ষুদ্রঋণ/বিনিয়োগ খাতে এবং ২৫ ভাগ যাবে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা ঋণ/বিনিয়োগ খাতে।
এই হল ৩ হাজার কোটি টাকা ঋণের সারসংক্ষেপ। বাংলাদেশ ব্যাংককে এই ঋণ বাস্তবায়নে ক্ষুদ্রঋণ সংস্থাগুলোকে নির্ধারণ করার জন্য ধন্যবাদ দেয়া দরকার। এটি একটি বিচক্ষণ এবং সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত বলা যায়। তবে এক্ষেত্রে এখনও কিছু অপ্রয়োজনীয় ধারা ও সাহসী পদক্ষেপের অভাবে এই স্কিমটি ভালোভাবে বা দ্রুততার সঙ্গে বাস্তবায়ন হবে কিনা সন্দেহ থেকে যায়।
যেমন, বাংলাদেশ ব্যাংক সরাসরি ক্ষুদ্রঋণ সংস্থাগুলোকে না দিয়ে ব্যাংককে মাধ্যম হিসাবে ব্যবহার করার কারণে কৃষককে বাড়তি ২.৫ শতাংশ সুদ বেশি গুনতে হবে। এখানে ব্যাংকগুলোর মধ্যস্বত্বভোগী হিসেবে কাজ করার কোনো প্রয়োজন আদৌ আছে কিনা, তা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভেবে দেখা উচিত। কার্যক্রমটির দ্রুত এবং কার্যকর বাস্তবায়নের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতি নিম্নোক্ত সুপারিশ পেশ করছি-
ক্ষুদ্রঋণ সংস্থাগুলোর জন্য স্প্রেড ঠিক করা : ক্ষুদ্রঋণ সংস্থাগুলোর জন্য চ্যালেঞ্জের বিষয়টি হল, ৫.৫ শতাংশ মার্জিনে ঋণ কার্যক্রমটি পরিচালনা করা। ক্ষুদ্রঋণ সংস্থাগুলোর খরচ যদি আমরা পর্যালোচনা করি তাহলে দেখব, তাদের অর্থসংস্থানের খরচ গড়ে ৭ থেকে ৮ শতাংশ (গ্রাহকের সঞ্চয়ের সুদ ও ব্যাংক ঋণের সুদ উভয়ে মিলে)। ঋণ পরিচালনা খরচ প্রায় ৭ থেকে ৯ শতাংশ। এছাড়া আছে মন্দ ঋণের জন্য ঋণ সঞ্চিতি খরচ। এখন এক্ষেত্রে ঋণের আর্থিক খরচ ৩.৫ শতাংশ এবং পরিচালনা খরচ যদি কমপক্ষে ৭ শতাংশ হয় তাহলে মোট খরচ হবে ১০.৫ শতাংশ (অন্যান্য খরচ বাদ দিলাম)।
সেক্ষেত্রে কিভাবে ক্ষুদ্রঋণ সংস্থাগুলোর পক্ষে ৯ শতাংশ হারে এই ঋণ বিতরণ করা সম্ভব হবে, তা আমার বোধগম্য নয়। বাংলাদেশ ব্যাংক যে হারে ক্ষুদ্রঋণ সংস্থাগুলোকে প্রদান করবে, তার থেকে অন্তত ১০ শতাংশ বেশি হারে যদি ক্ষুদ্রঋণ সংস্থাগুলো সুদ ধার্য করতে না পারে তাহলে তাদের পক্ষে এই ঋণ কার্যক্রম পরিচালনা করা কষ্টসাধ্য হবে।
সরাসরি এমএফআইকে প্রদান করা : বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সরাসরি ১ শতাংশ হারে বাণিজ্যক ব্যাংকে না দিয়ে উক্ত হারে সরাসরি ক্ষুদ্রঋণ সংস্থাগুলোকে প্রদান করা। ফলে অতি সহজে খরচ ২.৫ শতাংশ কমানো যাবে। বাংলাদেশ ব্যাংক অতীতে এ কাজ করেছে।
বিগত গভর্নরের সময় বাংলাদেশ ব্যাংক সরাসরি ৫ শতাংশ সুদে বর্গাচাষীদের ঋণ প্রদান করার জন্য উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাককে ৫০০ কোটি টাকা প্রদান করেছেন এবং ব্র্যাক তা বর্গাচাষী উন্নয়ন প্রকল্পের নামে প্রায় ৩ লাখ কৃষককে ১৮ শতাংশ হারে কৃষিঋণ হিসেবে প্রদান করেছেন এবং কৃষকদের কাছ থেকে যথাসময়ে উক্ত টাকা আদায় করে সম্পূর্ণ টাকা বাংলাদেশ ব্যাংককে পরিশোধ করেছেন। সুতরাং এখন যদি বাংলাদেশ ব্যাংক ১ শতাংশ হারে ক্ষুদ্রঋণ সংস্থাগুলো প্রদান করে তাহলে তারা যদি ৯ শতাংশেও কৃষককে প্রদান করে তাহলে ক্ষুদ্রঋণ সংস্থাগুলোর পক্ষে এই ঋণ পরিচালনা করতে উৎসাহিত হবে।
