প্রবাস বাংলা ভয়েস ডেস্ক :: বাংলাদেশে পর্যটন শিল্পের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ২০ লাখেরও বেশি মানুষ জড়িত। পর্যটন শিল্পের প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে দেশে। গভীর রাতেও পর্যটকরা সৈকতে যেতে পারছে। ট্যুরিস্ট পুলিশের কারণে তারা আশ্বস্ত, সমুদ্রসৈকতে কোনো সমস্যা নেই। যে কোনো সময় সৈকতে গেলে ট্যুরিস্ট পুলিশ দেখা যায়। পর্যটনের উন্নয়ন ও পর্যটকদের সার্বিক নিরাপত্তায় ট্যুরিস্ট পুলিশ সৈকতজুড়ে সিসি ক্যামেরা স্থাপন করেছে, যা ট্যুরিস্ট পুলিশের প্রধান কার্যালয় থেকে সরাসরি মনিটরিং করা হচ্ছে। সৈকতে তাকালেই ট্যুরিস্ট পুলিশ দেখা যায়-এতে অনেক পর্যটক নিজেদের নিরাপদ মনে করে। বেশকিছু প্রশ্ন আমাদের ভাবিয়ে তুলছে, যা থেকে পরিত্রাণ জরুরি।
পর্যটনের উন্নয়নের জন্য উপযুক্ত পরিকল্পনা থাকা জরুরি। পর্যটনের উন্নয়নের জন্য চোখে পড়ার মতো মহাপরিকল্পনা দরকার। পর্যটনের উন্নয়নের জন্য মন্ত্রণালয়, পর্যটন করপোরেশন, ট্যুরিস্ট পুলিশ, পর্যটন বোর্ড-সবার সমন্বিত পদক্ষেপ দরকার। খাদ্য, স্বাস্থ্য, বস্ত্র, স্থান, ডিজিটাল সিটি, পর্যাপ্ত নিরাপত্তা, ট্রাফিক, পরিবহণ সুবিধা-এসব একটা পর্যটন স্থানে পর্যাপ্ত পরিমাণে থাকা জরুরি। এসব বিষয়ে গুণগত মানের বিষয়টিও জড়িত। সারা দেশে ট্যুরিস্ট স্পট বাড়ছে। আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি পর্যটনকেন্দ্রিক হওয়া দরকার। হোটেল মালিককে লক্ষ রাখতে হবে কারা স্পা ব্যবসা করে। অভিযোগ রয়েছে, বাইরে থেকে তালাবদ্ধ অথচ সুড়ঙ্গ রুমে- গর্তের মধ্যে স্পা ব্যবসা চলছে। কোনো কোনো পর্যটক হয়রানির অভিযোগও করেন এসব বিষয়ে সতর্কতা অবলম্বন করা দরকার। স্পা সাইনবোর্ড নিয়ে কেউ অবৈধ কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে কিনা তা খতিয়ে দেখা দরকার। কিশোর গ্যাং ও ইভটিজিং এসব সমস্যা চিরতরে বন্ধ করতে হবে। অভিযোগ রয়েছে, কোনো কোনো স্থানে খুব সকালের দিকে ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। মনে রাখতে হবে, পর্যটকরা হয়রানির শিকার হলে পর্যটন শিল্পের উন্নয়ন হবে না।
একজন পর্যটন ব্যবসায়ী বলেছিলেন, ‘আমি যখন আমাকে পর্যটক হিসাবে চিন্তা করব, তখন অন্যের সমস্যা বুঝতে পারব। যে এলাকায় যাব, পরিবারের নিরাপত্তা বা অর্থ নিয়ে ফিরে আসতে পারব কিনা। পুরো দেশ সৈকতের দিকে তাকিয়ে থাকে। ট্যুরিস্ট পুলিশ আসার পর থেকে অপরাধীকে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে। এটি ভালো দৃষ্টান্ত। ২২ বছর ধরে পর্যটকের টাকায় আমার সংসার চলে। নিজেকে নিজের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হবে। তাহলে পর্যটন শিল্পের কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন সম্ভব হবে’। এ বোধ সবার মধ্যে থাকতে হবে। শত কিলোমিটারেরও বেশি বিস্তৃত সমুদ্রসৈকত অথচ ১০-২০ কিলোমিটার ব্যবহৃত হচ্ছে। সুষ্ঠু পরিকল্পনার মাধ্যমে সাব/ওয়াকওয়ে করতে হবে। শুঁটকি পল্লি সরাতে হবে। টমটম পর্যটককে নিয়ে টানাটানি