Menu

বাংলানিউজসিএ ডেস্ক :: দেশে রফতানি আয়ের প্রধান খাত পোশাক শিল্পের পরের স্থানটি ধরে রেখেছে প্রবাসী আয়। বেশ কিছুদিন ধরে জনশক্তি রফতানির হার ছিল নিম্নমুখী। ১৬ কোটি জনসংখ্যার বাংলাদেশে প্রতি বছরই প্রায় ২০-২২ লাখ কর্মক্ষম মানুষ শ্রম বাজারে প্রবেশ করে। এ অবস্থায় দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ না বাড়লে দেশে বেকারত্বের হারও বাড়তে থাকবে।

যেহেতু আমাদের দেশে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগে মন্দাভাব বিরাজমান, সেহেতু একমাত্র ভরসা বিপুল পরিমাণ কর্মক্ষম হাতগুলোকে দক্ষ করে তুলে বিদেশে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা। অবশ্য বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে সরকারও দক্ষ-আধাদক্ষ মানবসম্পকে বিদেশে প্রেরণের জন্য যথোপযুক্ত ব্যবস্থা নিয়েছে। কারণ গোটা পৃথিবীতে এখন অদক্ষ কর্মীর চেয়ে দক্ষ কর্মীর চাহিদা বেশি।

চাহিদা অনুযায়ী দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে না উঠলে বিদেশের মাটিতেও কাজের ক্ষেত্র কমে আসবে। যেখানে একটু ভালোভাবে রুজি রোজগার করতে মায়ার বাধন ছিন্ন করে লাখ লাখ বাংলাদেশি পাড়ি জমাচ্ছেন ভিন দেশে, সেখানে প্রশিক্ষণ নিয়ে দক্ষ করে পাড়ি জমালে যেমন উন্নত কাজের ক্ষেত্র মিলবে, তেমনি আয় রোজগারও বাড়বে।

ফলে পরিবার ও দেশ উভয় পক্ষই আর্থিকভাবে লাভবান হবে, যা নিশ্চিত করতে সরকার ইতিমধ্যেই ছয়টি ইনস্টিটিউট অব মেরিন টেকনোলজি ও ৬৪টি কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রসহ মোট ৭০টি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের মাধ্যমে ৪৮টি ট্রেডে দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণ দেওয়া অব্যাহত রেখেছে। যার আওতায় ২০১৭ সালে ৮ লাখ ১১ হাজার ২২৭ জনকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের সংখ্যা ২০০৯ সালের তুলনায় বর্তমানে বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ১৭ গুণ।

এ সংখ্যা আরো বৃদ্ধি করতে প্রতিটি উপজেলায় একটি করে কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপনের জন্য প্রথম পর্যায়ে ৪০টি উপজেলায় ৪০টি কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের নির্মাণ কাজ সরকার ইতিমধ্যেই সমাপ্ত করেছে, যা দ্বিতীয় পর্যায়ে আরো ৫০টি উপজেলায় ৫০টি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপনের কার্যক্রমও অব্যাহত রয়েছে। যেহেতু অধিক জনসংখ্যাই আমাদের মানবসম্পদ, সেহেতু বিশাল এই জনগোষ্ঠীকে দক্ষ করে তুলে বিদেশে পাঠানোর ব্যবস্থা আরো জোড়দার হলে জনশক্তিই রফতানি আয়ের প্রধান খাত হিসেবে গড়ে উঠবে বলে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।

আগেই বলেছি, আমাদের দেশের রফতানি আয়ের বড় খাত পোশাক শিল্প। যে শিল্পে নিয়োজিত ৪০ লাখেরও বেশি কর্মী নিয়োজিত। এ খাতের বদৌলতে দেশের বেকার নারী-পুরুষের কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়েছে। ফলে দেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়েছে পোশাক খাত। কিন্তু এ খাতকে নানা প্রতিকূলতা মোকাবিলা করে টিকে থাকতে হচ্ছে। পোশাকের বাজার কাক্সিক্ষত পর্যায়ে সম্প্রসারিত হচ্ছে না। উল্টো ভারত-মিয়ানমারের মতো দেশের সহিত প্রতিযোগিতা করে টিকে থাকতে হচ্ছে।

মূলত সস্তা শ্রম মূল্যের ওপর ভর করেই এ দেশে পোশাক শিল্পের উত্থান ঘটেছে সত্য। কিন্তু দিনে দিনে পোশাক খাতের তুলনামূলক সমৃদ্ধি যেমন আসছে না, তেমনি উন্নত প্রযুক্তির যন্ত্রপাতির ব্যবহার প্রতিনিয়তই বাড়ছে। ডিজিটাল পদ্ধতির টেকনোলজির ব্যবহার বাড়লে মেন্যুয়াল পদ্ধতির কর্মীর প্রয়োজন কমে আসবে। ফলে দক্ষতা অর্জন করেও অনেককে কাজ হারাতে হবে। আর যদি পোশাক খাতের মালিক উন্নত ডিজিটাল পদ্ধতির মেশিনারিজের দিকে না ঝুঁকে, তাহলে প্রতিযোগিতার মুখে তাদেরকেও বাজার হারাতে হবে।

