Menu

বাংলানিউজসিএ ডেস্ক :: বিশেষজ্ঞদের মতে, করোনা মহামারী সহজে বিদায় নিচ্ছে না। তাই আগের মতো স্বাভাবিক জীবনযাপন করাও সম্ভব হবে না। তাই নিয়মকানুন মেনে অস্বাভাবিক পরিস্থিতির মধ্যেই ভিন্নতর স্বাভাবিক জীবনযাপনের প্রস্তুতি নিতে হবে সবাইকে।সরকারকে দেখাতে হবে নিরাপত্তা দেয়ার যোগ্যতা, জনগণকেও সতর্ক হতে হবে। অর্থাৎ করোনার সঙ্গে বসবাস সম্ভব করতে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শে সরকারকেই প্রধান দায়িত্ব পালন করতে হবে। অন্যান্য দেশেও করোনা মোকাবেলার ক্ষেত্রে সরকারি চেষ্টার শেষ নেই। কারণ, করোনাভাইরাস শুধু জীবনের জন্য বিপদ নয়, সমগ্র বিশ্বের অর্থনীতির জন্যও ভীষণ সংকট সৃষ্টি করে চলেছে।

ঘাতক করোনাভাইরাস মোকাবেলায় নেতৃত্বদানে সরকারের প্রস্তুতির অভাব এবং অসংগঠিত অবস্থা এখন স্পষ্ট। মৃত্যু ও সংক্রমণের হার বেড়েই চলেছে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের সংগঠিত করা, তাদের কথা শোনা এবং মহামারী মোকাবেলায় একটা যৌথ কার্যক্ষম প্ল্যান তৈরি করার পুনঃপুনঃ দাবি জানিয়েও আমরা কোনো অগ্রগতি দেখছি না।চারপাশে শুভবুদ্ধিসম্পন্ন লোকের অভাব থাকায় সরকারের পক্ষে সঠিক দিকনির্দেশনা পাওয়া অসম্ভব হয়েছে। সত্যিকার জনপ্রতিনিধিত্বের অভাবে জনস্বার্থবিরোধী হওয়াটাই যেন সরকারের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। করোনাভাইরাস মোকাবেলায় এখন সেই নির্মম সত্যই প্রমাণিত হচ্ছে।

অন্যান্য দেশের দৃষ্টান্ত দেখেও ক্ষমতাসীনরা বুঝতে চাইছেন না, সপ্তাহে অন্তত একবার বিনামূল্যে খাদ্যসামগ্রী বিতরণ করাকে রাষ্ট্রের দায়িত্ব হিসেবে দেখতে হবে। ছেলেমেয়ে নিয়ে যাতে সবাই বেঁচে থাকতে পারে তার ব্যবস্থা করা সরকারের শাসনতান্ত্রিক দায়িত্ব (জরমযঃ ঃড় ষরভব)।হতাশার বিষয় হল, এ ধরনের চিন্তাভাবনা সরকারের নেই। মাঝে মাঝে মহলবিশেষের মধ্যে ত্রাণ বিতরণের কথা পত্রপত্রিকায় ছাপা হচ্ছে। নগদ টাকা বিতরণে সততা রক্ষা করা যায় না বললেই চলে। যারা বর্তমান সরকারের আমলে শত শত কোটি টাকা কামিয়েছে, তাদের বললেও তো তারা সাপ্তাহিক খাদ্য প্যাকেজের ব্যবস্থা করতে পারে।

হাসপাতালগুলোর অবস্থা এতই করুণ, করোনা রোগীদের অনেকে হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা না পেয়ে পালিয়ে যাওয়াই শ্রেয় মনে করেছে। অন্যদিকে বেকার ও দরিদ্রদের সুরক্ষাদানের কোনো নিয়মিত ব্যবস্থা গ্রহণের তাগিদও দেখা যাচ্ছে না।পোশাকশিল্প ও অন্যান্য সেক্টরের চাকরি হারানো ক্ষুধার্ত শ্রমিকরা তাদের বেতনের দাবিতে রাজধানীর রাস্তায় রাস্তায় দিনের পর দিন বিক্ষোভ করে চলছে। তাদের জীবনধারণের সহায়তাদানের কোনো প্ল্যান নেই সরকারের। এসব ভাগ্যাহত মানুষের আর্থিক সাহায্যদান কর্মসূচির বিতরণ প্রক্রিয়াকে দুর্নীতি ও অব্যবস্থার হাত থেকে মুক্ত রাখাও সম্ভব হচ্ছে না।