করে। তাদের পছন্দ মতো হোটেলে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। কারণ তারা কমিশন পায়। বিমান ও ট্রেনের টিকিট-বড় সমস্যা। কারসাজি করে যেন হঠাৎ বিমানের টিকিটের দাম বাড়ানো না হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে। মেরিন ড্রাইভ নিয়ে মহাপরিকল্পনা হতে পারে। সেন্টমার্টিনের মতো সোনাদিয়া দ্বীপও গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া দরকার। পরিকল্পনামাফিক সোনাদিয়া দ্বীপকে পর্যটন স্পট হিসাবে গড়ে তোলা সময়ের দাবি।
কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত টোকাইমুক্ত করা দরকার। পর্যটকের চাপ বাড়লে, হোটেল ভাড়া কেন বেড়ে যায়? বিদেশি পর্যটক নিয়ে ভাবতে হবে। বিদেশি পর্যটকদের আগ্রহ বাড়ানোর জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে হবে। উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা পর্যটনে প্রভাব ফেলবে। পর্যটকদের মেহমানদারি করার জন্য স্থানীয় জনগোষ্ঠীর মানসিকতা থাকতে হবে। কিছু হোটেল মালিক দালাল রাখে, যা টেকসই পর্যটনের বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করছে। ফুটপাত দখল হয়ে যায়। ফুটপাত অবমুক্ত করতে হবে। কোনো এলাকার সামগ্রিক পরিবেশও পর্যটনে প্রভাব ফেলে।
পর্যটনের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট এলাকায় নিরাপত্তাও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কিছু সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও অনেক ভালো দৃষ্টান্তও রয়েছে কক্সবাজারে। পরিকল্পিত ট্রাফিক ব্যবস্থা রয়েছে সৈকত এলাকায়। সরকারি-বেসরকারি উদ্যাগে আরও সমন্বিত পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। সিসি ক্যামেরার সেবার আওতা আরও বাড়াতে হবে।। রাস্তার দু’পাশে ভ্রাম্যমাণ অবৈধ হকার উচ্ছেদ করা জরুরি। সমুদ্রের মধ্যে লেজার শো হতে পারে। বিনিয়োগের নিশ্চয়তা দরকার। সৈকতে যত্রতত্র ময়লা-আবর্জনার উপস্থিতির কথাও জানা যায়। কক্সবাজারে আইকনিক রেলস্টেশন চালু হয়েছে। ব্রিজ হচ্ছে, পর্যটনের প্রসার হবে। আন্তর্জাতিক এয়ারপোর্ট চালু হয়েছে। বিদেশি পর্যটক আসবে। আমাদের সেবা দেওয়ার মানসিকতাও তৈরি করতে হবে।
ছয়. নেপালে পর্যটনকে অত্যন্ত গুরুত্ব দেওয়া হয়। আমাদেরও নেপালের মতো প্রশিক্ষণ দরকার; আন্তরিকতা দরকার। কক্সবাজারে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় রিফিউজি ক্যাম্প রয়েছে। এটি পর্যটনের জন্য হুমকি সৃষ্টি করতে পারে। রোহিঙ্গা সমস্যা পর্যটনের উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত করতে পারে। রোহিঙ্গা সমস্যার জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সমাধান জরুরি। ইদানীং দেখা যাচ্ছে, ছিন্নমূল মানুষ সৈকতে ঘুরে বেড়ায়। সৈকতের আশপাশে যাতে কোনো রকম অসামাজিক কর্মকাণ্ড চলতে না পারে, সেদিকে কর্তৃপক্ষকে বিশেষ দৃষ্টি দিতে হবে। হোটেলগুলোর চেকআউট ১১টায়। অধিকাংশের ফিরতি বাস রাতে। পর্যটক কোথায় যাবে? লাগেজ কোথায় রাখবে? এসব সমস্যার সমাধানেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে দৃষ্টি দিতে হবে। সৈকতে পর্যটকদের যা যা দরকার, তারা যাতে সব ধরনের সেবা পান, তা নিশ্চিত করা দরকার। পর্যটক হলেন অতিথি। অতিথিকে মর্যাদা দিতে হবে।
