বাংলানিউজসিএ ডেস্ক :: গাছ মানুষের কাছে বন্ধু হিসেবে পরিচিত, পরিচিত ফুসফুস হিসেবেও। গাছের প্রাণ আছে সেটি যেমন প্রমাণিত, তেমনই প্রমাণিত গাছ দিতে জানে, নিতে জানে না। প্রশ্ন হচ্ছে, তাহলে গাছের সঙ্গে আমাদের বৈরী আচরণ কেন! কারো সঙ্গে শত্রুতা আছে রাতের আঁধারে গাছ কেটে ফেল। যানবাহন চলাচলের পথে গাছের শিকড়-বাকড় বাধা হয়ে দাঁড়িছে পুরো গাছ কেটে ফেল। আসবাবপত্রের প্রয়োজনে যেখানে একটি গাছ নিধন করলেই যথেষ্ট সেখানে আরো একটি গাছ কেটে ফেল। দূর পাহাড় কিংবা বন-বনানীর গাছ কেটে এনে ইটের ভাটায় ফেল।
এ হচ্ছে আমাদের গাছপ্রীতি! যা প্রাত্যহিক ঘটনা। যেখানে একটি গাছ কাটলে তিনটি লাগানোর পরামর্শ দেয়া আছে, সেখানে সম্পূর্ণ উল্টোটি লক্ষ করছি আমরা। ফলে মনে হচ্ছে গাছের প্রতি আমাদের মমতা মুখে মুখেই রয়েছে! তবে সবাই যে অমন তাও কিন্তু নয়। আবার অনেকের ইচ্ছে আছে গাছ লাগানোর, কিন্তু তার জমি নেই। সেই বিষয়টি নিয়েই আমাদের আজকের আলোচনা। তার আগে আমরা গাছ বিতরণের কিছু খণ্ডচিত্র তুলে ধরছি।
বর্ষা মৌসুম ঘনিয়ে এলে আমরা দেখতে পাই বিভিন্ন সংগঠনের উদ্যোগে গাছের চারা বিতরণ করা হয় স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীর মাঝে। বিতরণ করা হয় গৃহস্থ কিংবা কৃষকদের মাঝেও। দুঃখজনক হলেও সত্যি, আমরা দেখেছি গ্রামাঞ্চলের চেয়ে মফস্বলে বেশি গাছের চারা বিতরণ করা হয়। ক্যামেরার দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য হয়তো বা। তথাপিও বলতে হয়, নিঃসন্দেহে এটি একটি ভালো উদ্যোগ। তবে বিতরণ পদ্ধতিতে কিছুটা পরিবর্তন আনা আবশ্যক। বিষয়টি পরিষ্কার করে বলছি।
গ্রামাঞ্চল ব্যতীত আমাদের দেশের মফস্বল শহরের অধিকাংশ শিক্ষার্থীর অভিভাবকদেরকে ভাড়া বাড়িতে থাকতে হয়। এ ছাড়াও যিনি মফস্বলের স্থায়ী বাসিন্দা তার জমি-জমাও সীমিত। কারণ গ্রামের তুলনায় মফস্বলের জমির দাম অনেকটাই বেশি বিধায় এখানকার অধিবাসীদের জমির পরিমাণও কম। ফলে অনেক স্থানীয়দেরকেও ভাড়া বাড়িতে কাটাতে হয়।
এখন কথা হচ্ছে, যে শিক্ষার্থীর বাবা ভাড়া বাড়িতে থাকেন, তাকে যদি স্কুল-কলেজ থেকে একটি গাছের চারা উপহার দেয়া হয়, সে শিক্ষার্থী কি চারাটিকে সঠিকভাবে সৎকার করতে পারবেন! নিশ্চয়ই না। তাহলে উপহার পাওয়া ওই গাছের চারাটির স্থান কোথায় হবে? বারান্দা অথবা চিলেকোঠার ঘুপচিতে নিশ্চয়ই। অথবা অতি উৎসাহী শিক্ষার্থীরা টবে লাগিয়ে দু’চারদিন পানি ঢেলে পরিশেষে বারান্দায় ফেলে রাখবে। তার পর একদিন শিক্ষার্থীর মায়েরা মরা গাছের চারাটি বাড়ির ঝি’কে ফেলে দেয়ার নির্দেশ দিবেন।
