বাংলানিউজসিএ ডেস্ক :: জ্বর দিয়ে করোনাভাইরাসের লক্ষণ শুরু হয়। এর সঙ্গে সর্দি, শুকনো কাশি, মাথাব্যথা, গলাব্যথা, শরীর ব্যথাসহ এক সপ্তাহের মধ্যে শ্বাসকষ্টও দেখা দিতে পারে।সাধারণ ফ্লু’র মতোই হাঁচি-কাশির মাধ্যমে এ ভাইরাস ছড়াতে পারে। আক্রান্ত রোগী অন্যের সঙ্গে হ্যান্ডশেক করা থেকে শুরু করে যা কিছুই ধরবেন বা স্পর্শ করবেন সেখানেই ভাইরাস থেকে যেতে পারে; যা পরে অন্যের শরীরে সংক্রমিত হতে পারে।
এ ধরনের পরিস্থিতি মোকাবেলায় স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে দেশের সব সরকারি-বেসরকারি মেডিকেল কলেজ, হাসপাতাল, বিশেষায়িত চিকিৎসা কেন্দ্র এবং জেলা-উপজেলা পর্যায়ের হাসপাতালে আইসোলেশন ইউনিট প্রস্তুত রাখার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।একইসঙ্গে এ রোগ প্রতিরোধে আইইডিসিআরের তরফ থেকে গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ দেয়া হয়েছে। যেমন- নিয়মিত সাবান, হ্যান্ড স্যানিটাইজার ও পানি দিয়ে অন্তত ২০ সেকেন্ড হাত ধোয়া।
অপরিষ্কার হাতে চোখ, নাক ও মুখ স্পর্শ না করা। হাঁচি-কাশি রয়েছে এমন ব্যক্তির সংস্পর্শ এড়িয়ে চলা। কোলাকুলি-করমর্দন না করা। হাঁচি-কাশির সময় টিস্যু পেপার-কাপড় দিয়ে নাক-মুখ ঢেকে রাখা, ব্যবহৃত টিস্যু নির্দিষ্ট স্থানে ফেলা।ব্যবহৃত কাপড় অন্তত ২০ মিনিট সাবান পানিতে ভিজিয়ে রেখে পরিষ্কার করা। ঘরের বাইরে মাস্ক ব্যবহার এবং জনসমাগম ও গণপরিবহন এড়িয়ে চলা। ডিম, মুরগি, শাক-সবজি ও তরিতরকারি ভালো করে ধুয়ে পরিপূর্ণভাবে সিদ্ধ করে নেয়া।
ঘর ও কাজের জায়গা নিয়মিত পরিষ্কার রাখা। অপ্রয়োজনে ঘরের দরজা জানালা খুলে না রাখা। প্রকৃতপক্ষে, সবাই যদি এ পরামর্শগুলো পালন করেন, তাহলে সংক্রমণের আশঙ্কা এমনিতে কমে আসবে।আধুনিক বিশ্ব ব্যবস্থা ইদানীং ব্যক্তিগত পরিষ্কার-পরিছন্নতা ও হাত ধোয়ায় গুরুত্বারোপ করেছে; কিন্তু এগুলো অনুসরণ করার জন্য ইসলামে আজ থেকে ১৪শ’ বছর আগেই তাগিদ দেয়া হয়েছে।
এ ব্যাপারে পবিত্র কোরআনে ৫নং সুরা আল মায়িদা-এর ৬নং আয়াতে মহান আল্লাহ পাক ইরশাদ করেছেন- তোমরা যখন সালাতের জন্য উঠবে, তখন তোমাদের মুখমণ্ডল এবং কনুই পর্যন্ত হস্তদ্বয় ধৌত করবে।আর তোমাদের মাথা মাসেহ করবে এবং পা গোড়ালি পর্যন্ত ধৌত করবে। তোমরা যদি অপবিত্র অবস্থায় থাক তবে বিধিমতো পবিত্রতা অর্জন করবে। ওপরের এ কাজটিই হল ওজুর জন্য অত্যাবশ্যকীয়। মাথার এক-চতুর্থাংশ মাসাহ করা, মুখমণ্ডল অর্থাৎ কপাল থেকে চিবুকের নিচ, এক কানের লতি থেকে অপর কানের লতি ও হস্তদ্বয় কনুই পর্যন্ত এবং গোড়ালি থেকে নিচের দিকে পুরো পা ধোয়া যাতে কোনো স্থান শুষ্ক না থাকে।
প্রকৃতপক্ষে শরীরের এ অংশটুকুই ধুলোবালি, ময়লা, রোগজীবাণুর সংস্পর্শে আসে। ফজর থেকে শুরু করে মোট পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের জন্য ওজু করে পবিত্র হলে, রোগ-জীবাণু আক্রমণের আশঙ্কা এমনিতেই কমে যায়।একইভাবে ব্যক্তি স্বাস্থ্য রক্ষায় সচেতনতা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে ২০০৮ সাল থেকে বিশ্বব্যাপী ‘গ্লোবাল হ্যান্ড ওয়াশিং ডে’ পালিত হয়ে আসছে। প্রতি বছর বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে বিশ্বের ২০ কোটিরও বেশি লোক গ্লোবাল হ্যান্ড ওয়াশিং ডে উদযাপন করে।