এ প্রসঙ্গে করোনার কারণে সৃষ্ট আর্থিক সংকটের মধ্যে থাকা অভাবী মানুষের বেঁচে থাকার নিশ্চয়তাদানে অন্যান্য দেশের সরকার কতটা উদ্বেগ নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে, সেটা আমরা একটু দেখে নিতে পারি। এখানে ইকোনমিস্ট পত্রিকার একটি নিবন্ধ থেকে অংশবিশেষ উদ্ধৃত করলে বিষয়টি সবার কাছে পরিষ্কার হয়ে যাবে।নিবন্ধটিতে বলা হয়েছে, ‘মহামারীকালে দরিদ্রদের জন্য যতটা উদারভাবে নিরাপত্তাবেষ্টনী গড়ে তোলা হয়েছে তেমনটি এর আগে কখনও করা হয়নি। ব্রিটেনের গৃহবন্দি সাড়ে সাত মিলিয়ন শ্রমিকের বেতনের সিংহভাগ পরিশোধ করেছে সরকার।

ফ্রান্সের দিকে তাকালেও দেখা যাচ্ছে দেশটি অধিকাংশ প্রাইভেট সেক্টরের শ্রমিকদের আয়-রোজগার বৃদ্ধির জন্য কাজের সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছে। আমেরিকায় সপ্তাহে মাথাপিছু ৬০০ ডলার করে বেকারদের ভাতা দেয়া হচ্ছে, যা আগের বেতনের প্রায় তিনগুণ বেশি। মার্চ থেকে ৩৪ মিলিয়ন অথবা তার কাছাকাছি লোকের এ ধরনের সাহায্যের দাবি পূরণ করা হয়েছে। জার্মানি ও জাপানও গৃহবন্দি ও প্রায় গৃহবন্দিদের জন্য ভর্তুকির পরিমাণ বাড়িয়ে দিয়েছে।’বিদ্যমান অবস্থায় আমরা তাই আবারও স্বাস্থ্যব্যবস্থার সংগঠনে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের অগ্রণী ভূমিকা পালনে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছি। কিন্তু তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া আমরা দেখছি না।

আমরা আবারও বলছি, আমলাতান্ত্রিক রাজনীতির সময় এটা নয়। স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে সুচিকিৎসার জন্য প্রস্তুত করতে সময়ক্ষেপণের কোনো সুযোগ থাকারও প্রশ্ন ওঠে না। এ ব্যাপারে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের সাহসী ভূমিকার বিকল্প নেই।চিকিৎসা বিশেষজ্ঞদের সক্রিয় ভূমিকা ছাড়া মহামারী প্রতিরোধের ক্ষেত্রে কোনো ধরনের বিজয় অর্জিত হতে পারে না। অন্যান্য দেশে করণীয় নির্ধারণে সরকারিভাবেই তাদের সম্পৃক্ত করা হয়েছে। আমাদের দেশে মনে হচ্ছে সরকার আমলাতান্ত্রিক বুদ্ধির শিকার হয়ে পথ হারিয়ে ফেলেছে।

আমাদের জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে সরকার পরিচালিত করোনা পরীক্ষা কেন্দ্রগুলোয় এসে দীর্ঘ লাইন দিয়ে দাঁড়াচ্ছে। কিন্তু সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার ব্যাপারে কোনো সতর্কতা পালন করা হচ্ছে না।আমরা সবাই দায়িত্ববোধ হারিয়ে না ফেললে এতটুকু তো বোঝা উচিত, এভাবে ভিড় করে করোনা পরীক্ষা করতে গিয়ে প্রকারান্তরে করোনা বিস্তারেই সাহায্য করা হচ্ছে। আর দোষ দেয়া হচ্ছে জনগণের সচেতনতাবোধের অভাবকে। অথচ সামাজিক দূরত্ব পালন ব্যবস্থার নিশ্চয়তা দরকার।

