বাংলানিউজসিএ ডেস্ক :: বুয়েটে ছাত্রলীগের কিছু নেতাকর্মীর হাতে আবরারের নৃশংস হত্যার ঘটনায় সারা দেশ নিন্দা ও ক্ষোভে উত্তাল হয়ে ওঠে। সরকার, বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী এ ব্যাপারে দ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দেয়ায় দেশবাসী অনেকটা খুশি।ছাত্রলীগ সরকারি দলের অঙ্গসংগঠন হওয়ায় এ ব্যাপারে নিন্দা ও প্রতিবাদ যে তাদের গায়েও লেগেছে, তা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের স্বীকারোক্তি থেকেও বোঝা যায়। তিনি স্বীকার করেছেন, ছাত্রলীগের এ নশৃংস সন্ত্রাসীকাণ্ডে তারা বিব্রত।
আশা করি, বিষয়টি নিয়ে তারা শুধু সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনি ব্যবস্থাই নেবেন না, একদল ছাত্রের এ ধরনের সন্ত্রাস ও বর্বরতার সামাজিক, মানসিক ও রাজনৈতিক কারণও অনুসন্ধান করবেন। ছাত্রনং অধ্যয়নং তপঃ, অর্থাৎ ছাত্রের কাছে অধ্যয়নই তপস্যা।এ চিরায়ত সত্যটি আমাদের বিদ্যালয়গুলো থেকে হারিয়ে গেল কেন? কেন Pen is mightier than sword বা কলম তরবারির চেয়েও শক্তিশালী- এ মহান বাক্যটিও প্রায় উধাও হয়ে গেল? অথচ এ নিয়ে আমাদের সময়ে কলেজে বিতর্ক প্রতিযোগিতা হতো এবং এখনও মাঝে মাঝে হয়। বাস্তব জীবনে এসব এখন মূল্যহীন বা কথার কথায় পরিণত হয়েছে কেন?
কথাগুলো মনে পড়ল এ কারণে যে, আনুষ্ঠানিক ও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সঙ্গে এককালে কিছু মহৎ আদর্শ, উদ্দেশ্য ও গুণাবলি ছাত্রদের জানা, বিশ্বাস করা এবং জীবন ধারণ করা কর্তব্য বলে মনে করা হতো। আজকের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে (বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে) একদল মাস্তান ছাত্রের কারণে সেসব গুরুত্ব হারিয়েছে বলা যায়।দেখা যাচ্ছে, গত প্রায় ২০-২৫ বছর ধরে ছাত্র রাজনীতির নামে তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসগুলোতে শিক্ষার বদলে সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে। এটা বিগত বিএনপির আমলে যেমন সত্য ছিল, তেমনি বর্তমান সরকারের আমলেও বহাল আছে।
এর ধারাবাহিকতার সর্বশেষ বলি হল আবরার। আর আবরার হত্যার ফলে দেশবাসীর সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীও সন্ত্রাসী ছাত্রদের দমনে কঠোর মনোভাব প্রকাশ এবং উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন।এটা দেশের কে না জানে, ছাত্র রাজনীতির নামে যা করা হয় তা একেবারেই অপরাধমূলক সন্ত্রাসী কাজ। দেশের শিক্ষিত সচেতন মানুষ জানে ছাত্র নামধারী দল বা লীগের আসল কাজ হল তাদের পৃষ্ঠপোষক বড় দলগুলোর লেজুড়বৃত্তি।
