প্রবাস বাংলা ভয়েস ডেস্ক :: ২১ আগস্ট গভীর রাতে রাস্তা থেকে হঠাৎ শোরগোল ভেসে আসতে থাকল। তার সঙ্গে এলাকার নাইটগার্ডদের হুইসেলও শোনা যাচ্ছিল। ভাবলাম রাতে দলবেঁধে পাহারারত পাড়ার ছেলেরা মিলে হয়তো চোর-ডাকাত কাউকে ধরে ফেলেছে। কৌতূহলবশত পড়াশোনা বন্ধ করে বারান্দায় গিয়ে শব্দগুলোর অর্থ অনুধাবন করার চেষ্টা করলাম। পরক্ষণেই বুঝলাম, এগুলো কোনো মিছিলের সাধারণ শব্দ বা গৎবাঁধা দাবির আর্জি নয়। বিশেষ কোনো দাবি আদায়ের জন্য সমস্বরে হুংকার দিয়ে শিক্ষার্থীরা ক্রমাগত সামনে এগিয়ে যাচ্ছিল। গভীর রাতে ছাদ থেকে দেখা অবিশ্বাস্য সাহসীদের হঠাৎ এত লম্বা মিছিল চোখে পড়েনি। পরে জানা গেল, ভারতের একতরফা বাঁধ খুলে দেওয়ার প্রতিবাদে এ মিছিল।
পরদিন টিভি চ্যানেলে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে একজন উপদেষ্টা বলেছেন, ‘আগাম সতর্ক না করে বাঁধের গেট খুলে দেওয়া অমানবিক হয়েছে।’ রাতে দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় জেলাগুলোতে হুহু করে ঢুকে পড়া বন্যার পানিতে হঠাৎ ডুবে যাওয়া মানুষের কান্নার আওয়াজ কোটি শিক্ষার্থী-জনতার মাঝে ছড়িয়ে পড়ে, প্রতিবাদে ফেটে পড়েছিল সবাই। বিগত বহু বছর ধরে তিস্তা, ফারাক্কা, টিপাইমুখ ইত্যাদি বাঁধের অভিজ্ঞতায় বাংলাদেশের প্রবঞ্চিত মানুষ আর কোনো প্রবঞ্চনার শিকার হতে চায় না। তাই তারা রাতের আঁধারে গর্জে উঠতে দেরি করেনি।
প্রতিবেশী দেশের কর্তৃপক্ষ কালবিলম্ব না করে তার পরদিনই জানিয়ে দিয়েছে, তারা ত্রিপুরার ডম্বুর বাঁধ খুলে দেয়নি। পানির চাপ বেশি হওয়ায় বাঁধের কপাট নিজে থেকেই খুলে গেছে! এ ঘটনার সত্যাসত্য যাচাই করার সময় তখন ছিল না। জি-নিউজ, স্ক্রল ডটকমসহ বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে জানা গেছে, ২১ আগস্ট সকাল ৮.৩৫ মিনিটে ত্রিপুরার একজন ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে ডুম্বুর জলবিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্পের বাঁধের কপাট খুলে দেওয়া হয়। ১৯৭৪ সালে নির্মিত পুরোনো এ জলবিদ্যুৎ প্রকল্পটির ধারণক্ষমতার বেশি পানি জমা হওয়ায় ধসে পড়ার আশঙ্কায় বিপৎসংকেত না জানিয়ে হঠাৎ করে গেট খুলে দেওয়া হয়; কিন্তু ভারতীয় সরকারি গণমাধ্যমে গেট খুলে দেওয়ার কথা অস্বীকার করেছিল।
ফেনী, নোয়াখালী, কুমিল্লা ও চট্টগ্রাম এলাকার চলতি বন্যার বৈশিষ্ট্য হলো, হঠাৎ প্রবল স্রোতের তোড়ে সবকিছু ডুবিয়ে-ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়া। তবে প্রবল এ স্রোতের গতি বলে দিচ্ছে, এগুলো ড্যামের গেট খুলে দেওয়া অগাধ পানি। কারণ, উজানে গত এক সপ্তাহে এত বেশি পরিমাণ বৃষ্টির পানির রেকর্ড নেই! ডম্বুর বাঁধের ছেড়ে দেওয়া পানি এ আকস্মিক বন্যার মূল কারণ। এ মনুষ্যসৃষ্ট বন্যাকে অনেক বিশেষজ্ঞও সম্পূর্ণ অস্বাভাবিক বলে অভিহিত করেছেন।