বর্তমানে এমন সঙ্কটের মুখে পড়তে হয়েছে পোশাক খাতকে। আর পুঁজিবাদী অর্থনীতির এটিই বড় ধরনের কুফল। যখন একচেটিয়া পুঁজির আধিপত্য সৃষ্টি হয়, তখন গুটিকতক মালিকের হাতে পুরো ব্যবসা নিয়ন্ত্রিত হতে থাকে। বাস্তব এ অবস্থার কারণে ইতিমধ্যেই দুর্বল অথচ কোনো রকমে ফ্যাক্টরি পরিচালনা করছে, এ ধরনের পোশাক কারখানাগুলো ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা আশঙ্কা করছেন, শুধুমাত্র উন্নত প্রযুক্তির কারণে অনেক পোশাক কারখানা বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এই যদি অবস্থা হয়, তাহলে একমাত্র মানবসম্পদের ওপর ভর করেই সমৃদ্ধ অর্থনীতির কথা আমাদের ভাবতে হবে। মূলত প্রাসঙ্গিকতার খাতিরেই প্রবাসী আয়ের ওপর লিখতে গিয়ে পোশাক খাতকে ঘিরে কিছু কথা লিখতে হলো।

বাস্তব এ অবস্থাকে বিবেচনায় নিয়ে সরকারকে আরো সক্রিয় হতে হবে, যেন আমাদের মানবসম্পদকে দক্ষ করে তুলে বিদেশে পাঠানো সম্ভব হয়। অবশ্য সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ও বিপুল মানবশক্তিকে কাজে লাগানোর জন্য প্রশিক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছে। আমরা মনে করি, প্রশিক্ষণ খাতে আগামী বাজেটে অর্থ বরাদ্দ বাড়িয়ে গোটা দেশেই প্রতিটি উপজেলায় ও জেলা সদরে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ে তোলা হোক। কারণ যে খাত বিদেশি অর্থ আহরণের একমাত্র পথ, সে খাতকে অধিক গুরুত্ব দিতে হবে।

অবশ্য সরকার বিদেশগামীদের প্রশিক্ষণ গ্রহণ পাসপোর্ট সহজীকরণে জেলায় জেলায় পাসপোর্ট অফিস স্থাপন এবং কর্মসংস্থান ও জনশক্তি অফিসে ফিঙ্গারপ্রিন্ট কার্যক্রম বিকেন্দ্রীকরণে অনেক জেলায় কাজ শুরু করেছে। এর বাইরে ২০১৭ সালে লেবানন ও মরিসাসে দুইটি শ্রমকল্যাণ উইং চালু করা হয়েছে। পাশাপাশি প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক বিভিন্ন জেলায় ৫৪টি শাখার মাধ্যমে অনলাইন ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করছে। প্রবাসীরা সহজে যেন ঝামেলা ছাড়াই দেশে টাকা পাঠাতে পারে তার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।

একমাত্র বিদেশ থেকে টাকা পাঠানোর ক্ষেত্রে বাড়তি খরচ ও ঝামেলার কারণে মোবাইলে ব্যাংকিং, হুন্ডি, এমনকি প্রবাসে অন্য কারো সহযোগিতায় দেশে টাকা পাঠানোর কারণে রেমিট্যান্স প্রবাহে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছিল। কিন্তু বৈধ চ্যানেলের টাকা পাঠালে প্রণোদনা দেয়ার কারণে রেমিট্যান্স বেড়েছে। আশা করা যাচ্ছে, ভবিষ্যতে অন্য চ্যানেলে দেশে টাকা পাঠানো বন্ধ হবে এবং কাক্সিক্ষত রেমিট্যান্স আহরণ করা সম্ভব হবে। এমনকি প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় প্রবাসীদের মধ্যে ঋণ বিতরণ কার্যক্রমও পরিচালনা করতে শুরু করেছে।

