Menu

ভারত-পাকিস্তানের সুমতি ফিরুক

বিমল সরকার :: জাতশত্রু মানে জন্ম থেকে শত্রু। ভারত ও পাকিস্তানের বেলায় এমন শব্দ বা শব্দবন্ধটি একেবারে সেই চল্লিশের দশক থেকে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রাম ও রক্তাক্ত পথ অতিক্রম করে উপমহাদেশবাসীর একদিকে যেমন স্বপ্নের স্বাধীনতা লাভ, অন্যদিকে বাংলা, পাঞ্জাব, আসাম, কাশ্মীর ইত্যাদি ঐতিহ্যবাহী সব জনপদের বিভক্তি তাদের মধ্যে অসন্তোষ-অস্বস্তিরও সৃষ্টি করে।

অস্বস্তি-অসন্তোষের পাশাপাশি পারস্পরিক সন্দেহ-অবিশ্বাস, ঈর্ষা-হিংসা, উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা, এমনকি প্রতিশোধপরায়ণতার মনোভাব নিয়ে শুরু হয় রাষ্ট্র দুটির পথচলা। উত্তেজনা যেন তাদের ছায়াসঙ্গী। বিগত ৭২ বছরে অসংখ্যবার বিস্ফোরণোন্মুখ পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে।

এর মধ্যে বেশ কয়েকবার যুদ্ধের দামামাও বেজে উঠেছে। রক্তক্ষয় হয়েছে প্রচুর। তবে যেভাবেই হোক, চরম বৈরী পরিস্থিতিতেও নেতাদের ফিরে পাওয়া সম্বিৎ বা সুমতি অনেকবারই রক্ষাকবচ হয়ে কাজ করেছে।

দীর্ঘদিনের ব্রিটিশ শাসন ও শোষণের নাগপাশ থেকে মুক্ত হয়ে ১৯৪৭ সালে একই সময় ভারত ও পাকিস্তান স্বাধীনতা লাভ করে। আশির দশকে মোটামুটি অল্প সময়ের ব্যবধানে প্রতিবেশী দেশ দুটি পারমাণবিক শক্তির অধিকারী হয়।

ভারত তার বহু সাধনালব্ধ ও নিজের তৈরি প্রথম ভূ-উপগ্রহটির নাম দেয় ‘পৃত্থী’। পৃত্থী মানে দ্বাদশ শতাব্দীর দিল্লি ও আজমীরের বিখ্যাত চৌহান বংশীয় হিন্দু রাজা পৃত্থীরাজ। সচেতন সবারই মনে থাকার কথা, ১২০৬ সালে মুসলিম সেনাপতি কুতুবউদ্দিন আইবেক দিল্লি জয় করে ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলিম শাসনের ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন।

এর আগে কুতুবউদ্দিনের প্রভু গজনীর সুলতান মুহম্মদ ঘুরী (শিহাবউদ্দিন মুহম্মদ ঘুরী) ভারত অভিযানে এসে ১১৯২ সালে তরাইনের প্রান্তরে সংঘটিত প্রথম যুদ্ধে পৃত্থীরাজের কাছে পরাস্ত হয়ে নিজ রাজ্যে ফিরে যান। বহিরাগত মুসলিম আক্রমণকারীর বিরুদ্ধে ‘হিন্দুকুলগৌরব’ রাজা পৃত্থীরাজের এ বীরত্বকে স্মরণ ও অনুপ্রেরণা হিসেবে বিবেচনা করেই ভারত ভূ-উপগ্রহের এমন নামকরণ করে।

কিন্তু পরের বছরই ভারত ইতিহাসের পট সম্পূর্ণভাবে পরিবর্তিত হয়ে পড়ে। নতুন উদ্যম ও শক্তিতে বলীয়ান হয়ে ১১৯৩ সালেই মুহম্মদ ঘুরী গজনী থেকে আবার ভারতে এসে পৃত্থীরাজকে আক্রমণ করে আগেরবারের পরাজয়ের প্রতিশোধ নেন। তরাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধে মুহম্মদ ঘুরী তার শত্রু পৃত্থীরাজকে সমুচিত জবাব দিয়ে যে বীরত্বের পরিচয় দেন, তা স্মরণ করে ভারতের ‘পৃত্থী’র বিপরীতে পাকিস্তান তার ভূ-উপগ্রহের নামকরণ করে ‘ঘুরী’। ভারত-পাকিস্তান দুই চিরবৈরী দেশে এসব কিছুরই সম্প্রসারিত রূপ হচ্ছে ‘পৃত্থী-২’ ও ‘ঘুরী-২’।

ভারত-পাকিস্তান বা ভারতীয় ও পাকিস্তানিদের মধ্যকার শত্রুতা-বৈরিতা নিয়ে এ অঞ্চলে অনেক গল্প-কাহিনী প্রচলিত রয়েছে। এ বিষয়ে উপমহাদেশের প্রখ্যাত সাংবাদিক ও লেখক খুশবন্ত সিংয়ের একটি খুবই লোকপ্রিয় কৌতুক এমন- ওয়াশিংটন থেকে নিউইয়র্কগামী বিমানের সংক্ষিপ্ত যাত্রায় দুই পাকিস্তানি যাত্রীও ছিল। তাদের একজন জানালার পাশে বসেছে। অন্যজন মাঝখানের আসনে।

