বাংলানিউজসিএ ডেস্ক :: করোনা মহামারীর এ বিপজ্জনক সময়ের মাঝেই ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাবের আশঙ্কা অনেকের মনে উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে। বছরের শুরুতে অধিক বৃষ্টিপাত এডিস মশা বৃদ্ধির অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। তাছাড়া এ বছরের প্রথম তিন মাসে গত বছরের ওই সময়কালের তুলনায় প্রায় চার গুণ বেশি ডেঙ্গু রোগী পাওয়া গেছে। লকডাউনের কারণেও ঘরবন্দি মানুষ অধিক হারে ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হতে পারেন।
ইতোমধ্যে সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ায় ডেঙ্গুজ্বরের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লি ও ব্রাজিলে কোভিড-১৯ মহামারীর মধ্যেই ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ার প্রকোপ শুরু হয়ে গেছে। কয়েক স্থানে কোভিড-১৯ ও ডেঙ্গুজ্বর উভয় রোগে একই সঙ্গে আক্রান্ত হওয়ার উদ্বেগজনক তথ্যও পাওয়া গেছে। বাংলাদেশে কোভিড-১৯ মহামারীর মধ্যে যদি ডেঙ্গু কিংবা চিকুনগুনিয়ার প্রাদুর্ভাব ঘটে, তবে সে ক্ষেত্রে আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা সম্পূর্ণভাবে পর্যুদস্ত হয়ে পড়বে। এ ধরনের ভয়াবহ পরিস্থিতি এড়ানোর সবচেয়ে কার্যকরী উপায় হচ্ছে, ডেঙ্গু রোগের সংক্রমণকারী এডিস মশা নিবারণ করা। এডিস মশা নিবারণে নাগরিক সমাজ, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও স্থানীয় সরকার কর্তৃপক্ষের সুনির্দিষ্ট ভূমিকা আছে। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, কার কী করণীয়, সে সম্পর্কে অনেকেই সম্পূর্ণভাবে অবহিত নন। এ লেখাটির মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে, করোনাকালে ডেঙ্গু রোগ প্রতিরোধে কার কী করণীয়, সে বিষয়ে আলোকপাত করা।
নাগরিকের করণীয়
১. এডিস মশা মেরে ফেলার জন্য ঘরে নিয়মিতভাবে অ্যারোসল, ম্যাট, ভ্যাপোরাইজার প্রয়োগ করা। সম্ভব হলে মসকুইটো রিপেলেন্ট (ডিইইটি ৩০-৫০%) ব্যবহার করা।
২. ঘরের ভেতর-বাহির ও ছাদে পাত্রে জমে থাকা পানি সপ্তাহান্তে ফেলে দেয়া। অব্যবহার্য পাত্র, ড্রাম, বালতি, টায়ার ও অন্যান্য আবর্জনা অপসারণ করা। পরিত্যক্ত চৌবাচ্চা (যদি থাকে) ভরাট করা অথবা প্রতি দুই সপ্তাহ অন্তর লার্ভিসাইডিং কিংবা ডিজেল বা কেরোসিন প্রয়োগ করা। ফুলের টবের মাটির থালার পানি সপ্তাহান্তে নিষ্কাশন করা; অন্যথায় দুই সপ্তাহ অন্তর গ্রানুলার লার্ভিসাইড প্রয়োগ।
৩. বাড়িতে ডেঙ্গু রোগী থাকলে তাদের দিনরাত মশারির ভেতরে রাখা, যাতে অন্যদের মধ্যে সংক্রমণ ছড়িয়ে না পড়ে। অন্য সবার ক্ষেত্রে, বিশেষ করে শিশু ও বৃদ্ধদের, দিনরাত যে কোনো সময় নিদ্রাকালে মশারির ব্যবহার নিশ্চিত করা।শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ব্যবসা কেন্দ্র, সামাজিক সংগঠন, সরকারি দফতর ও অন্যদের করণীয়
