Menu

প্রবাস বাংলা ভয়েস ডেস্ক :: ১৮৫৩ সালে বাণিজ্যিকভাবে প্রথমবারের মতো রেল চলাচল শুরুর মধ্য দিয়ে উপমহাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থায় আসে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। মুম্বাই থেকে বিস্তৃত হয়ে এ রেল নেটওয়ার্ক ক্রমান্বয়ে গোটা ভারতবর্ষে ছড়িয়ে পড়ে, যা সর্বশেষ পূর্ববঙ্গের দোহাজারীতে এসে থামে। ১৮৯০ সালে তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার এ রেলপথকে দোহাজারী থেকে বার্মার (মিয়ানমার) ঘুনধুম পর্যন্ত সম্প্রসারণের উদ্যোগ নেয়। তবে বিশ্বযুদ্ধসহ নানা জটিলতায় সে উদ্যোগ আর বাস্তবায়িত হয়নি। ফলে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার অঞ্চলের পাঁচ প্রজন্ম ১৩৪ বছর ধরে নতুন রেলপথের জন্য অপেক্ষা করেছে। আর দোহাজারী ‘আখেরি রেলস্টেশন’ তকমায় পাড়ি দিতে পারেনি সাঙ্গু নদী।

অবশেষে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০১০ সালে দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয়। প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত এ রেলপথ গত বছরের ১১ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উদ্বোধন করেন। এরপর গত ডিসেম্বরে ঢাকা-কক্সবাজার রুটে ‘কক্সবাজার এক্সপ্রেস’ এবং জানুয়ারিতে ‘পর্যটন এক্সপ্রেস’ নামে দুটি ট্রেন যাত্রী পরিবহণ শুরু করে। তবে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রুটে স্থানীয়দের জন্য কোনো সার্ভিস ছিল না। তাদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে গত ৮ এপ্রিল ঈদুল ফিতর উপলক্ষ্যে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রুটে একটি স্পেশাল ট্রেন চালু করে রেলওয়ে। ট্রেনটি ঈদ স্পেশাল হলেও যাত্রীদের ব্যাপক সাড়ায় দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এবং দফায় দফায় মেয়াদ বাড়িয়ে ১০ জুন পর্যন্ত বাড়ানো হয়। যেখানে বাসে চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার যেতে লাগে ৫ থেকে ৬ ঘণ্টা, সেখানে প্রায় অর্ধেক ভাড়ায় সাড়ে ৩ ঘণ্টায় রেলেই পৌঁছানো যাচ্ছিল। তাছাড়া আরামদায়ক ও নিরাপদ হওয়ায় দ্রুতই জনপ্রিয়তা পায় এ সার্ভিস। বন্ধ হওয়ার আগে মাত্র ৫২ দিনে এ ট্রেন ৫৪ হাজার ৮১৪ জন যাত্রী পরিবহণ করে ১ কোটি ৪ লাখ ৪১ হাজার টাকা আয় করে। দৈনিক আয় ২ লাখ টাকা, যা ২৫ বছর ধরে লোকসানে থাকা রেলওয়ের জন্য সম্ভাবনার বার্তাবাহী। স্পেশাল সার্ভিসটিকে ১০ থেকে ১৮ বগিতে উন্নীত করে স্থায়ী রূপ দিয়ে দিনে দুই ট্রিপ চালানোর উদ্যোগ নেয় রেলওয়ের পূর্বাঞ্চল। এ ব্যাপারে একটি প্রস্তাব রেলওয়ের সদর দফতরে পাঠানো হয়। কিন্তু এরপর ঘটল উলটো ঘটনা।

