Menu

প্রবাস বাংলা ভয়েস ডেস্ক ::  ক্রিকেট এক গৌরবময় অনিশ্চয়তার খেলা। এই খেলায় জয়ের আনন্দ যেমন আছে তেমনি আছে হৃদয় ভাঙার তীব্র বেদনা। এখানে রাতারাতি তারকা খ্যাতি যেমন মিলে; তেমনি পারফরম্যান্সের কারণেই যেতে হয় তীব্র সমালোচনার মধ্যে দিয়ে। সমর্থকরা মাথায় তুলে যেমন নাচতে জানে; তেমনি জানে ডাস্টবিনে ছুড়ে ফেলতেও। ইতিহাসে এমন বেশ কয়েকজন ক্রিকেটার আছেন, যারা সাফল্যের সর্বোচ্চ চূড়ায় যেমন পৌঁছেছিলেন তেমনি পরবর্তীতে সেই তারাই মনে দাগ কেটে আছেন খলনায়কের ভূমিকায়।ক্রিকেটে মহানায়ক থেকে খলনায়ক হয়েছেন যারা। অর্থাৎ ক্রিকেট যাদের সবকিছু দিয়েও আবার কেড়ে নিয়েছে তাদের নিয়েই এই প্রতিবেদন—

মোহাম্মদ আজহারউদ্দিন (১৯৮৫-২০০০)

১৯৮৪ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্ট অভিষেক হয় ২১ বছর বয়সি এক তরুণের। সেই তরুণ নিজের প্রথম ম্যাচেই হাঁকিয়ে বসলেন সেঞ্চুরি। পরের দুই ম্যাচেও একই কাজ। ক্রিকেট বিশ্বে রীতিমতো হইচই পড়ে গেল। বিশ্ব চিনল মোহাম্মদ আজহারউদ্দিনকে। পরবর্তীতে ক্রিকেট প্রতিভায় মুগ্ধতা ছড়িয়ে চার বছরের মাথায় ভারতের অধিনায়কত্ব বুঝে পান আজহারউদ্দিন। ক্রিকেট দিয়ে সাফল্যের সর্বোচ্চ চূড়ায় পৌঁছেছিলেন তিনি। তার নেতৃত্বে ১৭৪ ওয়ানডের মধ্যে ৯০টিতেই জয় পায় ভারত। প্রথম ক্রিকেটার হিসেবে ৩০০ ওয়ানডে ম্যাচ খেলার গৌরব অর্জন করেছিলেন আজহারউদ্দিন। ক্রিকেটের জন্য জিতেছেন ভারতের অর্জুনা অ্যাওয়ার্ড, পদ্মশ্রী পুরস্কার ও ‘উইজডেন ক্রিকেটার অব দ্য ইয়ার’। অথচ সেই তাকেই একটা সময় ছুড়ে ফেলে দিয়েছিল ভারত। নিষিদ্ধ করা হয়েছিল আজীবনের জন্য।

ক্রিকেটে মহানায়কে পরিণত হওয়া আজহারউদ্দিন রাতারাতি পরিণত হন ইতিহাসের খলনায়কে। ২০০০ সালে তৎকালীন দক্ষিণ আফ্রিকার অধিনায়ক হ্যান্সি ক্রোনিয়ের বিরুদ্ধে ম্যাচ ফিক্সিংয়ের অভিযোগ উঠে। আর সেই অভিযোগ তদন্তে নেমেই কেঁচো খুড়তে বেরিয়ে আসে সাপ। ক্রোনিয়ে জানান, ১৯৯৬ সালে ভারতের বিপক্ষে কানপুর টেস্টের তৃতীয় দিন শেষে ভারতীয় অধিনায়ক আজহারের ফোন পেয়ে বুকি মুকেশ গুপ্তার সঙ্গে দেখা করেন তিনি। সেখানেই ম্যাচ ফিক্সিংয়ে জড়িয়ে পড়েন তিনি। ১৯৯৬ সালে রাজকোটে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে এবং ১৯৯৭ ও ১৯৯৯ সালের পেপসি কাপে ম্যাচ ফিক্সিংয়ে জড়িত থাকার অভিযোগে আজীবন নিষিদ্ধ হন আজাহারউদ্দিন। ইতিহাসের মহানায়ক পরিণত হন খলনায়কে। শেষ হয়ে যায় আজহারউদ্দিনের ক্যারিয়ার।