তাদের নামে মিটিং-মিছিল করা, দলের শীর্ষ নেতানেত্রীদের গুণগান করা, সংবর্ধনা বা খেতাব প্রদান, বিরোধী দল বা পক্ষের সভা-সমিতি ভণ্ডুল করা। ক্যাম্পাস বা হল থেকে বিরোধী পক্ষকে বিতাড়িত করাসহ তাদের শীর্ষ নেতানেত্রীর সমালোচনাকারীদের মারধর করার মতো অন্যায়, অবৈধ ও অগণতান্ত্রিক কাজ করা।এসব তারা কোনো আদর্শবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে করে না। করে ক্ষমতা ও সম্পদ অর্জনের জন্য, যার প্রকাশ ঘটে ছিনতাই, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, সিট বাণিজ্য, ভর্তিবাণিজ্যসহ হরেকরকমের অবৈধ পথে অর্থ উপার্জনের মাধ্যমে।
কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন ছাত্রলীগের (আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে) শীর্ষ পদগুলো বিক্রি হয় বলে শোনা যায়। এমন একটি ঘটনা সম্প্রতি কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রচার পেয়েছে। একই ধরনের ঘটনা বিএনপি আমলে ছাত্রদলের ক্ষেত্রেও যে ঘটেনি, তা বিশ্বাস করা যায় না।তাই সুশীল সমাজের একটি অংশ ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করার দাবি তুলেছে। অন্যদিকে আরেকটি অংশ ছাত্র রাজনীতি নয়, লেজুড়বৃত্তিমূলক সন্ত্রাসী কাজকর্মের নায়ক ছাত্রদের তথাকথিত ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করার দাবি তুলেছে।
তাদের কথা হল, শিক্ষিত সচেতন ছাত্রসমাজ ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে এ দেশের সব প্রগতিশীল আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছে। শেষ পর্যন্ত আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলন এবং মুক্তিযুদ্ধে গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা পালন করেছে।স্বাধীনতার পর ’৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে ছাত্রসমাজের ভূমিকাও এখানে উল্লেখ করতে হয়। গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনও এখানে উল্লেখ না করে পারা যায় না। স্বেচ্ছায় স্বপ্রণোদিতভাবে দেশ ও মানুষের প্রতি ভালোবাসা ও দায়িত্ববোধ থেকে আমাদের তরুণ ছাত্রসমাজ অতীতে যেমন আন্দোলন-সংগ্রাম করেছে, এখনও কোনো লোভ-লালসায় তাড়িত না হয়ে তারা আন্দোলন-সংগ্রামের ঐতিহ্যটি বহাল রাখবে।
তাই দেশ ও মানুষের স্বার্থেই রাজনীতি ও রাষ্ট্রীয় কাজকর্মের ব্যাপারে ছাত্রদের মতামত প্রদান এবং আন্দোলন, বাধা-নিষেধমুক্ত থাকা দরকার। তাছাড়া মুক্ত আলোচনা, স্বাধীন মতামত প্রকাশ করার গণতান্ত্রিক অধিকার সব নাগরিকের মতো তরুণ ছাত্রদেরও আছে।দেশবাসী বিশ্বাস করে, গুটিকয়েক পেশাদার সন্ত্রাসী ও লোভী ছাত্রনেতা ছাড়া বিরাট সংখ্যাগরিষ্ঠ ছাত্র-তরুণদের মন আদর্শবাদিতায় উজ্জীবিত এবং অন্যায়, অসত্য ও অসততার বিরুদ্ধে প্রতিবাদী। এটি এক অর্থে একটি রাষ্ট্রের উন্নতি ও অবনতির নিয়ামক।