বাস্তবতা হলো, বন্যায় দেশের ১২ জেলার মানুষের ঘরবাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, গবাদিপশু, হাঁস-মুরগির খামার, ফসলি মাঠ, মাছের পুকুর গভীর পানির নিচে ডুবে গেছে। বিদ্যুৎহীন হয়ে পড়েছে গোটা বন্যাক্রান্ত এলাকা। সারা দেশের সঙ্গে যোগাযাগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ায় উদ্ধারকারী দল দ্রুত সেখানে পৌঁছাতে ব্যর্থ হয়েছে। ঢলের পানির তোড়ের আকস্মিকতায় হতভম্ব মানুষ যে যেটা পারেন, হাতে নিয়েও ঘরের বাইরে বেরিয়ে যেতে পারেননি। কারণ, চারদিকে শুধু পানি আর পানি। জীবনের নিরাপত্তার জন্য শুকনো জায়গা খুঁজে না পেয়ে অনেকে শুধু কান্নাকাটি করছিলেন। আশপাশের স্কুল, কলেজ ভবন ও বহুতল পাকা বাড়ি হাতেগোনা। সেগুলোর নিচতলা জলমগ্ন। উপরে বা ছাদে এত বন্যাক্রান্ত মানুষের ঠাঁই দেওয়া যাচ্ছে না। তাদের কান্না শোনার মতো দরদি কেউ সেখানে ছিল না।
এতটা আতঙ্কাবস্থা তৈরি হয়েছে, ৩০ ঘণ্টা পরেও এসব জায়গায় হুহু করে পানি ঢোকা অব্যাহত ছিল। ফেনীর দাগনভূঁইয়া, ছাগলনাইয়া, কুমিল্লার বুড়িচং, চট্টগ্রামের মিরসরাই এলাকার সব জায়গায় শুধু থইথই পানি। এসব এলাকায় গ্রাম, শহর, নগর, পুকুর, মাঠ আলাদা করে চিহ্নিত করা যাচ্ছিল না। কিছু কিছু জায়গায় সেনা, নৌ, বিমানবাহিনীর সঙ্গে অন্যান্য সংস্থার সাহায্যকারীরা উদ্ধার কাজ শুরু করেছেন। তবে কোথাও কোথাও রাতে হেলিকপ্টার দিয়ে শুকনো খাবার ছুড়ে দিয়ে এবং পানিবন্দি মানুষকে উদ্ধার করতে দেখা গেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে কেন্দ্র বানিয়ে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়কদের আহ্বানে বিপুল পরিমাণ অর্থ ও ত্রাণসামগ্রী সংগ্রহ করার ব্যবস্থা হয়েছে এবং সেগুলো উপদ্রুত এলাকায় দ্রুত পাঠানো শুরু হয়েছে।
কথা হলো, এ বন্যার দায় কার? এ বছরের শুরু থেকে মাত্র আট মাসে সিলেট বিভাগে সাতবার বন্যা হয়েছে। তিস্তা এলাকায় গত বছর আটবার বন্যা হয়েছে। সেখানে গেল চৈত্র মাসেও প্রবল ফ্লাশ-ফ্লাড হয়ে মানুষের আলু, গম, পেঁয়াজ, রসুন, মিষ্টি কুমড়া, চিনাবাদামসহ উঠতি ফসলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। তিস্তাপারের দরিদ্র কৃষকের আরও হতদরিদ্র বানানোর জন্য দায়ী এসব ফ্লাশ-ফ্লাড। এর দায় ও দরিদ্র প্রান্তিক কৃষকের ঋণের বোঝা শোধ করার দায়ই বা কে নিতে এগিয়ে আসবে?