অগ্রাধিকার ভিত্তিতে জেলা, জোন, দারিদ্র্যপীড়িত এলাকা বা খাত নির্ধারণ করা : ৩ হাজার কোটি টাকা মাত্র কয়েক লাখ কৃষক পরিবারকে ঋণ হিসেবে প্রদান করা সম্ভব, যেখানে বাংলাদেশে মোট কৃষি পরিবার প্রায় ১.৬৫ লাখ। এখন দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হবে, এই টাকা আমরা কি ৬৪ জেলায় কিছু কৃষককে দিব; নাকি কিছু কিছু জেলাকে অধিকতর গুরুত্ব দিয়ে নির্দিষ্ট করে নিব। এক্ষেত্রে আগামী দুই মাসে কোন জেলা বা জোনগুলো কৃষি উৎপাদনের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ, সেগুলো বেছে নেয়া যায় কিংবা কোন ফসলকে, কোন কৃষি ব্যবসাকে অধিকতর গুরুত্ব দিব; সেটি বিবেচনা করা যেতে পারে। তাহলে দ্রুতহারে কয়েকটি খাতকে বাঁচানো সম্ভব হবে।
জেলাভিত্তিক ক্ষুদ্রঋণ সংস্থা নির্ধারণ করা : প্রত্যেক জেলায় মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটির লাইসেন্সপ্রাপ্ত ক্ষুদ্রঋণ সংস্থা আছে। এছাড়া বৃহৎ এমএফআইগুলোর শাখা প্রতিটি উপজেলায় আছে। এখন যদি প্রতিটি জেলায় কয়েকটি সংস্থাকে কাজ করতে না দিয়ে জেলাভিত্তিক ভাগ করে দেয়া যায় তাহলে এ ঋণের ওভারলেপিং হ্রাস পাবে।
এককালীন ঋণ পরিশোধের সুযোগ রাখা : সার্কুলার অনুযায়ী ঋণের মেয়াদ হবে এক বছর এবং দুই বছর; কিস্তি হবে সাপ্তাহিক ও মাসিক। এর পাশাপাশি কৃষির ধরন অনুযায়ী ঋণের মেয়াদ ত্রৈমাসিক/ষাণ্মাসিক করা যেতে পারে এবং পাশাপাশি বুলেট পেপেন্ট বা এককালীন কিস্তি প্রদানের ব্যবস্থা রাখা যেতে পারে। বর্তমানে এটি খুবই একটি জনপ্রিয় পদ্ধতি হিসেবে বিশেষভাবে পোল্ট্রি, হাঁসপালন, গবাদিপশু ইত্যাদির ক্ষেত্রে খুবই উপকারী একটি ঋণ ব্যবস্থা।
ডিজিটাল ব্যবস্থাকে গুরুত্ব দেয়া : এই ঋণ কৃষকদের বিকাশ, নগদ, রকেট ইত্যাদি মোবাইলভিত্তিক ওয়ালেটের মাধ্যমে প্রদান করার জন্য ক্ষুদ্রঋণ সংস্থাগুলোকে এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংককে গুরুত্ব দিতে হবে। এখন অনেক কৃষষ ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তার মোবাইল ওয়ালেট আছে। তাছাড়া মোবাইল ওয়ালেট খোলা এখন খুবই সহজ। এখন আমরা এ ঋণের জন্য ২০ লাখ কৃষক বা ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাকে মোবাইল ওয়ালেটের মাধ্যমে লেনদেন করাতে পারি, তাতে একদিকে যেমন দ্রুত সেবা পৌঁছে দেয়া যাবে; অন্যদিকে স্বচ্ছতাও প্রতিষ্ঠিত হবে।
বাংলানিউজসিএ/ঢাকা/ ১৭ জুন ২০২০ /এমএম