তাই যখনই দেশে অন্যায়, অনিয়ম, অত্যাচার ও দুর্নীতি হবে অথবা মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার ও স্বাধীনতা খর্ব হবে, স্বাভাবিকভাবেই তখন ছাত্রসমাজ প্রতিবাদে সোচ্চার হবে, কোনো দলের লেজুড় বা লাঠিয়াল হিসেবে নয়, জনগণের সাহসী সন্তান হিসেবে। এটাই হল প্রকৃত ছাত্র রাজনীতি তথা রাজনীতি সচেতন ছাত্রসমাজের কাজ। এটা দেশ ও গণতন্ত্রের স্বার্থে নিষিদ্ধ করা যাবে না। এ ধরনের ছাত্র রাজনীতির বিরোধী কেউ হতে পা
রে না। এ রাজনীতির শক্তি হচ্ছে নৈতিক, আর এখন ছাত্র রাজনীতির নামে যা চলছে তার শক্তি হচ্ছে দৈহিক, যাকে পেশিশক্তি বা পশু শক্তিও বলা যায়। এ পশু শক্তিরই প্রকাশ দেখি যখন সরকার বা সরকারের কাজের কোনো সমালোচনা করলে বা বিরুদ্ধ মত প্রকাশ করলে সরকারের আশীর্বাদপুষ্ট একদল ছাত্র সমালোচনাকারী বা বিরুদ্ধবাদীদের ওপর হামলা ও নির্যাতন চালায়।সভা, সেমিনার বা গ্রুপ মিটিং ইত্যাদির মাধ্যমে দেশ, সরকার বা সমাজের কোনো সমস্যা বা প্রয়োজনীয়তার ব্যাপারে কোনো মতামত বা বক্তব্য পেশ করতে সন্ত্রাসী ছাত্রদের দেখা যায় না। একপক্ষের বক্তব্যের বিপরীতে নিজেদের বক্তব্য কথায় বা লেখায় প্রকাশ করার বিষয়টি তাদের অভিধানে নেই।
কারণ এসব বিপথগামী সন্ত্রাসী ছাত্রের যুক্তি ও বুদ্ধি প্রদর্শনের ক্ষমতা নেই। সে ক্ষমতা থাকলে এরা দলীয় লেজুড়বৃত্তি বা লাঠিয়ালগিরির চর্চা করত না। করত শিক্ষারচর্চা, যা যুক্তি ও বুদ্ধির উন্মেষ ও বৃদ্ধি ঘটায়। রাজনীতির মাঠে সব সময় এসব ছাত্র সন্ত্রাস ও দুর্নীতি চর্চার সুযোগ পায় না বটে; তবে তাদের অপকর্মের মূল কেন্দ্র হয়ে দাঁড়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। সেখানকার নিয়মশৃঙ্খলা ভঙ্গ করা তাদের প্রধান কাজ।
ফলে বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে নামে প্রভোস্ট ও হাউস টিউটর থাকলেও সরকারি দলের ছাত্রনেতারাই বহুলাংশে প্রশাসন চালায়। হলে সিট বণ্টন, কর্মচারী নিয়োগদান, কেনাকাটা বা ছোটখাটো নির্মাণ কাজের ঠিকাদারি কার্যত ছাত্রনেতারাই করে থাকেন।
এভাবেই তারা শিক্ষার বিপরীত কাজ সন্ত্রাস ও দুর্নীতিতে দক্ষ হয়ে ওঠেন। আর এদের দাপটের কারণে হল প্রশাসন অত্যাচারিত ও নির্যাতিত ছাত্রদের কোনো আবেদন-নিবেদনের প্রতিকার করতে পারে না। আমার জানামতে, তাদের এ অসহায়ত্ব এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, তারা ছাত্রনেতাদের সঙ্গে অনেকটা আপসরফা করে নিজেদের পদগুলো বাঁচিয়ে রাখে।