১. লকডাউনে দীর্ঘদিন বন্ধ ভবনগুলোয় এডিস মশা বৃদ্ধি পেতে পারে। ভবনগুলোয় ফগিং ও লার্ভিসাইডিংয়ের সঙ্গে অপ্রয়োজনীয় পাত্র, আবর্জনা অপসারণ করা। সব প্রতিষ্ঠানে সপ্তাহান্তে পরিচ্ছন্নতা কর্মসূচি চালান ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রোভার, স্কাউট, গার্ল গাইডের নেতৃত্বে পরিচ্ছন্নতা কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা।
২. নির্মাণাধীন ভবনগুলো এডিস মশার অন্যতম প্রধান উৎসস্থল। বাস্তব পরিস্থিতি বিবেচনায় এসব স্থানে প্রতি তিন দিন অন্তর জমে থাকা পানি নিষ্কাশন করে মশা নিবারণ সম্ভব নয়। নির্মাণাধীন ভবনে প্রতি দুই সপ্তাহ অন্তর মিস্ট ব্লোয়ার ও ফগারের সাহায্যে লার্ভিসাইডিং ও অ্যাডাল্টিসাইডিং করা। প্রশিক্ষিত কর্মীদের সমন্বয়ে টিম গঠন করে রিহ্যাবের নেতৃত্বে নির্মাণাধীন ভবনগুলোয় মশা নিবারণ করা প্রয়োজন।
৩. কিছু সংস্থার (পুলিশ স্টেশন, সরকারি অফিস ইত্যাদি) আঙ্গিনায় যানবাহন, টায়ার ও অন্যান্য বস্তু দীর্ঘদিন ফেলে রাখা হয়, যা আইনগত বাধ্যবাধকতার কারণে দ্রুত অপসারণ করা যায় না। সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর কর্তৃপক্ষের নেতৃত্বে এসব স্থানে মশা নিবারণের জন্য প্রতি দুই সপ্তাহ অন্তর লার্ভিসাইডিং ও অ্যাডাল্টিসাইডিং করা দরকার।
৪. নগরের এলাকাভিত্তিক সমিতিগুলো মশা নিবারণ কর্মকাণ্ডে ক্রমেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। এসব সমিতির মশা নিবারণ জনবল ও কারিগরি সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য স্থানীয় সরকারের পক্ষ থেকে সহযোগিতা করা প্রয়োজন। বৃহত্তর নাগরিক সমাজের বিভিন্ন সংগঠনকে মশা নিবারণ, বিশেষ করে জনসচেতনতামূলক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত করা।
৫. কোভিড-১৯ আক্রান্ত ব্যক্তিদের ডেঙ্গুমুক্ত রাখার জন্য সব কোভিড হাসপাতাল, আইসোলেশন ও কোয়ারেন্টিন কেন্দ্রে রোগীদের মশারির ভেতরে রাখা ও মসকুইটো রিপেলেন্টের ব্যবহার নিশ্চিত করা। হাসপাতালের ভেতরে ও বাইরে যে কোনো স্থানে পাত্রে জমে থাকা পানি সপ্তাহান্তে নিষ্কাশন ও আবর্জনা অপসারণ।
স্থানীয় সরকারের করণীয়
১. মোবাইল ফোন, গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সাহায্যে নাগরিকদের ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়ার ঝুঁকি সম্বন্ধে সচেতন ও সতর্ক করা।
২. বাসস্ট্যান্ড, রেলস্টেশন, টায়ারের দোকান, নার্সারি, আবর্জনাপূর্ণ খোলা জায়গা, বাড়িঘরের আশপাশ ও অন্যান্য এডিস-প্রবণ স্থানে প্রতি দুই সপ্তাহ অন্তর লার্ভিসাইডিং ও অ্যাডাল্টিসাইডিং কার্যক্রমের সঙ্গে অপ্রয়োজনীয় পাত্র ও অন্যান্য আবর্জনা অপসারণ। হাসপাতাল এলাকায় প্রতি সপ্তাহে মশা নিবারণ কার্যক্রম চালু রাখা।