অন্যান্য দেশের অনুকরণে আমাদের সরকারও আবার দোকানপাট, শিল্পকারখানা সীমিত আকারে খুলে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু নিরাপত্তার জন্য ঘোষিত নীতিমালা পালন করা হচ্ছে কী হচ্ছে না, তা তদারকি করার গুরুত্ব অনুধাবন করার বালাই নেই। এটা তো দায়িত্বহীনতার চরম দৃষ্টান্ত। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নীতিমালা অনুসরণ নিশ্চিত না করে দোকানপাট বা মিল-কারখানা চালু করার অর্থ তো আহম্মকের মতো করোনার বিস্তার ঘটানো।

আসলে মহামারী সহজে যাচ্ছে না। তাই মহামারীর মধ্যেই আমাদের সতর্কভাবে নতুন জীবন ব্যবস্থায় অভ্যস্ত হতে হবে। অর্থনীতি চালু করার ব্যাপারে আমাদের অনেক বেশি সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। বিভিন্ন কর্মস্থলে নিজেকে এবং অন্যদের রক্ষার জন্য সতর্ক থাকার নিয়মনীতি মেনে চলার সুযোগ-সুবিধাও থাকতে হবে। দূর থেকে নির্দেশ দিলেই যদি সে নির্দেশ পালিত হতো, তাহলে এত বিশাল সরকারের প্রয়োজন থাকে না।

স্বাস্থ্য কর্মকর্তা কিংবা অন্যদের কোথাও দায়িত্ব পালন করতে তেমন দেখা যাচ্ছে না। সরকারি কর্মকর্তারা লকডাউন তাদের নিজেদের নিরাপত্তার অবলম্বন হিসেবে দেখছেন বলে মনে হয়। সরকারের পক্ষে পুলিশই সব কাজ করে দেবে- এমনটি ভাবাই সরকারের স্বভাব হয়ে দাঁড়িয়েছে। এজন্য মোবাইল কোর্টকেও ব্যস্ত হতে দেখা যাচ্ছে। মনে হচ্ছে সব ব্যাপারেই আমরা অনভিজ্ঞ।

অপরাপর দেশে সরকারপ্রধানরা উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে নিয়ে বলতে গেলে প্রায় প্রতিদিনই প্রকাশ্য সংবাদ সম্মেলন করছেন। জনগণকে ২৪ ঘণ্টার অগ্রগতি সম্পর্কে অবহিত রাখার জন্য। তারা সাংবাদিকদের প্রশ্ন নিতে দ্বিধা করেন না। আর আমাদের সরকারি কর্মকর্তারা নিষ্ক্রিয় থাকতে আর জবাবদিহি এড়াতে দৃষ্টির অন্তরালে থাকতেই পছন্দ করছেন।সবাই দেখতে পাচ্ছেন, অন্যান্য দেশের সরকার কতটা উৎকণ্ঠা নিয়ে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে সব ধরনের চিকিৎসার সুযোগ-সুবিধা দিতে আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে। যাতে স্বাস্থ্যব্যবস্থা জনগণের আস্থা অর্জন করতে পারে।

জনগণের জীবন রক্ষায় স্বাস্থ্যকর্মীদের ঝুঁকি গ্রহণ করতে দেখে জনগণও প্রকাশ্যে ও অকুণ্ঠচিত্তে তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছে। অর্থাৎ সবার অংশগ্রহণের মাধ্যমে জাতির সংকট জাতীয়ভাবেই মোকাবেলা করে যাচ্ছে। আমরা এখনও রাজনৈতিক অনৈক্য ভুলতে পারছি না। আমাদের জাতীয় রাজনীতির বিচ্ছিন্নতা সামাজিক পর্যায়ে বিস্তার লাভ করেছে। রাজনৈতিক সহিংসতার শিকার রাজনীতিকদের আত্মীয়স্বজন, এমনকি তাদের বন্ধুবান্ধবদের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়েছে।