বিমান আকাশে ওড়ার ঠিক আগে এক ছোটখাটো মোটা ভারতীয় যাত্রী বিমানে আরোহণ করে প্যাসেজের ঠিক পাশের আসনটিতে বসল পাকিস্তানিদের পাশেই। ভারতীয় তার জুতা খুলে যখন আরাম করে হেলান দিতে যাচ্ছিল, তখনই জানালার পাশে বসা পাকিস্তানি বলল- ‘দেখি, আমি গিয়ে একটা কোক নিয়ে আসি।’ ভারতীয় যাত্রী বলে উঠল- ‘আপনার কষ্ট করার প্রয়োজন নেই।

আমিই আপনার জন্য নিয়ে আসছি।’ সে যখন কোক আনতে গেল, তখন পাকিস্তানি তার একটি জুতা হাতে নিয়ে জুতার মধ্যে থুথু ফেলল। কোক হাতে ভারতীয় ফিরে এলে দ্বিতীয় পাকিস্তানি বলে উঠল, ‘একটা কোক বোধহয় আমারও পান করা উচিত।’ ভারতীয় যাত্রী পুনরায় তার সহযাত্রী পাকিস্তানির জন্য কোক আনতে গেল। দ্বিতীয় পাকিস্তানি তার অন্য জুতাটা তুলে তাতে থুথু ফেলল।

ভারতীয় ফিরে এসে পাকিস্তানিকে কোকটি দিল। তাদের সংক্ষিপ্ত যাত্রা বেশ উপভোগ্য ছিল। বিমান যখন অবতরণের প্রস্তুতি নিচ্ছে, তখন ভারতীয় যাত্রী তার জুতা পায়ে দিয়ে বুঝতে পারল- কী ঘটেছে! সে মন্তব্য করল- ‘এ অবস্থা আর কতদিন চলবে আমাদের লোকদের মধ্যে শত্রুতা, এ ঘৃণা, জুতার মধ্যে থুথু ফেলা এবং কোকের মধ্যে পেশাব করা।’

বলা হয়, যারা পরস্পরের জাতশত্রু তাদের বিরোধ কখনও মিটবার নয়। ঈশপ অথবা শেখ সাদীর প্রচলিত নীতিকথাবিষয়ক গল্পটি এখানে স্মরণযোগ্য। গ্রামের একটি ছেলেকে সাপে কামড়ালে কিছুক্ষণ পর ছেলেটি মারা গেল।

ওর বাপ রাগের চোটে একটা কুড়াল নিয়ে বসল গর্তের ধারে, বেরোলেই সে সাপকে এক কোপে খতম করবে। খানিকক্ষণ পর সাপটা মাথা বের করতেই লোকটা এক কোপ ঝাড়ল বটে; কিন্তু সাপের মাথায় না লেগে লাগল গিয়ে এক পাথরে। পাথরটা ফেটে গেল। সাপকে মারতে গিয়েছিল, তাতে সে রেগে রয়েছে, কখন কী করে বসে ঠিক নেই ভেবে লোকটা সাপের সঙ্গে ভাব করতে গেল।

কিন্তু না, সাপ তাতে রাজি নয়। সে বলল, ‘দুজনে ভাব হবে কী করে! পাথরের ওই জায়গাটা দেখলেই আমার মনে পড়বে, তুমি আমার কী করতে গিয়েছিলে আর তোমার ছেলের কবরের দিকে নজর পড়লেই তোমার মনে হবে, আমি তোমার কী করেছি। এমন দু’জনের মধ্যে কখনও ভাব হয়?’

যথেষ্ট পরিমাণে উদার ও ক্ষমাশীল হলেই কেবল উভয়ের মধ্যে সদ্ভাবের সৃষ্টি হতে পারে। যদিও তা খুবই দুরূহ। তবে সবাইকে ভাবতে হবে যে, আমরা এখন নয়া দুনিয়ার বাসিন্দা। দুনিয়া অনেক দূর এগিয়েছে। গ্লোবাল ভিলেজের ধারণা নিয়ে আজ আমরা গর্ব করি। প্রতিবেশী হিসেবে ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনা ও অপতৎপরতা আমাদেরও সব সময় ভাবায়, ভাবিয়ে রাখে।

ভারতের প্রখ্যাত কূটনীতিক দেব মুখার্জি নব্বইয়ের দশকের শেষার্ধে ঢাকায় হাইকমিশনার থাকাকালে সংবাদমাধ্যমে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘ধর্ম পরিবর্তন করা যায়, স্ত্রীর সঙ্গেও বিচ্ছেদ ঘটতে পারে। কিন্তু প্রতিবেশীকে কোনোক্রমেই উপেক্ষা করা চলে না।’ অতএব বন্ধ হোক হানাহানি ও পারস্পরিক কাদা ছোড়াছুড়ি। নিন্দা-অপবাদ, হিংসা-রেষারেষি।

কেবল ভারত-পাকিস্তান নয়, সব প্রতিবেশীর মাঝেই সুমতি ফিরে আসুক অথবা বজায় থাক- এটাই আমাদের প্রত্যাশা।। অনেক কিছু ভুলতে হবে, ভুলে যেতে হবে। এক্ষেত্রে উদার মন নিয়ে আলোচনায় বসার কোনো বিকল্প আছে বলে আপাতত মনে হচ্ছে না। বিরোধ দীর্ঘদিনের, সময় তো লাগবেই। তবে বসে থাকলে চলবে না।

বিমল সরকার : কলেজ শিক্ষক
সূত্র: যুগান্তর

বাংলানিউজসিএ/ঢাকা/৯ মার্চ ২০১৯/ইএন