১৩৪ বছর অপেক্ষায় শুরু হওয়া চট্টগ্রাম-কক্সবাজারবাসীর এ আনন্দযাত্রা স্থায়ী হয়নি ১৩৪ দিনও। ইঞ্জিন ও লোকবল সংকটের অজুহাতে গত ৩০ মে বন্ধ করে দেওয়া হয় স্পেশাল সার্ভিস। অথচ প্রত্যাশা ছিল সিঙ্গেল থেকে ডাবল ট্রিপে প্রতিদিন প্রায় ৩ হাজার যাত্রী পরিবহণের। প্রশ্ন হলো, ১ হাজার ৩৯১ একর জমি ছেড়ে দেওয়া স্থানীয়দের প্রতি কি রেলের কোনো দায় নেই? ১০১ কিলোমিটার রেলপথের ১৫ কিলোমিটার বনভূমিতে পড়ায় পরিবেশ বিপর্যয়ও সামলাতে হবে স্থানীয়দের। এমনকি গত বছর বড় ধরনের বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয় দুই জেলার কয়েক লাখ মানুষ। সেসময় রেললাইনের কারণে বৃষ্টির পানি চলাচল বাধাগ্রস্ত হওয়াকে বন্যার কারণ বলে দাবি করেছিল তারা।

এ প্রকল্প উদ্বোধনকালে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘আমি রেলপথ উদ্বোধন করে আমার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেছি। এটা এ অঞ্চলের দীর্ঘদিনের দাবি ছিল। আজ সেই দাবি পূরণ হয়েছে।’ এখন প্রশ্ন হলো, সরকারপ্রধান যে প্রতিশ্রুতি রক্ষার ঘোষণা দিয়েছেন, তা রেলওয়ে বাস্তবায়ন করছে না কেন? প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা বা অনুশাসন রক্ষা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের দায়িত্ব। সেখানে মৌসুমি পর্যটকদের জন্য স্থায়ী ট্রেন, আর স্থায়ী মানুষদের জন্য মৌসুমি ট্রেনের এমন অদ্ভুত সিদ্ধান্তে স্বভাবতই ক্ষুব্ধ এ অঞ্চলের প্রায় অর্ধকোটি মানুষ, যার প্রভাব লক্ষ করা যাচ্ছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ সর্বত্র। দেশের আর কোনো রুটে স্থানীয়দের প্রতি এমন বৈষম্যমূলক আচরণ করা হয়নি। রেলের শিডিউল বলছে-চট্টগ্রাম থেকে ফেনী, কুমিল্লা, চাঁদপুর, কিশোরগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়াসহ তুলনামূলক কম গুরুত্বপূর্ণ অনেক রুটে একাধিক ট্রেন আছে-যেখানে প্রাধান্য পাচ্ছে সেসব অঞ্চলের বাসিন্দারা।

দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথের পরিপূর্ণ ব্যবহার দৃশ্যমান হওয়ার আগে চট্টগ্রাম থেকে দোহাজারী পর্যন্ত ডুয়েল গেজ রেললাইন নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, যার জন্য বরাদ্দ প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা। সব মিলে প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগের রেলপথে শুধু একজোড়া ট্রেন চালানোটা অতি বিলাসিতা ছাড়া আর কী হতে পারে? এত বড় প্রকল্প ঘিরে পর্যাপ্ত লোকবল ও ইঞ্জিন না থাকার বিষয়টি রেলওয়ের দূরদর্শিতার অভাব নাকি উদাসীনতা, নাকি অন্য কিছু, তা খতিয়ে দেখা উচিত। যে ইঞ্জিন সংকটের ঠুনকো অজুহাতে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার ট্রেন বন্ধ করা হলো, তা কতটা বিশ্বাসযোগ্য? দেশের একটি জাতীয় দৈনিকে ৩ জুন প্রকাশিত প্রতিবেদন বলছে, চট্টগ্রামের পাহাড়তলী ও দিনাজপুরের পার্বতীপুর লোকোশেডে প্রায় ৩০০ কোটি টাকা মূল্যের ১৫টি ইঞ্জিন পড়ে আছে। ইঞ্জিনগুলো সংস্কার করে অনায়াসে এ রুট ও অন্যান্য রুটের সংকট কিছুটা হলেও মেটানো সম্ভব। তাই স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে, এ সংকট কি তাহলে কৃত্রিম?

