Menu

বাংলানিউজসিএ ডেস্ক :: বাষট্টি বছর আগের কথা। তখন সাত বছর বয়সে আমি একবার নদীতে ডুবে মরতে বসেছিলাম! আমার জন্মভিটার ঠিক দক্ষিণ পাশেই একটি হালট ছিল। এ হালট দিয়েই তখন গাড়ি-ঘোড়া সবকিছু চলত। আর গাড়ি বলতে যা চলত, তা হল গরুর গাড়ি। তো এ হালটের গা ঘেঁষে দক্ষিণে প্রলম্বিত চরঘোষপুর নামক গ্রাম পর্যন্ত বিরাট এলাকাজুড়ে একটি নিচু ভূমি থাকায় বর্ষাকালে তা অথৈ জলে ডুবে নদীতে পরিণত হতো।

আমাদের বাড়ি থেকে সিকি মাইল প্রস্থের সে নদীটি পদ্মা নদীর শাখা হিসেবে আট-দশ ফুট গভীরতায় পূর্ব পশ্চিমে প্রবাহিত হয়ে ইছামতি নদীতে প্রবেশ করত। আরও একটু দক্ষিণে চরঘোষপুর গ্রামের গা ঘেঁষে সে সময়ে মূল পদ্মা নদী প্রবহমান ছিল। এ অবস্থায় বর্ষাকালে তিন মাস সময় আমাদের বাড়ির দক্ষিণের নদীটির পানি হালট ছাপিয়ে কোনো কোনো বছর আমাদের ঘরের ডুয়া (Plinth) পর্যন্ত স্পর্শ করত।

আর সেই নদীতেই মা এবং পাড়ার অন্য ক’জন মহিলার সঙ্গে আমিও সেদিন নাইতে নেমে এক পা-দু’পায়ে দক্ষিণে সরে গেলে থই হারিয়ে স্রোতের তোড়ে ভেসে যাচ্ছিলাম। মা এবং পড়শী মহিলারা নদীতে নেমে পরস্পর কথা বলতে থাকায় আমার ভেসে যাওয়া প্রত্যক্ষ করতে পারেননি। সে অবস্থায় আমি কোনোমতে একবার মাথা উঁচু করতে পারছিলাম আবার পরক্ষণেই ডুবে যাচ্ছিলাম এবং আমার মুখ দিয়ে পানিও ঢুকে যাচ্ছিল।

এভাবে কিছু দূর পশ্চিম দিকে ভেসে গেলে নদীর উত্তর তীরে কফিল নামে এক ব্যক্তি কাপড় কাচা অবস্থায় আমাকে দেখতে পেয়ে লাফ দিয়ে সাঁতরে গিয়ে উদ্ধার করে নিয়ে আসেন। সেদিন সেই ব্যক্তির চোখে না পড়লে আমি নির্ঘাত পানিতে ডুবে মারা যেতাম! যদিও মৃত্যুর হাত থেকে সেদিন বেঁচে এসে সেই বয়সে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণ বা মৃত্যুভয় নিয়ে তেমনটা বিচলিত ছিলাম না। কারণ, সাত-আট বছর বয়সে এসব নিয়ে গভীরভাবে চিন্তাভাবনা করার বুদ্ধিটা তখনও হয়ে ওঠেনি। তবে মহান আল্লাহই সেদিন আমাকে রক্ষা করেছিলেন।

আর মহান আল্লাহর ইচ্ছায়ই এভাবে কয়েকবার মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে এসেছি! মুক্তিযুদ্ধকালীন একবার সীমান্ত অতিক্রমের সময় আমরা ধরমদিয়া প্রাগপুর সীমান্তে পাক আর্মির সঙ্গে গোলাগুলিতে লিপ্ত হয়ে প্রায় মরতে বসেছিলাম। সেদিন পাক আর্মির গুলিতে একশ’ জনেরও বেশি মানুষ শহীদ হয়েছিলেন, যাদের অধিকাংশই সীমান্ত পারাপাররত শরণার্থী। তাদের মধ্যে একজন পাক আর্মির লাশও ছিল।

পরে আমরা শহীদদের লাশ দেখে ভীষণ দুঃখ-কষ্ট পেয়েছিলাম এবং বিশ বছর বয়সে একসঙ্গে এতগুলো লাশ দেখে অত্যন্ত গভীরভাবে বেদনাহত হয়েছিলাম। বস্তুত সেদিন থেকেই জীবন-মৃত্যুকে অত্যন্ত কাছ থেকে দেখে জীবন বাঁচাতে লড়াই করতেও শিখছিলাম। এতগুলো মানুষের একসঙ্গে মৃত্যু সেদিন আমাকে অনেক কিছু ভাবতে ও বুঝতে শিখিয়েছিল।