৩. ডেঙ্গু রোগী আছে এমন সব বাড়ি চিহ্নিত করে তার ৫০ মিটারের মধ্যে সব বাড়িঘরে লার্ভিসাইডিং ও অ্যাডাল্টিসাইডিং কার্যক্রমের সঙ্গে অপ্রয়োজনীয় পাত্র ও অন্যান্য আবর্জনা অপসারণ। অত্র এলাকার বাসিন্দাদের ডেঙ্গু শনাক্তকরণের মাধ্যমে রোগটির বিস্তার সম্বন্ধে তথ্য সংগ্রহ করা।
৪. কোনো এলাকায় ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব মহামারী পর্যায়ে পৌঁছার প্রাক্কালে বা পৌঁছে গেলে অ্যাডাল্টিসাইডিং (ফগিং, ইউএলভি) করে ভাইরাসবাহী পূর্ণাঙ্গ মশা মেরে ফেলা নিশ্চিত করা। প্রথম সপ্তাহে তিনবার এবং পরবর্তী সময়ে পরিস্থিতি অনুযায়ী প্রতি সপ্তাহে একবার অ্যাডাল্টিসাইডিং করা। পরিস্থিতি অনুযায়ী সাপ্তাহিক লার্ভিসাইডিং ও এডিস প্রজননস্থল ধ্বংস কার্যক্রম চালু রাখা।
৫. মশক কর্মীদের পক্ষে বাসাবাড়ির ভেতরে প্রবেশ করে এডিসের মতো গৃহবাসী, গৃহভোজী মশা নিধন করা প্রায়ই সম্ভব হয় না। নাগরিকরা যাতে নিজেরাই তাদের বাসাবাড়িতে মশা নিবারণ করতে পারেন, তার জন্য চতুর্থ প্রজন্মের অপেক্ষাকৃত নিরাপদ কীটনাশক (আইজিআর, বিটিআই ইত্যাদি) সুলভে প্রাপ্তি নিশ্চিত করার জন্য আমদানি শুল্ক হ্রাস এবং নিবন্ধন প্রক্রিয়া সহজ করা। নাগরিকদের ডেঙ্গুমুক্ত রাখার জন্য সাশ্রয়ী মূল্যে অথবা সম্ভব হলে বিনা মূল্যে মসকুইটো রিপেলেন্ট (ডিইইটি ৩০-৫০%) বিতরণ করা।
ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়ার মতো কীট-সংক্রামিত রোগ সফলভাবে প্রতিরোধ করতে হলে সরকারের উদ্যোগ ও নেতৃত্ব প্রয়োজন। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, এ ক্ষেত্রে সরকারের প্রচেষ্টা প্রায়ই খণ্ডিত, অপ্রতুল এবং বিলম্বিত। জনস্বাস্থ্যে ক্ষতিকর কীটপতঙ্গ নিবারণের জন্য ইন্টিগ্রেটেড ভেক্টর ম্যানেজমেন্ট বা আইভিএম একটি পরিবেশবান্ধব কার্যকরী পদ্ধতি, যা বর্তমানে বহু দেশে প্রচলিত আছে। দেশে আইভিএম পদ্ধতি প্রচলন করার কথা অনেকবার বলা হলেও তা এখন পর্যন্ত বক্তৃতা, বিবৃতিতেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। মশা নিবারণের জন্য জাতীয় পর্যায়ে একটা গাইডলাইনস বা নির্দেশিকা থাকা জরুরি। কয়েকবার উদ্যোগ নেয়া সত্ত্বেও কর্তৃপক্ষের উদাসীনতার জন্য গাইডলাইনস প্রণয়ন করা যায়নি। ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া প্রতিরোধের মূল ভিত্তি হচ্ছে এডিস মশা নিবারণ, যা সার্বিক অর্থে একটি কীটতাত্ত্বিক কার্যক্রম। কিন্তু এ বিষয়ে প্রশিক্ষিত ও অভিজ্ঞ কীটতত্ত্ববিদদের মশক নিবারণ কার্যক্রমে অংশগ্রহণের সুযোগ সীমিত করে রাখা হয়েছে। এতসব সীমাবদ্ধতার মধ্যেও করোনাকালের এ দুর্যোগ মুহূর্তে আমাদের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা থাকবে ডেঙ্গু প্রতিরোধ করা।
তৌহিদ উদ্দীন আহমেদ ও ড. মঞ্জুর আহমেদ চৌধুরী : কীটতত্ত্ববিদ
বাংলানিউজসিএ/ঢাকা/ ১৫ জুন ২০২০/এমএম