গত ৩০ জুন গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে যাত্রী কল্যাণ সমিতি দাবি করেছে, বাস মালিকদের সুবিধা দিতেই তাদের ‘প্রেসক্রিপশনে’ হঠাৎ চট্টগ্রাম-কক্সবাজার স্পেশাল সার্ভিস বন্ধ করা হয়েছে। যদিও তাদের এ দাবির পক্ষে কোনো তথ্য-প্রমাণ নেই, তবে স্পেশাল ট্রেন দ্রুত জনপ্রিয়তা পাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে এ রুটের অনেক বাস কোম্পানি তাদের ভাড়া উল্লেখযোগ্য হারে কমিয়ে দেওয়ায় সহজেই অনুমেয় ট্রেনের জনপ্রিয়তা বাস মালিকদের কতটা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ফেলেছে। তবে যাত্রী পরিসংখ্যান বলছে, রেললাইনে যাতায়াত বাড়লেও তা সড়কপথে বড় প্রভাব রাখতে পারবে না। কারণ চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রুটে দৈনিক যাত্রী চাহিদার তুলনায় রেলের সক্ষমতা অনেক কম। সুতরাং কোনো ষড়যন্ত্র তত্ত্ব এখানে টিকবে না। তাই সমস্যাটা রেলের অভ্যন্তরে কিনা সেটিই বরং আলোচনার বিষয় হওয়া উচিত। এত বড় প্রকল্পের কয়েকশ কোটি টাকার ইঞ্জিন কিংবা কয়েকজন লোকো মাস্টারের অভাবে লাখ লাখ মানুষ রেলসেবা বঞ্চিত হতে পারে না।

এদিকে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার স্পেশাল ট্রেন বন্ধে জনসাধারণের ক্ষোভের আগুনে আপাতত পানি ঢেলে ১২ জুন থেকে ঈদুল আজহা উপলক্ষ্যে স্পেশাল সার্ভিসটি দু’সপ্তাহের জন্য আবারও চালু করেছে রেলওয়ে। তার মানে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারবাসী সহসা এ মেগাপ্রকল্পের স্থায়ী সুফল পাচ্ছে না। এ অঞ্চলের মানুষের দাবি রেল ভবনে যে সহসা পৌঁছায় না, তা চট্টগ্রামের ফুসফুসখ্যাত সিআরবিতে বাণিজ্যিক হাসপাতালবিরোধী আন্দোলনের সময়ই বোঝা গেছে, শেষমেশ প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে হাসপাতাল স্থাপনের পরিবেশবিরোধী এ প্রকল্প বাদ দেওয়া হয়। এবারও কি তবে প্রধানমন্ত্রীকেই হস্তক্ষেপ করে রেলকর্তাদের বোঝাতে হবে স্থানীয়দের রেলের প্রয়োজন কতটা? এ অঞ্চলের জনপ্রতিনিধিরা অবশ্য নিজেদের জায়গা থেকে রেলওয়ে কিংবা সরকারের উচ্চ মহলে কথা বলে এ ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন।

স্থানীয়দের দাবি, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রুটে স্থায়ী ট্রেন সার্ভিস চালু করা হোক। পাশাপাশি এ অঞ্চলের সঙ্গে পর্যটন ও বাণিজ্যের প্রসারে সিলেট, উত্তরাঞ্চল, দক্ষিণাঞ্চল এবং দেশের অন্যান্য এলাকার সঙ্গে যাত্রী ও কার্গো সার্ভিস চালু করা জরুরি। এছাড়া মেয়াদোত্তীর্ণ কালুরঘাট সেতুর বদলে নতুন রেল সেতু নির্মাণ, ক্রমবর্ধমান যাত্রী চাহিদা এবং চীনের সঙ্গে ভবিষ্যতে রেল যোগাযোগ স্থাপনের সম্ভাবনা বিবেচনায় চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেলপথকে ডাবল লাইনে উন্নীত করার বিষয়টিও বিবেচনায় নেওয়া যেতে পারে।

ইয়াসির সিলমী : ভারপ্রাপ্ত সভাপতি, সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগ, বিজিসি ট্রাস্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ

প্রবাস বাংলা ভয়েস /ঢাকা/ ১৫ জুন ২০২৪ /এমএম