আবার ভারতের শিকারপুর গেরিলা ট্রেনিং ক্যাম্প থেকে স্বল্পকালীন ট্রেনিং শেষে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশের সময়ও পাক আর্মির সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে লিপ্ত হয়ে প্রাণ রক্ষা করেছিলাম। সীমান্তে নতুন করে নির্মিত কাঁচা মাটির একটি রাস্তায় ওঠা এক ট্রাক পাক আর্মিকে আমরা দেখতে না পেলেও একজন কৃষক তা দেখতে পেয়েছিলেন। তিনি তার হাতের নিড়ানির সাহায্যে আমাদের ইশারা দিলে আমরা তা লক্ষ করে পাক আর্মির উপস্থিতি দেখে সামনের আখ ক্ষেতসংলগ্ন একটি শুকনো ডোবায় আশ্রয় গ্রহণের মুহূর্তে পাক আর্মি আমাদের প্রতি গুলিবর্ষণ শুরু করলে আমরাও পাল্টা গুলি চালাই।

এভাবে প্রায় আধা ঘণ্টা গোলাগুলির পর ভারতের দিক থেকে বিএসএফ সাপোর্টিং ফায়ার দিলে পাক আর্মি পালিয়ে যায়। সেদিন আমাদের সামনের আখক্ষেত, পাশের ডোবা এবং বিএসএফের ফায়ারিং- সব মিলিয়ে আমাদের রক্ষা করেছিল।

এর পর একবার সন্ধ্যায় আমরা ঈশ্বরদী পোড়াদহ রেলস্টেশনের মধ্যবর্তী গোলবাথান স্টেশনে পৌঁছালে জানতে পারি, পাক আর্মি পোড়াদহের দিক থেকে ট্রেনে চেপে ঈশ্বরদী আসছে। এ অবস্থায় আমরা পজিশন নেয়ার পাঁচ-সাত মিনিটের মাথায় ধীরগতির ট্রেন আমাদের তিনশ’ গজের মধ্যে চলে আসার পর আমরা ট্রেনটি লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ শুরু করলে স্টেশনের প্রায় কাছাকাছি এসে তা থেমে যায় এবং পরে তারা ফেরত চলে যায়।

তখন আমরা স্টেশনের অপরদিকে উত্তর পাশের রেললাইনে এক্সপ্লোসিভ লাগিয়ে একটি ফিশপ্লেট উড়িয়ে দিয়ে সেই রাতে ভেড়ামারা গিয়ে একটি বাড়িতে আশ্রয় গ্রহণ করি। সেদিন ট্রেন লক্ষ করে গুলি চালানোর সময় আমরা ভালো পজিশনে থাকায় তেমন প্রাণ সংশয় না থাকলেও পরে একটি অপারেশনে তাই ঘটেছিল! আর সে কথাটি বলেই আজকের লেখাটির উপসংহার টানতে চাই।

ভেড়ামারা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের একজন প্রকৌশলী আমাদের বিদ্যুৎ লাইনের একটি টাওয়ার উড়িয়ে দেয়ার বুদ্ধি দিলে আমরা তদনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে টাওয়ারটিতে বিস্ফোরক লাগিয়ে ডেটোনেটর, কড ফিট করে দূরে এসে কডে আগুন ধরিয়ে দিলে বিকট শব্দ করে টাওয়ারটিতে আগুন লেগে আমাদের দিকে ভেঙে পড়ে। আমরা দ্রুত সরে পড়তে গেলে টাওয়ারের মাথার কিছু অংশ একজনের শরীর স্পর্শ করায় সে মারাত্মকভাবে জখম হয়। আমরা সঙ্গে সঙ্গে তাকে নিয়ে তালবাড়িয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের বাড়িতে উঠি। কারণ, চেয়ারম্যান সাহেবের এক পুত্রও একজন মুক্তিযোদ্ধা। পরে সেই রাতেই ডাক্তার ডেকে আমাদের সঙ্গীর চিকিৎসার ব্যবস্থা করে পরদিন আমরা আলাদা আলাদা আস্তানায় চলে যাই।

এভাবেই একাত্তর সালের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে মৃত্যু হাতছানি দিলেও বা মৃত্যুর মুখোমুখি হলেও সে সময়ে মৃত্যুভয় ততটা আকুলিত-ব্যাকুলিত করত বলে মনে পড়ে না। বরং হৃদয়ে খানিকটা রোমাঞ্চ নিয়েই যেন মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে চাইতাম! কিন্তু আজ এতদিন পর এ বয়সে এসে তার সঙ্গে কোনো কিছুরই মিল খুঁজে পাচ্ছি না। সারা দেশ, সারা পৃথিবী যেভাবে মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছে, তা কিছুতেই মেনে নিতে পারছি না।

এভাবে করোনা নামক একটি ভাইরাস ফুট করে দেহে ঢুকে পড়বে আর বাঘা বাঘা এক একজন মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়বেন-এ কেমন কথা, এ কেমন ঘটনা! আর এ রোগের চিকিৎসাই বা আমরা পাব না কেন? পৃথিবীতে এতসব বড় বড় চিকিৎসা বিজ্ঞানী, ডাক্তার, গবেষক, যারা পৃথিবীর বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয় আলোকিত করে বসে আছেন, তাদের সামনে আমরা অসহায়ের মতো মারা যাব এটাই বা কেমন কথা!

