বাংলানিউজসিএ ডেস্ক :: গতকাল সারা রাত ঘুমাতে পারিনি। শুধু এপাশ-ওপাশ করেছি। ভোরে ফজরের নামাজ পড়ে যখন আবার শুয়েছি, কিছুক্ষণ পর অনুভব করি বালিশটা ভিজে যাচ্ছে…! গতকাল সন্ধ্যায় শাওয়ালের ছয়টি রোজার সর্বশেষটির ইফতার করে একটু আরাম করছিলাম বিছানায়। তন্দ্রার মতো চলে এসেছিল। এর মাঝে মোবাইল বেজে উঠতেই দ্রুত উঠে বসলাম। খুব কাছের এক ছোট ভাইয়ের ফোন।
– হ্যালো…
ওই পাশ থেকে কোনো শব্দ আসছিল না।
– হ্যালো, হ্যালো, কীরে, তুমি কথা বলছ না কেন?
আমার কানে ফুঁপানোর শব্দ আসতে থাকে।
– এ্যাই, কী হয়েছে তোমার, কথা বলো?
এবার ফুঁপানোর শব্দ কান্নার মতো শোনায়!
হায় হায়, আংকেল তো অসুস্থ ছিলেন, আমি আতঙ্কিত হয়ে উঠি খারাপ কিছু শোনার ভয়ে…
– হ্যালো? আংকেলের কোনো সমস্যা?
– এবার তীব্র কান্না শুনতে পাই।
– না ভাইয়া, আব্বার কিছু হয়নি। আমার হয়েছে। সে কান্না চেপে বলে ওঠে।
– কী হয়েছে? স্পষ্ট করে বল।
– ভাইয়া, আজকে আমাদের অফিস থেকে কিছু লোকজন ছাঁটাই করেছে। আমাকেও সেই লিস্টে রেখেছে। আমি এখন কী করব? কোথায় চাকরি পাব? বাচ্চাটা এখনো ছোট। আবার কাঁদতে শুরু করে সে।
এই অবস্থায় কী বলা উচিত আমি ভেবে পাই না। আমি অনেকটা বোবা হয়ে যাই। আমার মাঝে তীব্র ভাঙনের শব্দ পাই।
প্রায় মিনিট খানেক দুপাশ থেকে কোনো শব্দ আসে না।
নীরবতা ভাঙতে বলি, আল্লাহ ভরসা। মন শক্ত রাখো। আর আংকেলকে এই খবর দিতে যেও না।
– না ভাইয়া, বলিনি। বললে আব্বা এই শক নিতে পারবে না।
– হ্যাঁ, ঠিক কাজ করেছ।
– ভাইয়া, আমার ছেলেটা ছোট। এখন কী করব? মাথা একদম কাজ করছে না। বলে আবার ফুঁপিয়ে উঠে সে।
– ভাইরে, ভেঙে পইড় না। চাকরি একটা গেছে আরেকটা ইনশাআল্লাহ পাবে। হয়ত তাড়াতাড়ি কিংবা একটু দেরিতে।
– ভাইয়া, আমি তো কাজে ফাঁকি দিইনাই কখনো। সততার সঙ্গে কাজ করছি সবসময়।
– হ্যাঁ, সেটা আমি জানি। কিন্তু এখন তো সময়টা খারাপ।
– ভাইয়া, আমার সঙ্গে কেন? আমাকে কেন ছাঁটাই করল? আবার ফুঁপিয়ে উঠল সে।
এবার একটু শক্ত হতে হলো আমাকে।
– দেখো, প্রতিদিন দুনিয়া থেকে অযুত মানুষ ছাঁটাই হচ্ছে এখন। তোমার বয়সী বহুজন। তাই না? তুমি তো সৌভাগ্যবান যে ওই ছাঁটাইয়ের লিস্টে তোমার নাম ওঠেনি। তোমার কাছের লোকজনের নাম ওঠেনি। চাকরি ছাঁটাইয়ের লিস্টে নাম উঠেছে তাতেই ছেলের কথা চিন্তা করে যদি এভাবে ভেঙে পড় তবে ভাবতো, কাল যদি দুনিয়া থেকে ছাঁটাইয়ের লিস্টে তোমার নাম আসে তাহলে তোমার ছোট ছেলের কী হবে?
সে কী না খেয়ে থাকবে? সে কী স্কুলে যাবে না? সে কী বড় হবে না? নিশ্চয়ই হবে। কাজেই আল্লাহর ওপর ভরসা রাখো। তিনিই সবাইকে দেখে রাখেন।
আমার কথা শেষ হতেই সে অনেকটা নিজেকে সামলে বলল, ভাইয়া, দোয়া করবেন।
আজ সকালে ওকে ফোন দিই।
– হ্যালো, কী অবস্থা আংকেলের?
– ভাইয়া, আব্বা ভালো আছেন আলহামদুলিল্লাহ।
– শোনো তোমাকে একটা কথা বলতে ফোন দিয়েছি।
– ভাইয়া বলেন, খুব উৎসুক হয়ে সে বলল।
– আমি কথাটা গতকাল তোমাকে বলতে পারিনি, সেজন্য মনে শান্তি পাচ্ছিলাম না। তুমি মন শক্ত রাখো। আংকেলের যত্ন নাও। তোমরা স্ত্রী আর ছেলের দিকে খেয়াল রাখো। আর মনে রাখবে, আল্লাহ যদি আমাকে সুস্থ রাখেন, আমার সবকিছু ঠিকঠাক রাখেন এবং আমার ঘরে যদি চুলা জ্বলে, তোমার ঘরেও জ্বলবে। আমার ঘরে যদি বাজার আসে, তোমার ঘরেও বাজার যাবে। আমার ছেলে-মেয়ে দুটো যদি খেতে পায়, তোমার সন্তানও খেতে পাবে। আল্লাহই আমাদের রিজিকের মালিক। আলহামদুলিল্লাহ।
কথাগুলো বলার সময় আমার লন্ডন প্রবাসী ছোট ভাই তানজীবের চেহারা আমার চোখের সামনে ভাসছিল। আলহামদুলিল্লাহ আল্লাহর অশেষ রহমতে সে ভালো আছে, সুস্থ আছে, বৃটিশ সরকারের চাকরি করছে। আজ যদি সে ভালো না থাকত, সে যদি দেশে থাকত, সে যদি এরকম পরিস্থিতির শিকার হতো!
আমি একজন ক্ষুদ্র মানুষ হিসাবে বিজনেস মালিক, সিইও, এমডি, চেয়ারম্যানসহ সকলের নিকট বিনীত অনুরোধ করব, এই সংকট সময়ে চলুন, আমরা সবাই মিলে কষ্টগুলো ভাগ করে নিই। আমরা জানি, অনেকেরই তিন মাস ব্যবসা কার্যত বন্ধ। রেভিনিউ সিস্টেম ভেঙে পড়েছে অনেক প্রতিষ্ঠানের।
তবু বলব, একটু কষ্ট হবে, প্রয়োজনে বেতন অর্ধেক করে দিয়ে হলেও কর্মীদের পাশে থাকার চেষ্টা করি সবাই। এবং আমি বিশ্বাস করি রাত যত দীর্ঘই হোক, ইনশাআল্লাহ, আলো ফুটবে। অন্ধকার কেটে জেগে উঠবে সফেদ আকাশ।
বাংলানিউজসিএ/ঢাকা/ ১২ জুন ২০২০/এমএম





