Menu

বাংলানিউজসিএ ডেস্ক :: গত ১৩ এপ্রিল পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, নভেল করোনাভাইরাসের ক্ষয়ক্ষতি কাটাতে গ্রামের ক্ষুদ্র ও মাঝারি কৃষকদের জন্য ৫ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

১২ এপ্রিল সকালে গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে বরিশাল ও খুলনা বিভাগের ১৬টি জেলার স্থানীয় প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি, সশস্ত্র বাহিনী ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য, সিভিন সার্জন এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের সঙ্গে করোনাভাইরাস পরিস্থিতি নিয়ে মতবিনিময়কালে এ ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী।

প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার পরদিন অর্থাৎ ১৩ এপ্রিল বাংলাদেশ ব্যাংক করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে ৫ হাজার কোটি টাকার পুনঃঅর্থায়ন স্কিম গঠন ও পরিচালনা নীতিমালা জারি করে।

এ নীতিমালার প্রধান বৈশিষ্ট্যাবলি হল- ক. স্কিমের নাম হবে কৃষি খাতে বিশেষ প্রণোদনামূলক পুনঃঅর্থায়ন স্কিম। খ. তহবিলের পরিমাণ হবে ৫ হাজার কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের নিজস্ব উৎস থেকে এ অর্থায়ন করা হবে। গ. এ স্কিমের আওতায় পুনঃঅর্থায়ন গ্রহণে ইচ্ছুক ব্যাংকগুলোকে বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে একটি অংশগ্রহণমূলক চুক্তি স্বাক্ষর করতে হবে।

অংশগ্রহণকারী ব্যাংকগুলো আগামী ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে গ্রাহকের অনুকূলে ঋণ বিতরণপূর্বক মাসিক ভিত্তিতে পুনঃঅর্থায়নের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে আবেদন করবে। ঘ. অংশগ্রহণকারী ব্যাংকগুলো বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে পুনঃঅর্থায়ন গ্রহণের তারিখ থেকে অনধিক ১২ মাসের মধ্যে আসল ও সুদ (১ শতাংশ) পরিশোধ করবে।

ঙ. গ্রাহকরা ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণের তারিখ থেকে ১২ মাসের মধ্যে ৪ শতাংশ সুদসহ আসল পরিশোধ করবেন। এই সুদের হার চলমান গ্রাহক ও নতুন গ্রাহক উভয়ের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হবে।

চ. শস্য ও ফসল ছাড়া কৃষির অন্যান্য চলতি মূলধন নির্ভরশীল খাতগুলো যথা- হর্টিকালচার অর্থাৎ মৌসুমভিত্তিক ফুল ও ফল চাষ, মৎস্য চাষ, পোলট্রি, ডেইরি ও প্রাণিসম্পদ এই প্রণোদনা প্যাকেজের আওতাভুক্ত হবে।

কৃষি খাতে বিশেষ প্রণোদনামূলক পাঁচ হাজার কোটি টাকার প্যাকেজটির ঋণ প্রাপ্যতার খাতসহ আরও কিছু বিষয় নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে- এক. দেশে সার্বিক কৃষি খাতের শস্য উপখাতকে প্রণোদনা প্যাকেজের বাইরে রাখা হয়েছে।

অর্থাৎ শস্য উপখাত এ প্রণোদনা প্যাকেজ থেকে ঋণ পাবে না। অথচ দেশে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে মূল ভূমিকা পালন করে আসছে শস্য উপখাত। এ উপখাতে উৎপাদিত কৃষি পণ্যগুলোর মধ্যে রয়েছে চাল, গম, ভুট্টা ও শাকসবজি। চাল আমাদের প্রধান খাদ্য।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সূত্রের বরাত দিয়ে ১৬ এপ্রিলের দ্য ডেইলি স্টারের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মানুষের খাদ্য হিসেবে গত অর্থবছরে আমাদের প্রয়োজন হয় ২ কোটি ৫০ লাখ টন চাল।

অন্যান্য প্রয়োজনে যথা- বীজ, গবাদিপশুর খাদ্য, শিল্প-কারখানায় উৎপাদন ইত্যাদিতে লাগে প্রায় ৯৫ লাখ টন। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে দেশে চালের মোট উৎপাদন দাঁড়ায় ৩ কোটি ৬২ লাখ ৭৯ হাজার টনে (বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০১৯)। গত অর্থবছরে (২০১৮-১৯) সরকার ৩ কোটি ৬৪ লাখ ৫৯ হাজার টন চাল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে।