হ্যান্সি ক্রোনিয়ে (১৯৯৪-২০০০)

আজহারউদ্দিনের সঙ্গে তার ক্যারিয়ারটাও সেদিন শেষ হয়ে গিয়েছিল। অথচ, ইতিহাসের সেরা অধিনায়কদের তালিকা করলে এখনো সেখানে অবধারিতভাবেই জায়গা হবে দক্ষিণ আফ্রিকার হ্যান্সি ক্রোনিয়ের। তার অধীনে ক্রিকেট বিশ্বে এক পরাশক্তিতে পরিণত হয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকা। ১৩৮ ওয়ানডেতে নেতৃত্ব দিয়ে ৯৯টিতেই দলকে জিতিয়েছেন তিনি। ৮ বছরের ক্যারিয়ারে ৬৮টি টেস্ট ৩,৭১৪ রানের পাশাপাশি ৪৩টি টেস্ট উইকেট শিকার করেছেন ক্রোনিয়ে। ১৮৮টি ওয়ানডে ৫,৫৬৫ রানের সঙ্গে এই অলরাউন্ডারের উইকেট সংখ্যা ১১৪। তার নেতৃত্বে ১৯৯৯ বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল থেকে দুর্ভাগ্যজনকভাবে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে বাদ পড়ে দক্ষিণ আফ্রিকা।

তবে ক্রোনিয়ের ওপর আস্থা রেখেই এগোচ্ছিল প্রোটিয়ারা। যদিও এই মহাতারকার শেষটা হয়েছে খলনায়কের ভূমিকায়। ১৯৯৬ সালে ভারতের বিপক্ষে ম্যাচ পাতানোর অভিযোগ প্রমাণিত হলে আজীবন নিষিদ্ধ করা হয় তাকে। ক্রোনিয়ে যে সত্যিই আজহারউদ্দিনের দেখা করানো বুকি মুকেশ গুপ্তার কথায় ম্যাচ পাতিয়েছিলেন পরবর্তীতে সেই দলের অনেকেই সেটা স্বীকার করেছেন। আর তাতে ক্রিকেট ইতিহাসের সফলতম অধিনায়ক পরিণত হয়েছেন খলনায়কে।

মোহাম্মদ আশরাফুল

বাংলাদেশ ক্রিকেটের এক সম্ভাবনাময় তরুণের অকাল প্রয়াণ মোহাম্মদ আশরাফুল। অথচ, বাংলাদেশের ক্রিকেটে তখনো তারকা খ্যাতি অর্জন করতে পারে এমন ক্রিকেটার জন্মায়নি। সেই আশরাফুল ১৭ বছর বয়সে বাংলাদেশের ক্রিকেটে পা রেকেই অভিষেক টেস্টে হাঁকিয়ে বসলেন সেঞ্চুরি। সেঞ্চুরি হাঁকিয়ে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে দেওয়ার কীর্তি গড়ে দেখালেন তাদেরেই মাটিতে। বিশ্ব পেল এক প্রতিভাবান তরুণ ক্রিকেটারকে। যে বাংলাদেশের তথাকথিত ক্রিকেট ছেড়ে বেরিয়ে গ্লোবাল আইকন হতে জানেন।

অথচ, সেই দারুণ সম্ভাবনাময় আশরাফুল নিজের ক্রিকেট ক্যারিয়ারটাকে শেষ করলেন নিজের হাতেই। বিপিএলের দ্বিতীয় আসরে স্পট ফিক্সিংয়ের সঙ্গে জড়িয়ে পড়লেন। আশরাফুলের এমন কাণ্ড তখন হইচই ফেলে দিল দেশে। অভিযোগের সত্যতা স্বীকার করলেন আশরাফুল। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) কর্তৃক গঠিত ট্রাইব্যুনাল ফিক্সিংয়ের সঙ্গে জড়িত থাকার অপরাধে তাকে সব ধরনের ক্রিকেট থেকে প্রথমে আট বছরের জন্য, পরে সেটা কমিয়ে ৫ বছরের জন্য নিষিদ্ধ ঘোষণা করল। সেই শাস্তি শেষ হলেও আশরাফুল আর ফিরতে পারলেন না জাতীয় দলে। তারকাখ্যাতি পাওয়া আশরাফুল দর্শকদের কাছে হয়ে গেলেন এক আফসোসের নাম।