সঠিকভাবে সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার অভ্যাস করতে পারলে প্রায় ২০টি রোগের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার সম্ভাবনা আছে। সাবান দিয়ে দু’হাত ভালোভাবে কচলিয়ে ধুয়ে জীবাণুমুক্ত করতে হবে। শিশু-সন্তানদের ছোটবেলা থেকেই মলমূত্র ত্যাগের পরে, খাওয়ার আগে সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার অভ্যাস করাতে হবে। অনেক বাচ্চার অকারণে আঙুল চোষা, এমনকি স্থান, কাল ও বয়স নির্বিশেষে অনেকেরই যখন-তখন চোখ, মুখ, কান, নাকে হাত দেয়া ও ঘষা স্বভাবে পরিণত হয়েছে। হাঁচি-কাশির সময় মুখে কাপড়-রুমাল ব্যবহার তো শুধু করোনা প্রতিরোধ বা ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য রক্ষার জন্যই নয়, এটা তো শিষ্টাচারেরও লক্ষণ।
বিশিষ্টজনরা বলছেন, খাদ্যদ্রব্য ভালোভাবে সিদ্ধ করে রান্না করতে হবে। আমাদের হোটেল, রেস্তোরাঁ বিশেষত ফাস্টফুড শপে প্যাটিস, স্যান্ডউইচ, বার্গার, পিৎজা ও অন্যান্য আইটেমে ব্যবহৃত চিকেন, ফিশ ও ভেজিটেবল কি যথাযথভাবে সিদ্ধ করা হচ্ছে? ওগুলো কতটুকু নিরাপদ? এ ব্যাপারে এখনই পদক্ষেপ নেয়া দরকার।
বিয়ে বা অন্যান্য অনুষ্ঠানে অনেক কেতাদুরস্তকে হাত না ধুয়ে খাবার গ্রহণ করতে এবং মাংস-পোলাও খাওয়ার পরও টিস্যু দিয়ে হাত মুছে নিতে দেখা যায় না। ওই হাত তো শুধু করোনা ভাইরাসই নয়, সব ধরনের রোগের জীবাণু বসবাসের উর্বরক্ষেত্রে পরিণত হয়ে যায়। শ্রমিক পল্লী, বস্তিতে বসবাসকারী ও অসতর্কদের হাত ধুয়ে খাবার গ্রহণে সচেতনতার বিষয়ে ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ায় ব্যাপক প্রচারণা চালাতে হবে।
সম্প্রতি আমার এক বন্ধু করোনা মোকাবেলায় হংকংয়ের কার্যক্রম প্রসঙ্গে যা বলেছিলেন, পাঠকদের জ্ঞাতার্থে তা তুলে ধরছি। চীনের পরে প্রথম যে ক’টি দেশে কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত শনাক্ত করা গিয়েছিল তার মধ্যে একটি হচ্ছে হংকং। চীনের সঙ্গে লাগোয়া এ স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলটিতে প্রথম করোনাভাইরাস আক্রান্ত ব্যক্তি শনাক্ত হয় ২৩ জানুয়ারি, পরবর্তী সময়ে আক্রান্ত ১২২ জনের মধ্যে মৃত্যু হয়েছে ৩ জনের। স্বাভাবিক জীবনযাত্রা চলছে; কিন্তু তারা চেষ্টা করছে ভিড় সমাগম এড়িয়ে চলতে।
সাধারণ সর্দি-কাশি, জ্বর থাকলেই ঘর থেকে বের হচ্ছে না। প্রতিটি ভবনের প্রবেশপথে আগতদের তাপমাত্রা পরীক্ষা ও মাস্ক ছাড়া ভেতরে প্রবেশ করতে দেয়া হচ্ছে না। সব স্থাপনা, বাসাবাড়ি, কর্মস্থল, দোকানপাটের প্রবেশমুখে হ্যান্ড স্যানিটাইজার দিয়ে ওয়াশ নিতে হচ্ছে। সরকারি ও হোম কোয়ারেন্টাইনের ব্যবস্থা করা হয়েছে।যেসব দফতরে ই-ফাইলিংয়ের মাধ্যমে কাজ করা যায় সেসব দফতরের কর্মীকে ঘরে বসে কাজকর্ম সমাধা করতে বলা হয়েছে। জনসমাগম হয় এমন সব প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। আশার কথা, বাংলাদেশেও বহুজাতিক কোম্পানির অনেক অফিসের প্রবেশমুখে ওপরে বর্ণিত সতর্কতামূলক ব্যবস্থাগুলো গ্রহণ করা হয়েছে। সব স্থাপনা, দফতর ও বাসাবাড়িতে এ ব্যবস্থা প্রবর্তন অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে।
সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিকে আইসোলেশন ইউনিট প্রস্তুতের সরকারি নির্দেশনাটি অনেক ক্ষেত্রে শুধু সাইনবোর্ড ঝুলানোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে আছে। রোগী ব্যবস্থাপনার প্রস্তুতি জোরেশোরে নিতে হবে। প্রতিটি হাসপাতালে এসব রোগীর চিকিৎসার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক ও কর্মীদের যথোপযুক্ত পোশাক এবং অন্যান্য উপকরণের ব্যবস্থা করতে হবে। আশকোনায় আইসোলেশন কেন্দ্রটির বিছানাপত্র, যন্ত্রপাতি এবং টয়লেট-বাথরুম পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে, যেন রোগীরা স্বচ্ছন্দবোধ করতে পারে। দেশের সব জেলা-উপজেলায় এ ভাইরাস শনাক্তকরণের ব্যবস্থা করতে হবে।
সভ্যতা ও আধুনিকতার কিছু কিছু বিষয় কেন জানি মনে হয় ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা ও জনস্বাস্থ্যের সঙ্গে খাপ খায় না। তারপরও আমরা প্রগতির নামে এসবে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছি। আধুনিক হোটেল-গেস্টহাউসের টয়লেটে এখন আর পানির ব্যবস্থা থাকে না, টিস্যু পেপারই ভরসা। ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা রক্ষায় এটি কতটুকু স্বাস্থ্যসম্মত? মহিলাদের হিজাব পরা, মাথা ঢেকে রাখা, পুরুষদের টাখনুর ওপরে কাপড় পরা অনেক ক্ষেত্রে গোঁড়ামি ও পশ্চাদপদতা মনে করা হয়; কিন্তু আধুনিক বৈজ্ঞানিক গবেষণা বলছে, এ বিষয়গুলো প্রতিপালন করলে অনেক ধরনের রোগ-বালাই থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। তাই এগুলো আরও গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনার সময় এসেছে বলে মনে হচ্ছে।
করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে পৃথিবীর প্রায় সর্বত্র। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) মহাপরিচালক গত ১১ তারিখের নিয়মিত সংবাদ সম্মেলনে একে মহামারী হিসেবে ঘোষণা করেছেন। আমাদের ধারণা ছিল ঋতু পরিবর্তনে তাপমাত্রা আরও একটু বৃদ্ধি পেলে এর প্রকোপ হয়তো কমে আসবে; কিন্তু বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার জরুরি কর্মসূচির নির্বাহী পরিচালক মাইক রেয়ান এক বিবৃতিতে বলেন, ‘ফ্লু’র মতো গ্রীষ্মেই এটি বন্ধ হয়ে যাবে এমন কিছু ভাবার কারণ নেই। কাজেই আমরা কেবল তাপমাত্রার ওপর নির্ভর করে বসে থাকতে পারি না’। গবেষকরা বলছেন, এটি একটি পরিবর্তিত ভাইরাস, যা গ্রীষ্মেও মানুষকে সংক্রমিত করতে পারে।
সতর্ক হতে হবে এখনই, নতুবা মানব সভ্যতাই হয়তো মুখ থুবড়ে পড়বে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ ভাইরাসের তাণ্ডব জুন পর্যন্ত চলবে। আর কয়দিনের মধ্যে বৃষ্টি নামলে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব দেখা দেবে। তখন পরিস্থিতি আরও কঠিন হয়ে উঠতে পারে। জীবন থেমে থাকবে না। এর মধ্যেই বাঁচতে হবে, বাঁচাতে হবে। তাই ব্যক্তি, পরিবার, সমাজকে ঘিরে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও সতর্কতার বলয় তৈরি এবং আমাদের দৈনন্দিন কার্যক্রমের সূচি ও সার্বিক জীবনযাপন প্রণালী আগামী ৪-৫ মাসের জন্য এখনই পুনর্বিন্যাস করতে হবে।
বাংলানিউজসিএ/ঢাকা/ ২০ মার্চ ২০২০ /এমএম