তাহলে বিষয়টি কি দাঁড়িয়েছে? গাছের চারা বিতরণ হয়েছে ঠিকই, কিন্তু বনায়ন সৃষ্টি হয়নি। যদি চারার সঠিক সৎকার হতো, তাহলে অবশ্যই এত বছরে সমস্ত দেশ সবুজ সমারোহে পরিণত হতো। কিন্তু সে পরিমাণে বনায়ন সৃষ্টি হচ্ছে না, যে হারে চারা বিতরণ করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে আমাদের পরামর্শ, হাজার কিংবা লাখ চারা বিতরণের প্রয়োজন নেই বরং স্বল্প সংখ্যক চারা বিতরণ করে তা রোপণ নিশ্চিত করতে হবে। সেক্ষেত্রে আমরা নির্ধারিত কিছু জায়গা বেছে নিতে পারি। তাতে করে বৃক্ষরোপণ অভিযান সফল হবে। যেমন সরকারের প্রচুর খাস জমি রয়েছে। খালপাড়, নদীরপাড়, রাস্তার দু’পাশ, রেল লাইনের দু’পাশ এসব জায়গা পড়ে আছে। পতিত এ স্থানগুলোকে আমরা অগ্রাধিকার দিতে পারি। শিক্ষার্থীদের মাঝে গাছের চারা বিতরণ করলে চিহ্নিত স্থানে রোপণের পরামর্শ দিতে পারি। প্রয়োজনে বনায়ন সৃষ্টিতে শিক্ষার্থীদের ভূমিকা বাধ্যতামূলক করতে পারি। সেক্ষেত্রে অবশ্যই তাদেরকে ভূমির ব্যবস্থা করে দিতে হবে আগে।
আমরা জেনেছি, ফিলিপাইনে শিক্ষার্থীদের ব্যবহারিক কাজের অংশ হিসেবে বনায়ন সৃষ্টি বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। তারা শুধু গাছ লাগিয়ে নাম্বার পেয়ে যাবে তা নয়, গাছের পরিচর্যা করে দেখাতে হবে শিক্ষককে, তবে নাম্বার মিলবে। ইচ্ছে করলে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে এ ধরনের বিষয় জুড়ে দেয়া যেতে পারে। যেমন জুড়ে দেয়া আছে গার্হস্থ্যবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে।
আর হ্যাঁ, অবশ্যই শিক্ষার্থীদের মাঝেই নয় শুধু, কৃষক কিংবা গৃহস্থদের মাঝেও বিতরণ করতে হবে। এ ছাড়াও সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে বিতরণ করা যেতে পারে। পাশাপাশি কাউন্সিলিং করতে হবে বেশি বেশি। আমজনতাকে বুঝাতে হবে গাছের গুরুত্ব সম্পর্কে। মরুকরণ রোধে গাছের ভ‚মিকা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা দিতে হবে। ধারণা দিতে হবে ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে আমাদেরকে গাছ কিভাবে আগলে রাখে সেটিও। গাছ থেকে আমরা অক্সিজেন পাচ্ছি সত্যি। কি পরিমাণে পাচ্ছি? তার ক্রয়মূল্য সম্পর্কে ধারণা দিতে হবে। গাছের ঔষধি গুণ সম্পর্কেও জানান দিতে হবে। তাতে করে বনায়ন সৃষ্টির সমূহ সম্ভাবনা বেড়ে যাবে যেমন, তেমন সফল হবে বৃক্ষ রোপণ অভিযানও। গাছের চারা বিতরণ করেন এমন সামাজিক সংগঠনগুলোর প্রতি আমাদের অনুরোধ বিষয়টি
নিয়ে ভাবার।
আরেকটি বিষয় হচ্ছে চারা রোপণ করে রক্ষণাবেক্ষণ করা, যা অতীব গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। আমরা লক্ষ্য করেছি কোনো কোনো সংগঠন রাস্তার পাশে শত-হাজার গাছের চারা রোপণ করছেন প্রতি বছর। কিন্তু মাসখানেক যেতে না যেতেই দেখছি গাছের চারাটি গবাদিপশু কর্তৃক নির্যাতিত হয়েছে কিংবা পানিশূন্যতায় গাছটি অকালে মরে গেছে। তাহলে বিষয়টি কি দাঁড়িয়েছে! ফি বছর একই স্থানে আরেকটি চারা রোপণ করতে হচ্ছে।
আমরা যদি এসব বিষয় মেনে গাছের চারা রোপণ করি তাহলে স্বল্প সময়ের মধ্যে সমগ্র দেশে ব্যাপক বনায়ন সৃষ্টি হবে। আর এ সামান্য নিয়ম নীতি মেনে চলতে পারলেই আমরা পাব নির্ভেজাল অক্সিজেন ফ্যাক্টরি। তবে সার্থক হবে আমাদের বৃক্ষরোপণ অভিযানও। -লেখক: কথাসাহিত্যিক, কলামিস্ট ও বন্যপ্রাণী বিশারদ
বাংলানিউজসিএ/ঢাকা/ ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৯/ এমএম