গত অর্থবছরে উৎপাদিত মোট চালের পরিমাণ ছিল ৩ কোটি ৬৪ লাখ টন। গত দুই অর্থবছরে কৃষকের গভীর আগ্রহ ও অক্লান্ত পরিশ্রম, সরকারের সহায়তামূলক পদক্ষেপ এবং অনুকূল আবহাওয়ার কারণে দেশ আজ বহু বছর পর চাল আমদানিনির্ভরতার ধারা থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছে।

চলতি অর্থবছরে আমনের উৎপাদন সন্তোষজনক। কৃষিমন্ত্রীর মতে, চলতি অর্থবছরে আমনের উৎপাদন গত বছরের উৎপাদনকে (১ কোটি ৫৩ লাখ টন) ছাড়িয়ে গেছে। তবে চলতি অর্থবছরে দেশে চাল উৎপাদনে শীর্ষে থাকা বোরোর উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে।

আবাদি জমির পরিমাণ লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় কিছুটা কমে গেলেও লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে মূল বাধা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে নভেল করোনা মহামারী। মিডিয়ার খবর ছাড়াও ব্যক্তিগত যোগাযোগের মাধ্যমে জানা গেছে, দেশে বোরো উৎপাদনের প্রাণকেন্দ্র উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোয় বোরোর আবাদ বর্তমানে অনেকটা মাঝপথে রয়েছে।

রংপুর জেলার একাধিক কৃষকের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তারা জানান, এখন বোরো ধানের থোড় থেকে ফুল বের হচ্ছে। অর্থাৎ কমবেশি এক মাস পর ধান কাটা হবে। এদিকে চলমান করোনা মহামারীর কারণে বেশির ভাগ বাজার বন্ধ থাকায় কৃষক ধান চাষের জন্য ইউরিয়া সার, কীটনাশকসহ প্রয়োজনীয় উপকরণ সংগ্রহ করতে পারছেন না।

এতে ধানের ফলন কমে যাবে। দ্বিতীয় সমস্যাটি হল কৃষি শ্রমিকের অভাব। সরকারি তথ্য মোতাবেক, চলতি বোরো মৌসুমে ২ কোটি ৪ লাখ ৩০ হাজার টন চাল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। আবাদি জমির লক্ষ্যমাত্রা ৪৭ লাখ ৫৪ হাজার হেক্টর, যার প্রায় ২৩ শতাংশ হাওরাঞ্চলের ৭টি জেলায় (সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, হবিগঞ্জ, সিলেট ও মৌলভীবাজার) অবস্থিত।

করোনা মহামারীর কারণে সারা দেশে গণপরিবহন বন্ধ থাকায় বাইরের জেলাগুলো থেকে ধানকাটা শ্রমিক আসতে না পারায় শ্রমিক সংকটের কারণে যে কোনো মুহূর্তে বন্যায় পাকা ধান তলিয়ে যেতে পারে। তাছাড়া এবার হাওরাঞ্চলে বোরো ফসল কাটায় শ্রমিকের মজুরি অন্যান্য বছরের তুলনায় অনেকটা বেড়ে যাবে।

শুধু হাওরাঞ্চলে নয়, করোনার কারণে দেশের অন্যান্য অঞ্চলে, বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলে দেখা দিয়েছে কৃষি শ্রমিক সংকট। এতে বোরো আবাদে পরিচর্যার অভাব দেখা দিয়েছে, যা ধানের ফলনের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলবে।

তাছাড়া বেড়েছে শ্রমিকের মজুরি। ধান কাটার সময় শ্রমিকের মজুরি আরও বেড়ে যাবে। এসব কারণে বোরো চাষীদের প্রণোদনা প্যাকেজের আওতাভুক্ত করতে হবে। এখানে যে কথাটি স্মরণে রাখা দরকার তা হল, গত দশ বছরে দেশে চাল উৎপাদনের তথ্য পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, উৎপাদিত চালের ৫৪ থেকে ৬০ শতাংশ এসেছে বোরো থেকে।

দেশে চাল উৎপাদনে তৃতীয় অবস্থানে থাকা আউশ আবাদের প্রস্তুতি শুরুর পথে। ২০১৩-১৪ থেকে ২০১৭-১৮ অর্থবছরগুলোতে আউশের বার্ষিক উৎপাদন ২১ লাখ টন থেকে ২৭ লাখ টনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও গত অর্থবছরে (২০১৮-১৯) তা বেড়ে ৩১ লাখ টনে দাঁড়িয়েছে।

