Menu

ইঞ্জিনিয়ার আব্দুল্লা রফিক, ক্যালগেরি, কানাডা :: পৃথিবী সৃষ্টির আদিকাল থেকেই দুর্বলের উপর সবলের অধিকার প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চলমান হাজার হাজার বছর ধরেই চলে আসছে। অতীত ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়-ভালো এবং মন্দ দু ধরণের শাসক গোষ্ঠীই দৃশ্যমান ছিলো, মালিক শ্রমিক সম্পর্ক একসময় প্রভু ভৃত্যের সম্পর্ক বলেই পরিগণিত হতো, কখনও কখনও এই অধিকার দুর্বলের উপর অত্যাচারে রূপ নিয়েছে। আর তখনই ধীরে ধীরে আন্দোলনের সূত্রপাত হয়েছে এবং এভাবেই দুর্বলের ভিতর, শ্রমিকদের ভিতর থেকে নেতৃত্বের জন্ম নিয়েছে। ইতিহাসের পাতায় তাদের অনেক সফলতা -ব্যর্থতার কাহিনী লিখিত হয়েছে।

এক সময় সামন্তবাদ বা ফিউডাল ইকোনোমির প্রচলন ছিল পুরো মধ্যেযুগ জুড়ে ইউরোপ এর দেশে দেশে। কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি তখন ছিল চালিকা শক্তি। সামন্ত সমাজ ব্যবস্থায় বিভিন্ন ধরণের শ্রেণী গোড়া পত্তন হয় -কৃষক শ্রেণীর ভিতরে আবার মুক্ত (fee -যারা জমির পূর্ণ সৎব্যাবহার করতে পারতো নিজেদের মতো করে) অর্ধ মুক্ত ( semi free-কৃষিকদের কিছুটা স্বাধীনতা ছিল) এবং বদ্ধ (unfree-এখানে কৃষকদের কোনো স্বাধীনতা ছিল না, পুরোপুরি লর্ড বা প্রভুর অধীনস্ত থেকে কাজ করতে হতো) শ্রেণী বিন্যাস দেখা যায়। এ ছাড়া যোদ্ধাদের একটি শ্রেণী যারা সামরিক বাহিনীতে যোগদানের বিনিময়ে জমির মালিক হতো। তখন থেকেই শ্রমিক মালিক সম্পর্কের ভিন্নতা দেখা যেত। রাষ্ট্রে ব্যবস্থা পরিচালনায় রাজতন্ত্রের ব্যপকতা চোখে পরে! ধারণা এমন ছিল যে রাজারা কখনো ভুল করতে পারে না। আর এর ফলেই কতৃত্ববাদের সৃষ্টি হয়, মালিক শ্রমিক সম্পর্কে শোষণ একটি ভালো হাতিয়ার হিসাবে ব্যাবরিত হতে থাকে। জাপানেও এর ফিউডাল বা সামন্ত অর্থনীতির চলন দেখা গেছে।

ইউরোপ থেকে গ্রেট ব্রিটেন, ফ্রান্স, স্পেনিশ, পর্তুগিজ রা উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকায় এসে বসতি গড়ে কলোনী প্রথার উৎপত্তি ঘটায়। আমেরিকাতে ফিউডাল বা সামন্ত অর্থনীতি সফলতা লাভ করেনি-এখানকার বৈরী আবহাওয়া একটা কারণ হতে পারে আবার এখানকার আদিবাসীদের স্বতন্ত্র জীবনবাবস্থার প্রভাব থাকতে পারে। বাণিজ্যের সম্প্রসারণ ঘটে পুঁজিবাদের বিকাশ ঘটতে দেখা যায়। মালিকরা তাদের লাভের পরিমান বাড়ানোর জন্য শ্রমিকদের ন্যায্য ভাতা নিয়ে অতটা চিন্তাশীল ছিল না।

শ্রমিকদের মধ্যে অসন্তোষ দানা বাঁধতে থাকে। ১৭৭৬ সালে আমেরিকা স্বাধীন হলেও পরের অনেক বছর গৃহযুদ্ধ দ্বারা ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে যদিও অনেক আইন হয়েছে শ্রমিকদের অধিকার রক্ষার্থে। কিন্তু আইন প্রণেতারা মালিক পক্ষের দ্বারা প্রভাবিত হতে থাকে, মালিকদের স্বার্থ বেশি সংরক্ষতিতো হতে থাকে যার ফলে আইন মালিকদের মুনাফার লোভ দমন করতে ব্যর্থ হয় বিনিময়ে শ্রমিকদের উপর শোষণ/নিপীড়ন/নির্যাতন এর মাত্রা বর্ধিত আকারে চলতে থাকে।