আবার এই যে ট্রাম্প সাহেবরা, বুশ সাহেবরা এতকাল ধরে অস্ত্র বানালেন, এত যুদ্ধ করলেন; অথচ এসব বিষয়ে তাদের হুঁশ হল না কেন? তারা মেডিকেল রিসার্চে কত টাকা খরচ করলেন আর অস্ত্র বা বোমা আবিষ্কারের পেছনেই বা কত খরচ করলেন? আমার তো মনে হয় ধনী বা উন্নত দেশগুলো একটি ফুটবল ক্লাব বা একজন ফুটবল, রাগবি খেলোয়াড় অথবা একজন রক সিঙ্গারের পেছনে যে অর্থ ব্যয় করেন, একজন মেডিকেল গবেষক বা ওষুধ আবিষ্কারকের পেছনে তার অতি ক্ষুদ্র অংশও ব্যয় করেন না। আর যদি তাই হয়, তাহলে ওইসব দেশের কর্ণধারদের জ্ঞানপাপী না অপরাধী বলব সে বিষয়টিও ভেবে পাচ্ছি না।

কারণ, তারা যুদ্ধাস্ত্র বানাতে যতটা তৎপরতা, যতটা পারদর্শিতা দেখিয়েছেন; যত অর্থ-বিত্ত ব্যয় করেছেন, মানবসমাজের স্বাস্থ্য রক্ষার্থে, মানবসমাজকে বাঁচাতে সে তুলনায় কিছুই করেননি। সারা বিশ্বের মানবসমাজকে বাঁচানোর চেয়ে মারার জন্যই তারা বেশি ব্যয়, বেশি বিনিয়োগ করেছেন! উন্নয়নশীল বিশ্বের একজন নাগরিক হিসেবে এ বিষয়ে অবশ্যই আমি তাদের কাছে কৈফিয়ত চাইব। কারণ, তারা যেসব অর্থ-বিত্ত-সম্পদ ব্যয় করেন, এক অর্থে সারা পৃথিবী তথা সারা পৃথিবীর মানুষই তার অংশীদার।

পাদটীকা : লেখাটির শেষাংশে বলতে চাই, এভাবে অসহায়ের মতো বিশ্ববাসীকে মরতে হচ্ছে কেন? অনেকে হয়তো বলবেন, ‘এটি আল্লাহর মার।’ কিন্তু সর্বশক্তিমান আল্লাহ সারা পৃথিবীর শিশু-কিশোর-যুবক-বৃদ্ধ সবাইকে এভাবে মৃত্যু দেবেন সে কথা বিশ্বাসযোগ্য নয়। কারণ, করোনা রোগে সারা বিশ্বে যারা মৃত্যুবরণ করেছেন এবং মারা যাবেন তারা সবাই পাপের খেসারত হিসেবে মারা যাচ্ছেন না।

আর বাংলাদেশের একজন নাগরিক হিসেবে বলব, এ দেশের মানুষ অত্যন্ত ধর্মপ্রাণ, খোদাভক্ত, খোদাভীরু। তাই কোনো পাপ হিসেবে আমাদের ওপর এমন গজব এসেছে, সে কথাও বিশ্বাস করব না। বরং মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে আরাধনা করব, হে আল্লাহ তুমি এ মৃত্যুভয় থেকে রক্ষা কর। এ মৃত্যু থেকে তুমি বাংলাদেশসহ সারা পৃথিবীর মানুষকে বাঁচাও; তুমি মহৎ, তোমার মহত্ত্ব প্রকাশ কর। আমাদের তুমি বাঁচাও। সবসময় এক ভিন্নধর্মী মৃত্যুচিন্তায় আচ্ছন্ন থাকায়, আকুল থাকায় মানুষ আজ নিদারুণ দুঃখ-কষ্টে আছে। আমি নিজেও তাদেরই একজন।

শিশুকালে আমাকে যেভাবে রক্ষা করেছিলে, একাত্তর সালে যেভাবে বাঁচিয়েছিলে, আজও তোমার সেই দয়া প্রদর্শন কর। একজন মানুষ হিসেবে, একজন মুসলমান হিসেবে মৃত্যুকে অবধারিত জেনেই বলছি, এভাবে করোনার ভয়ে ঘরে বন্দি হয়ে তিলে তিলে মরতে চাই না! করোনা থেকে উদ্ধার করে করোনার মৃত্যুচিন্তা থেকে আমাদের উদ্ধার কর। করোনা রোগে মৃত্যু কোনো স্বাভাবিক রোগের মতো নয়। এ রোগের মৃত্যু থেকে তুমি সবাইকে রক্ষা কর। হে মহান আল্লাহ, আমরা তোমারই করুণাপ্রার্থী।

ড. মুহাম্মদ ইসমাইল হোসেন : কবি, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট

বাংলানিউজসিএ/ঢাকা/ ১৩ জুন ২০২০/এমএম


Array