পিকনিকের বাস, শিক্ষা সফরের বাস আসে। রিজার্ভ বাস আসে। বাস ঢুকতে না দিলে পর্যটক আসবে না। বাসগুলো পার্কিং করবে কোথায়? কক্সবাজারে ১১ হাজার টমটম, ২০০ ডলফিন গাড়ি রয়েছে। ইচ্ছামতো ভাড়া ধার্য করে তারা পর্যটকদের হয়রানি করে। নেপালের মতো চালক ও পরিবহণ শ্রমিকদের ব্যবহার হতে হবে। চালক ও পরিবহণ শ্রমিকদের প্রশিক্ষণের পাশাপাশি তাদের মধ্যে সচেতনতামূলক কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে হবে। সমুদ্রসৈকতে চলা গাড়ি, মোটরসাইকেল, ঘোড়া, স্পিডবোট-এসবের ভাড়ার ক্ষেত্রে এক ধরনের নৈরাজ্য বিদ্যমান। কেন এটি হচ্ছে? অভিযোগ রয়েছে, পর্যটক যত বাড়ে, খাবারের গুণগতমান তত কমে এবং দাম বেড়ে যায়। অভিযোগ রয়েছে, কক্সবাজারে একসঙ্গে লক্ষাধিক পর্যটক থাকলে খাবার সংকট দেখা দেয়। পর্যটন মৌসুমে স্থানীয়রা নিজেদের ঐতিহ্যবাহী খাবার তৈরি করতে পারে। মন্টিনিগ্রোতে স্থানীয়রা খাবার তৈরি করে। আরও অভিযোগ রয়েছে, অনেক সময় পর্যটক বেড়ে গেলে কোনো কোনো দোকানে পচা ও বাসি খাবার পর্যটকদের খেতে দেওয়া হয়। খেতে না পারলেও দাম নিয়ে নেওয়া হয়। এসব সমস্যার সমাধান জরুরি।
সেন্টমার্টিন ও ইনানি থেকে কেউ যাতে সামুদ্রিক কোরাল নিয়ে যেতে না পারে, সেটি দেখতে হবে। সেন্টমার্টিনে নজরদারি থাকলেও ইনানিতে নজরদারি নেই। সমুদ্রসৈকতে অনেক সময় মৃত ডলফিন, মাছ ও অন্যান্য প্রাণী পড়ে থাকতে দেখা যায়, যা দ্রুত সরানোর ব্যবস্থা থাকা দরকার। গত ১০-২৫ বছরে কক্সবাজারের সমুদ্রসৈকতসংলগ্ন স্থানীয় জীববৈচিত্র্য, সংস্কৃতি ও পরিবেশ ধ্বংস হয়েছে। ঝাউবন কেটে ফেলা হয়েছে। সমুদ্রসৈকতসংলগ্ন অঞ্চলে বিভিন্ন ধরনের বাতি জ্বলে, যা সামুদ্রিক প্রাণীর স্বাভাবিক জীবনযাপন ব্যাহত করছে। সমুদ্রসৈকতসংলগ্ন অঞ্চলের একটি নির্দিষ্ট সীমানা পর্যন্ত কোনো স্থাপনা না থাকার ব্যবস্থা করা জরুরি। নতুন করে অনুমোদন না দেওয়া এবং বিদ্যমান স্থাপনাগুলোও ভেঙে ফেলা জরুরি। হোটেল-মোটেল ও রিসোর্ট-এর কক্ষ, বারান্দা থেকে সৈকত দেখতে পাওয়ার আকর্ষণ তৈরি করতে গিয়ে আমরা অবলীলায় স্থানীয় জীববৈচিত্র্য, সংস্কৃতি ও পরিবেশ ধ্বংস করে ফেলছি; যা কেউ ভাবছি না। মেরিন ড্রাইভের সৈকতসংলগ্ন এলাকায় কোনো ধরনের যেন নতুন স্থাপনা তৈরি না হয়, সে বিষয়ে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। রাতের বেলা সমুদ্রসৈকতসংলগ্ন অঞ্চলের স্থাপনাগুলোতে যেন অধিকমাত্রায় লাইটিং না থাকে এবং রাত ৭-৮টার পরে কোনো উজ্জ্বল বাতি আর না জ্বলে, এমন বিভিন্ন বিষয়ে কঠোর নজরদারি দরকার।
ড. মোহাম্মাদ আনিসুর রহমান : ডিন, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ; সহযোগী অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গোপালগঞ্জ
প্রবাস বাংলা ভয়েস /ঢাকা/ ২৩ জুন ২০২৪ /এমএম