এসব হঠাৎ বন্যাসৃষ্ট ক্ষয়ক্ষতির দায় অনেক। সীমান্তের ওপার থেকে নেমে আসা ঢলে প্রতিবছর হঠাৎ হাজির হয় এ বন্যা। যার কারণে, কান্না থামার আগেই শুরু হয় নতুন কান্না। যুগ যুগ এর কোনো প্রতিকার দেখা যায় না। তিস্তা ছাড়াও বিশেষ করে ফেনী ও কুমিল্লা জেলার মানুষ গত ৪০ বছরেও এত পানির তোড় দেখেনি। ঢলের পানি তাদের বাড়িঘর ডুবিয়ে দেবে, এমন কল্পনাও করেননি অনেকে। দৈত্যের মতো ছুটে আসা ঢলের তোড়ের কথা তারা ভাবতেও পারেননি। মূল্যবান জিনিস কিছুই সরাতে না পারায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কতটা বেড়েছে, সেটি এখনই অনুমান করা কঠিন।
ফেনী জেলার উজান উঁচু; কিন্তু নিম্নাঞ্চল সমুদ্রের সমতল তটরেখা স্পর্শ করে আছে। উজানের ঢল সন্দ্বীপ ও এর সংলগ্ন উড়ির চর, দুবলার চরের মানুষ সম্পূর্ণরূপে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছেন। উপকূলীয় এলাকায় তাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, আবাদ সবকিছু ভেসে গেছে। তাই উজানের যে কোনো ব্যারাজের গেট খুলে দেওয়ার আগে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করা প্রয়োজন। ভারতের আসাম, ত্রিপুরা, মিজোরামে অতিবৃষ্টি হলে তার আগাম তথ্য ও সতর্কবার্তা দ্রুত বাংলাদেশে না পৌঁছালে, ঘটতে পারে বড় বিপর্যয়।
প্রতিবেশী দেশ এদেশের উজানের নদীগুলোতে কমপক্ষে ত্রিশটি বড়-ছোট বাঁধ দিয়ে পানি আটকিয়ে একচেটিয়া ব্যবহার করে আসছে। যেটি আন্তর্জাতিক নদী আইনের চরম লঙ্ঘন। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে মিঠাপানির উৎসকে এককভাবে আটকিয়ে ভোগ করার প্রবণতা লক্ষণীয়। এমনকি একটি দেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন প্রদেশ ও জেলার মধ্যেও নদীর পানিবণ্টন নিয়ে কলহ বিদ্যমান রয়েছে। ভারতের গঙ্গা, নর্মদা ও জাপানের তোনেগাওয়া নদীর পানিবণ্টন নিয়ে অতীতে বিভিন্ন প্রদেশ, জেলার মধ্যে নানা যুদ্ধের কথা জানা যায়। এসব পানিযুদ্ধের রকমফের ভুগিয়েছে অপেক্ষাকৃত দুর্বল অঞ্চলের শাসকদের। কিন্তু ভারতের হিসাবটা ইউনিক ও অমানবিক। এগুলোকে পানিসন্ত্রাস, বন্যাদস্যুতা, পানিবৈষম্য হিসাবে আখ্যায়িত করে অনেক গবেষণা হয়েছে, লেখা হয়েছে অনেক পিএইচডি থিসিস। কিন্তু এসব পানিবণ্টন সমস্যার যৌক্তিক সমাধান হয়েছে খুব কম অথবা মোটেও হয়নি। যেমন : ইউফ্রেটিস ও আমাদের তিস্তা সমস্যা।
বন্যা বন্ধ হোক বললেই বন্যা বন্ধ হয় না। বন্যা থেকে সৃষ্ট নদীভাঙনের জন্য প্রতিবাদস্বরূপ তৈরি মানববন্ধন ও লেখা ব্যানারের ভাষা নদীগুলো পড়তে জানে না। নদীতীরের মানুষের সবাই সেটা বুঝে না। এজন্য রাষ্ট্রীয় কমিটমেন্টকে কাজে লাগাতে হয়। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়কদের আহ্বানে দশ মিনিটে যে কোনো প্রতিবাদে ঝাঁপিয়ে পড়ার যে উদাহরণ সৃষ্টি হয়েছে, তাতে দেশে-বিদেশে আমাদের আন্তর্জাতিক নদীর পানিবণ্টন সমস্যার বৈষম্যগুলোর কথাও ছড়িয়ে পড়েছে দিকে দিকে। সারা পৃথিবী নতুন করে জেনে ফেলেছে, আমরা বাংলাদেশিরা প্রতিবেশী দেশের কাছ থেকে চরম পানিসন্ত্রাসের শিকার। এ পানিবৈষম্য আমাদের কৃষি, যোগাযোগ, মৎস্য, ব্যবসা-বাণিজ্য, সুন্দরবন-সবকিছুর ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে আসছে। তিস্তা ক্যাচমেন্ট এলাকার কৃষকের আরও দরিদ্র হওয়ার কারণ, উজানের দেশের বাঁধসন্ত্রাস ও পানিবৈষম্য।
শিক্ষার্থীরা গত বায়ান্ন বছরে এসবের কড়া প্রতিবাদ করতে পারেনি। নিজেদের একতা না থাকায় তারা প্রতিবাদ করার পরিবেশ পায়নি। তারা এতদিন সংগঠিত হতে পারেনি, উপযুক্ত নেতৃত্বও খুঁজে পায়নি। এখন বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্বের মাধ্যমে দেশি-বিদেশি সব ধরনের বৈষম্য থেকে বাংলাদেশ অচিরেই মুক্তি পাওয়ার পথ খুঁজে পাক, এই প্রত্যাশা।
ড. মো. ফখরুল ইসলাম : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন
প্রবাস বাংলা ভয়েস /ঢাকা/ ২৬ আগস্ট ২০২৪ /এমএম