তা না হলে বুয়েটের শেরে বাংলা হলের প্রভোস্ট ও হাউস টিউটররা এ নিয়মিত নির্যাতন ও র্যাগিংয়ের প্রতিকারের ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ নিলেন না কেন? বুয়েটে ছাত্রকল্যাণের জন্যও একজন পরিচালক আছেন।নিহত আবরারসহ বুয়েটের হলে হলে অসংখ্য নিরীহ নিরপরাধ ছাত্রের ওপর বছরের পর বছর ধরে নির্যাতনের ব্যাপারে কোনো প্রতিকারের ব্যবস্থা না করার দায় বুয়েট ও হলগুলোর প্রশাসন এড়াতে পারে না।
একই ধরনের জুলুম-নির্যাতন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোয়ও যে চলে, তা ওয়াকেফহাল মহলের অজানা নয়। হরেকরকমের এ নির্যাতন এবং নির্যাতনে চোখ হারানো বা শীতে ভুগে মৃত্যুর ঘটনাও পত্রপত্রিকায় এসেছে।ছাত্র রাজনীতির নামে একদল ছাত্রের এ অসভ্যতা চর্চার জন্য আমাদের মূলধারার রাজনীতিও কম দায়ী নয়। কিছুসংখ্যক ছাত্রকে লেজুড়বৃত্তি ও লাঠিয়ালগিরিতে তারাই উৎসাহিত করেছে। এর সঙ্গে দেশ ও সমাজে মূল্যবোধের অবক্ষয়ও কম দায়ী নয়। এখন অন্যায়, অবৈধ কাজ অনেক ক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্যতা পেয়ে গেছে।
ঘুষ-দুর্নীতির পথে ধন-সম্পদ অর্জন এখন খুব একটা নিন্দনীয় ব্যাপার নয়। ‘উপরি’ রোজগারের সুযোগসম্পন্ন চাকরি এখন সমাজে বেশ লোভনীয় ও সমাদৃত। ভালো ছাত্র না হয়ে ‘বড়’ ছাত্রনেতা হলে যদি ভালো আয়-রোজগারের ব্যবস্থা হয়, এমনকি ভবিষ্যতে মন্ত্রী-এমপি হওয়া যায়, তাহলে পণ্ডিত হয়ে কী হবে? পাণ্ডিত্য কি এ দেশে ধনী হওয়ার পথ? আর এ দেশে ধনীরাই তো ‘বড়লোক’! জ্ঞানী ও গুণীরা কি এ দেশে আদর্শ বা ‘বড়লোক’?
এখন দেশে সন্ত্রাস ও দুর্নীতিবিরোধী যে অভিযান চলছে, তাতে যেসব ‘মহানায়ক’ এবং তাদের পৃষ্ঠপোষকদের নাম আসছে, তাদের ধন-সম্পদের বহর দেখলে বিস্মিত হতে হয়। শুধু সন্ত্রাস ও দুর্নীতির পথে তারা শত কোটি থেকে হাজার কোটি টাকার মালিক হয়েছে।
দেখা যাচ্ছে, তাদের এ অবৈধ আয়ের উপকারভোগীদের মধ্যে বেশকিছু বড় রাজনৈতিক নেতার নামও আছে। উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তারাও যে তাদের বখরা পায়নি, তা বলা যাবে না। দেশে এখন ‘বড়লোক’ হওয়ার জন্য সন্ত্রাস ও দুর্নীতিতে পারঙ্গম হওয়াও একটি মোক্ষম পথ বললে ভুল হবে বলে মনে হয় না।
এখানে মূল প্রসঙ্গ ছাত্র রাজনীতি। উপরের আলোচনা থেকে প্রকৃত ছাত্র রাজনীতির ব্যাপারে আশা করি কিছুটা ধারণা পাওয়া যাবে। সে রাজনীতির বিরুদ্ধে বলার প্রশ্নই ওঠে না। সে রাজনীতির নায়ক ছাত্রনেতারা ত্যাগ-তিতিক্ষার মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে দেশ ও মানুষের স্বার্থে কাজ করেছেন।
এখন দেশবাসী চায় পড়াশোনার সঙ্গে ছাত্রসমাজ দেশ ও মানুষের ব্যাপারে স্বাধীনভাবে চিন্তাভাবনা করবে এবং মতামত প্রকাশ করবে। তবে ছাত্র রাজনীতির নামে সন্ত্রাসকে প্রশ্রয় দেয়া বা সম্মানিত করা যাবে না। ছাত্র নামধারী এ পশুদের প্রকৃত ঠিকানা হচ্ছে চিড়িয়াখানা, বিদ্যালয় নয়।
বাংলানিউজসিএ/ঢাকা/ ৩১ অক্টোবর ২০১৯ /এমএম