চিকিৎসা ক্ষেত্রে অব্যবস্থাপনা ও অপ্রস্তুতির কারণে আমরা ইতোমধ্যে কয়েকজন ডাক্তার, নার্স, পুলিশ ও সেনা অফিসারকে হারিয়েছি। জনগণের প্রতি দায়িত্ব পালনকালে আমরা তাদের আত্মরক্ষার জন্য অপরিহার্য সাজসরঞ্জাম জোগান দিতে পারিনি। অথচ জরুরি ভিত্তিতে তাদের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ৩-৪ মাস সময় লাগার কথা নয়। মুখে যাই বলা হোক না কেন, অবস্থা খুবই শোচনীয়।

জাতি হিসেবে আমাদের বিবেকবোধ যে এখনও মরে যায়নি, জনগণের প্রতি দায়িত্ব পালনে আমরাও যে পূর্ণ মাত্রায় সচেতন, তার দৃষ্টান্ত পালনে আমাদের অবশ্যই দায়িত্বশীল হতে হবে। সরকারের বাইরে আমাদের দ্বারা কতটুকুইবা করা সম্ভব। এক্ষেত্রে সরকারের সহযোগিতা পেতেই হবে। সেই সচেতনতাবোধই সবার মধ্যে দেখতে চাই। বিশেষ করে মহামারী প্রতিরোধ করতে যারা প্রথম সারিতে আছেন। দেখবেন জনসমর্থন কীভাবে আপনাদের পক্ষে আসছে।আমরা শুরু থেকেই মারণ-ভাইরাস করোনা প্রতিরোধে যেসব বিশেষজ্ঞ অপরিহার্য তাদের বলিষ্ঠ ভূমিকার ওপর গুরুত্ব দিয়ে এসেছি। সঠিক দায়িত্ব পালনে অর্থবহ সহযোগিতার দাবি তোলা তাদের পক্ষেই সম্ভব।

জাতি আজ সম্পূর্ণ অসহায়। স্বল্প সময়ের মধ্যে হাসপাতালগুলোয় চিকিৎসার সুব্যবস্থা করতে সরকারকে বাধ্য করতে হবে। লকডাউনের অর্থ সমগ্র জাতিকে ঘরে বন্দি করে রাখা নয়। যারা সুস্থ তাদের জাতীয় কর্মকাণ্ডে যোগ দেয়ার সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। যারা রোগে আক্রান্ত তাদের সুচিকিৎসার জন্য আলাদাভাবে রাখতে হবে, তা না হলে করোনা পরীক্ষা কোনো কাজে আসবে না। মৃত্যুর আগেই ধরে নেয়া যাবে না যে তার মৃত্যু হয়েছে। তাদের কোয়ারেন্টিনে রাখার সুব্যবস্থা করতে হবে।

আমাদের সুস্পষ্ট অভিমত হচ্ছে- সরকার, সরকারি কর্মকর্তা ও জনগণের করণীয়-বর্জনীয় সম্পর্কে এমন একটা প্যাকেজ প্রয়োজন, যা সবার জন্য অবশ্যই অনুসরণীয় এবং সেই প্যাকেজ তৈরি করবেন বিশেষজ্ঞ ডাক্তাররা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা তো গাইডলাইন দিয়েই যাচ্ছে। সরকারের সবাই নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে বেতন-ভাতা ভোগ করবেন- এতটা বিবেকহীন হলে চলবে না। সতর্কতা অবলম্বন করে দায়িত্ব পালনের দৃষ্টান্ত তাদেরও রাখতে হবে।

সরকার বলতে শুধু কয়েকজন মন্ত্রীকে বোঝায় না। প্রত্যেক সরকারি কর্মচারীই সরকার। সাধারণ লোক মারা যাবে আর সরকারি লোকেরা নিরাপদে থাকবেন, এ আশা করা বোকামি। করোনা মহামারী চলবে। নতুন জীবনব্যবস্থাকে স্বাভাবিক ব্যবস্থা হিসেবে মানিয়ে নিয়ে সরকারকে কর্মতৎপর হতে হবে। অর্থাৎ ঝুঁকিও নিতে হবে, সাবধানেও থাকতে হবে। তবে ঝুঁকি কতটা কমানো যায়, সেটাই হবে যে কোনো সরকারের প্রধান দায়িত্ব।

সবাই মিলে বেঁচে থাকার চিন্তা করাই নিরাপদ।

বাংলানিউজসিএ/ঢাকা/ ২১ মে ২০২০/এমএম


Array