আকিভ জাভেদ

ক্রিকেটে ফিক্সিং কেলেঙ্কারির প্রসঙ্গ উঠলে সেখানে অবধারিতভাবেই আসে পাকিস্তানি ক্রিকেটারদের নাম। পাকিস্তানের বর্তমান কোচ আকিভ জাভেদ যার শুরুর দিকের শিকার। ১৯৮৯ সালে পাকিস্তানের হয়ে ক্যারিয়ার শুরু করা এই পেসার ইমরান খানের দলের হয়ে বিশ্বকাপ জেতার কীর্তিও অর্জন করেছেন। তবে তার নামের সঙ্গে আজও জড়িয়ে আছে ফিক্সিংয়ে জড়ানোর তকমা। যদিও আকিভ কখনোই বিষয়টি স্বীকার করেননি। তবে তিনি জানিয়েছেন ১৯৯০ দশকে পাকিস্তানি ক্রিকেটারদের ফিক্সিংয়ে জড়িত থাকার পেছনে জড়িয়ে আছে ভারত।

ফিক্সিংয়ে জড়ানো থেকে নিজেকে দূরে রাখতে চেয়েছিলেন বলেই তার ক্যারিয়ার শেষ হয়ে গিয়েছিল এমন অভিযোগও করেছেন তিনি। যেখানে তিনি বলেছেন, ‘ক্রিকেটারদের বিশাল গাড়ি এবং লক্ষ লক্ষ টাকা তুলে দেওয়া হতো। আমাকেও ম্যাচ ফিক্স করতেও বলা হয়েছিল এবং বলা হয়েছিল আমি সেটা না করলে আমার ক্যারিয়ার শেষ হয়ে যাবে। পরে ফিক্সিংয়ের বিষয়ে আমি শক্ত অবস্থান নিয়েছিলাম। এটি আমার ক্যারিয়ারকে ছোট করেছে।’ ১৯৯৮ সালে পাকিস্তানের হয়ে শেষ আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলার আগে ১৬৩টি ওয়ানডেতে তার উইকেট সংখ্যা ১৮২।

মোহাম্মদ আসিফ

ওয়াসিম-ওয়াকার পরবর্তী যুগে যেই পেসারের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সম্ভাবনা দেখা গিয়েছিল সেই তারুণের নাম মোহাম্মদ আসিফ। যে ক্রিকেটে এসে রাতারাতি তারকা খ্যাতি পেয়েছিলেন। তবে তার শেষটা হয়েছে ঘৃণার মধ্য দিয়ে। ক্রিকেটের পবিত্র মক্কা খ্যাত লর্ডসে ফিক্সিং কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে নিজেকেই কুলষিত করেছেন আসিফ। অথচ, ২৩ টেস্টে ১০৬ উইকেট নিয়ে বিশ্ব ক্রিকেটেই সাড়া ফেলে দিয়েছেন তিনি।

অভিষেকের পর দুদিকে সমানভাবে বল সুইং করাতে পারতেন বলে ব্যাটারদের কাছে আসিফ হয়ে উঠেছিলেন এক ত্রাসের নাম। কিন্তু নিজেকে সেভাবে ধরে রাখতে পারেননি তিনি। ক্যারিয়ারের পুরটা সময়জুড়ে বিতর্ক ছিল তার সঙ্গী। ২০০৬ সালে নিষিদ্ধ ড্রাগ নেওয়ার কারণে ২ বছরের জন্য নিষেধাজ্ঞায় পড়েন তিনি। তবে সেই নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে ফিরলেও পরবর্তীতে জড়িয়ে পড়েন ম্যাচ ফিক্সিং কেলেঙ্কারিতে। জুয়ারি মাজহার মাজিদের প্রি-প্ল্যানড ট্র্যাপে পা দিয়ে লর্ডস টেস্টে নো বল করেন তিনি। একই ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে শাস্তি পান সে সময়কার পাকিস্তানের অধিনায়ক সালমান বাট ও মোহাম্মদ আমির। ওখানেই ক্যারিয়ার শেষ হয়ে যায় মোহাম্মদ আসিফের। ক্রিকেটপ্রেমিদের কাছে আজও খলনায়ক হিসেবেই রয়ে গেছেন আসিফ।

প্রবাস বাংলা ভয়েস /ঢাকা/ ০৪ মার্চ ২০২৫ /এমএম