ধীরে ধীরে শ্রমিক আন্দোলন দানা বাঁধতে থাকে। ১৮৮৬ সালের এপ্রিল ২৫ থেকে মে ৪ তারিখের মধ্যে আমেরিকার শিকাগো শহরে শ্রমিক আন্দোলন তুঙ্গে উঠে। এই সময়ের মধ্যে শিকাগো ইউনিয়ন ভুক্ত শ্রমিক, সমাজবাদীরা, সংস্কারবাদীরা, এবং সাধারণ শ্রমিকরা একত্রিত হয়ে মিছিল মিটিং করতে থাকে, তাদের মুখ্য দাবী ছিল “প্রতিদিন আট ঘন্টা“ কাজ করা। পহেলা মে, (May 1, 1886) শনিবার শিকাগোর ডাউন টাউন এ প্রায় ৩৫০০০ শ্রমিক তাদের কর্মস্থল থেকে বেরিয়ে আসে এবং তাদের দাবিতে অবস্থান ধর্মঘট শুরু করে। মে মাসের ৩ ও ৪ তারিখে আরো হাজার হাজার দক্ষ অদক্ষ শ্রমিক যোগ দেয়। শ্রমিকরা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সামনে সামনে যেয়ে শ্রমিকদের বের করে এনে সমাবেশে যোগ দেওয়াতে থাকে। মে মাসের ৩ তারিখে এক ফ্যাক্টরিতে এই শ্রমিক ধর্মঘট ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করে পুলিশের গুলিতে দুই শ্রমিক মারা যায়।

শ্রমিক জনতার মে ৪ তারিখের দেস প্লেইন স্ট্রিট এর সমাবেশে শিকাগো সিটির মেয়র কার্টার হ্যারিসন যোগ দেয় l যদিও পুলিশ কে এই সমাবেশে হস্তক্ষেপ করতে নিষেধ করা ছিল কিন্তূ কোনো এক বক্তার বক্তব্যে সব ভণ্ডুল হয়ে যায় পুলিশ সমাবেশ ভঙ্গ করতে যায় তখন সমাবেশ থেকে কেউ একজন বোমা বিস্ফোরণ ঘটায় ! পুলিশ ও নির্বিচারে গুলি চালাতে থাকে আর এতে ৮ জন পুলিশ অফিসার মারা যায় l অনেক শ্রমিক নিহত হয় ! মেয়র মিটিং মিছিল নিষিদ্ধ করে, গণমাধম শ্রমিকদের বিপক্ষে চলে যায় l আর পুলিশ পিকেটারদের জীবন দুর্বিসহ করে তোলে এক সময় আন্দোলন স্তিমিত হয়ে যায় l

এই ঘটনায় পুলিশ শত শত শ্রমিক জনতাকে এরেস্ট করে, বোম্ব কে ছুড়েছে তা বের করার চেষ্টা করে কিন্তূ ব্যর্থ হয় l পুলিশ মূলতঃ পুলিশ অফিসার হত্যাকাণ্ডের তদন্ত করতে থাকে l আন্দোলনে নেতৃত্ব দানকারি আট জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেয় l বিচারে জুরিরা একমত হয়ে আট জনকেই দোষী সাব্যস্ত করে সাত জনকে মৃত্যুদন্ড দেয় l অনেক আমেরিকান এতে ক্ষুব্ধ হয় কিন্তূ আপিল কোর্টেও মৃত্যুদন্ড বহাল থাকে এবং পরবর্তীতে এই দন্ড কার্যকর করা হয় l আমেরিকার ইতিহাসে এই বিচারের রায়কে সবচেয়ে অনৈতিক বিচারকার্য বলে গণ্য করা হয় l

প্রতিদিন আট ঘন্টা কাজের দাবিতে শিকাগো শহরের মুভমেন্ট দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে সমাজ সংস্কারক, ইউনিয়নিস্ট রা পহেলা মে (May 1 )কে মে দিবস হিসাবে পালন করতে থাকে l বিংশ শতাব্দীতে সোভিয়েত ইউনিয়ন সহ অন্যান্য কমুনিস্ট দেশ গুলো মে মাসের এক তারিখকে “মে দিবস” হিসাবে ঘোষণা দেয় যা এখন উত্তর আমেরিকা ছাড়া সারা পৃথিবীতেই পালিত হয় l

আমেরিকান প্রশাসন কখনোই এটাকে “মে দিবস” হিসাবে পালন করে নি, এটাকে “কমিউনিস্ট হলিডে” বলে থাকে l ১৯৫৫ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট আইসেন হাওয়ার এই দিনটিকে “লয়ালটি” দিবস হিসাবে উল্লেখ করে l আমেরিকা, কানাডা প্রতি বছর সেপ্টেম্বর এর প্রথম সোমবারকে লেবার ডে হিসাবে পালন করে l সারা পৃথিবীর (উত্তর আমেরিকা ছাড়া) মানুষ এখন গণমানুষের অধিকার আদায়ের দিন বলেই মে দিবসকে গণ্য করে

জয় হোক মুক্তিকামী মানুষের , জয় হোক শ্রমিক অধিকারের …..!!!

 

বাংলানিউজসিএ/ঢাকা/ ০২ মে ২০২০/এমএম


Array