এদিকে উপরে উল্লিখিত কারণে চলতি মৌসুমে বোরোর উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় কিছুটা কমে যেতে পারে। দেশের চালকল মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ অটো, হাসকিং, মেজর ও মিল মালিক সমিতির হিসাবের বরাত দিয়ে ১১ এপ্রিল একটি দৈনিকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এ বছর বোরোর উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১০ শতাংশ কম হবে।

তাই এ বছর আউশের উৎপাদন বৃদ্ধির ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। এদিকে দীর্ঘায়িত খরার কারণে আউশের বীজতলা তৈরিতে দেরি হতে পারে, যা মৌসুমের রোপণ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। তাছাড়া করোনার কারণে বেশির ভাগ বাজার বন্ধ থাকায় কৃষক বোরো ধান চাষের জন্য ইউরিয়া সার, কীটনাশকসহ প্রয়োজনীয় উপকরণ সংগ্রহে যে সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন, আউশের ক্ষেত্রেও একই সমস্যা সৃষ্টির আশঙ্কা উড়িয়ে দেয়া যায় না।

এদিকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরের তুলনায় চলতি অর্থবছরে আউশের উৎপাদন বৃদ্ধির প্রক্ষেপণ রয়েছে ৭ দশমিক ৪৬ শতাংশ। তাই আউশের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে আউশ ধান চাষীদের প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় আনতে হবে, যাতে তারা সার, কীটনাশকসহ প্রয়োজনীয় কৃষি উপকরণ সংগ্রহে ব্যয় নির্বাহে অসুবিধার সম্মুখীন না হন।

চাল উৎপাদনে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে আমন। গত অর্থবছরে দেশে উৎপাদিত মোট চালের ৩৮ শতাংশ এসেছে আমন থেকে। তবে এ ফসলটির উৎপাদন অনেকটা প্রকৃতিনির্ভর। প্রলয়ংকরী বন্যা, সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস, ঘূর্ণিঝড়, খরা ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগে এ ফসলটি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার নজিরের অভাব নেই।

১৯৮৮, ১৯৯৮ সালের প্রলয়ংকরী বন্যা, ২০০৭-২০০৮ অর্থবছরের একাধিক প্রলয়ংকরী বন্যা, ঘূর্ণিঝড় সিডর কীভাবে আমন ফসলের মারাত্মক ক্ষতি করেছিল তা আমরা ভুলিনি। তাই খাদ্যশস্য উৎপাদনের স্বার্থে আমন চাষীদের ঘোষিত ৫ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজের বাইরে রাখা সমীচীন হবে না।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালা অনুযায়ী কৃষকরা ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণের তারিখ থেকে ১২ মসের মধ্যে ৪ শতাংশ সুদসহ আসল পরিশোধ করবেন, যদিও বাংলাদেশ ব্যাংক অংশগ্রহণকারী ব্যাংকগুলোকে ঋণ প্রদান করবে ১ শতাংশ সুদের হারে।

সুতরাং গ্রাহক পর্যায়ে এই বিশেষ ঋণটির সুদের হার ২ শতাংশের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা সমীচীন হবে। তাছাড়া কৃষক পর্যায়ে ঋণ পরিশোধের সময়সীমা বাড়িয়ে দুই বছর করা হোক।

আল্লাহ না করুন, করোনা মহামারীর স্থায়িত্বকাল ৬ মাস বা তার বেশি হলে এবং দেশের শিল্প খাত, সেবা খাতসহ অন্যান্য খাত স্থবির হয়ে পড়লেও কৃষকরা করোনাভাইরাসের মধ্যেও কৃষি উৎপাদন অব্যাহত রেখে আমাদের বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করবেন। আমরা ভাত, আলুভর্তা ও সবজি খেয়েও বেঁচে থাকতে পারব।

সবশেষে বলতে চাই, ঘোষিত ৫ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজের জন্য যেসব খাতকে ঋণ পাওয়ার যোগ্য করা হয়েছে, তাদের সঙ্গে শস্য ও ফসলকে যুক্ত করতে হবে। প্রয়োজনে প্রণোদনা প্যাকেজের অর্থের পরিমাণ বাড়াতে হবে।

বাংলানিউজসিএ/ঢাকা/ ২৩ এপ্রিল ২০২০/এমএম


Array