যার আওতায় গত ২০১৭ সালে ৬ হাজার ২১৭ জনকে অভিবাসন ঋণ বাবদ ৭৭ কোটি ৫০ লাখ ৬৫ হাজার টাকা এবং ৫ জনকে পুনবার্সন ঋণ বাবদ ১১ লাখ টাকা প্রদান করা হয়েছে। এর বাইরে মানবিক দিক বিবেচনায় নিয়ে প্রবাসে মৃত্যুবরণ করা তিন হাজার ৪২৯ জন মৃত কর্মীর পরিবারকে ৩৫ হাজার টাকা করে মোট ১১ কোটি ৪১ লাখ ৩৫ হাজার টাকা দেয়া হয়েছে। আবার ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড থেকে প্রবাসী মৃত কর্মীর পরিবার প্রতি তিন লাখ টাকা করে ৩ হাজার ৫০৫ জন কর্মীর পরিবারকে ১০১ কোটি ১৬ লাখ ৩০ হাজার টাকা আর্থিক অনুদান হিসেবে প্রদান করা হয়েছে।

এ ছাড়াও প্রবাসে মৃত্যুবরণকারী কর্মীর মৃত্যুজনিত ক্ষতিপূরণ, সার্ভিস বেনিফিট বাবদ এক হাজার ১৪২ জন কর্মীর অনুকূলে আদায়কৃত ৬৯ কোটি ৩৫ লাখ টাকা তাদের পরিবারকে দেওয়া হয়েছে। আবার দুই হাজার ৩৪৩ জন প্রবাসী কর্মীর মেধাবী সন্তানদের অনুকূলে তিন কোটি ২৬ লাখ টাকা শিক্ষাবৃত্তি প্রদান করা হয়েছে। ইতিমধ্যেই প্রবাসীদের কল্যাণ ও সাহায্যার্থে ডিজিটাল হেল্প ডেস্ক চালু করা হয়েছে। যদিও বিলম্বে এ উদ্যোগ নেয়া হয়েছে, তবুও এ উদ্যোগ যে প্রবাসীদের সমস্যা নিরসনে বড় মাপের ভূমিকা রাখবে, যা বলাই বাহুল্য।

এ প্রসঙ্গে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী বলেন, শুধুমাত্র প্রবাসী আয়ের খাতকে আরো বিকশিত করতে ২০১৮ সালে যে কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে, তার সফল বাস্তবায়ন হলে এ বছর অন্তত ৮ লাখ কর্মীকে বিদেশে পাঠানো সম্ভব হবে। তিনি আরো বলেন, বিশেষ করে বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রনালয় দক্ষ ও আধাদক্ষ কর্মী পাঠানোর ক্ষেত্রে গুরুত্ব দিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। বিদেশে কর্মী পাঠানোর এ ধারা অব্যাহত থাকলে হয়তো নিকট ভবিষ্যতে প্রবাসে কর্মী পাঠানোর সংখ্যা আরো বৃদ্ধি পাবে বলেও তিনি মন্তব্য করেন।

বাংলাদেশ এখন বিশ্বের ১৬২টি দেশে জনশক্তি রফতানি করছে। যার ৮০ শতাংশই যায় মধ্যপ্রচ্যের দেশগুলোতে। বিশ্বের আরো ৫০টি দেশে জনশক্তি রফতানি করার ওপর সমীক্ষা চালানো হচ্ছে। নতুন নতুন দেশে কর্মক্ষেত্র প্রসারিত করা সম্ভব হবে বলেও আশাবাদ রয়েছে। আমরাও মনে করি, শুধু মধ্যপ্রচ্যের উপর নির্ভরশীল না থেকে শ্রমশক্তি রফতানির ক্ষেত্রকে দেশে দেশে সম্প্রসারিত করতে হবে। তাহলে সম্ভাবনার বিপুল জনশক্তি আমাদের সমৃদ্ধ অর্থনীতির জন্য আশীর্বাদ হতে পারে।

বিশেষ করে তেলের দরকে ঘিরে বর্তমানে মধ্যপ্রচ্যের দেশগুলোতে অর্থনীতি অনেকটাই নাজুক। এ অবস্থায় যে কোনো মুহূর্তে মধ্যপ্রাচ্যের বাজার সম্প্রসারিত না হয়ে বরং সঙ্কুচিত হতে পারে। এমতাবস্থায় নতুন শ্রম বাজার উক্ত করাই হবে সঠিক ও সময়োচিত সিদ্ধান্ত। যেহেতু আমাদের অর্থনীতির ভালো মন্দ প্রবাসী রেমিট্যান্সের ওপর অনেকাংশেই নির্ভরশীল, সেহেতু শ্রমশক্তি রফতানির ক্ষেত্রকে সম্প্রসারিত করতে না পারলে প্রতিবছর যে বিপুল পরিমাণ মানুষ কর্মক্ষম হয়ে উঠছে, তাদের কর্মসংস্থানকে নিশ্চিত করা অবশ্যই কঠিন হবে। যা আমাদের টেকসই সমৃদ্ধ অর্থনীতির জন্য কোনোভাবেই শুভ হবে না।

বাংলানিউজসিএ/ঢাকা/ ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২০ /এমএম


Array