Menu

প্রবাস বাংলা ভয়েস ডেস্ক :: ফ্লু বা ইনফ্লুয়েঞ্জা একটি ভাইরাসজনিত রোগ। দেশে এপ্রিল ও সেপ্টম্বর (গ্রীষ্ম ও বর্ষা) পর্যন্ত ফ্লু মৌসুম হিসাবে চিহ্নিত। এ সময়ে শ্বাসতন্ত্রের রোগীদের মধ্যে প্রতি চারজনে একজন ইনফ্লুয়েঞ্জায় আক্রান্ত হন। ইনফ্লুয়েঞ্জার কারণে শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ দেখা দেয়। উপযুক্ত চিকিৎসা না করালে রোগীর ফুসফুসে ছড়িয়ে পড়ে। ফ্লু সংক্রমণে গুরুতর অসুস্থ রোগী হাসপাতালে ভর্তি না হলে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।

বুধবার রাজধানীর মহাখালীর রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর) মিলনায়তনে ‘ডেসিমিনেশন সেমিনার অন ইনফ্লুয়েঞ্জ সার্ভিল্যান্স ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক জরিপ ফলাফল প্রকাশ অনুষ্ঠানে এসব তথ্য জানানো হয়। ন্যাশনাল ইনফ্লুয়েঞ্জা সেন্টারের (এনআইসি) অধীনে আইসিডিডিআরবি ও আইইডিসিআর ‘ন্যাশনাল ইনফ্লুয়েঞ্জা সার্ভিল্যান্স ইন বাংলাদেশ (এনআইএসবি) এবং হসপিটাল বেজড ইনফ্লুয়েঞ্জা সার্ভিল্যান্স ইন বাংলাদেশ (এইচবিআইএস)’ যৌথভাবে জরিপ পরিচালনা করে।

সেমিনারে ২০০৭ সাল থেকে বিভিন্ন হাসপাতালে পরিচালিত ইনফ্লুয়েঞ্জা সার্ভিল্যান্স থেকে প্রাপ্ত ফল উপস্থাপন করা হয়। এ সময় জানানো হয়, যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (ইউএস-সিডিসি) এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কারিগরি সহায়তায় এ সার্ভিল্যান্সটি পরিচালিত হয়ে আসছে। বর্তমানে দেশের ১৯টি হাসপাতালে চলমান সার্ভিল্যান্সের মূল লক্ষ্য বাংলাদেশে ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের সংক্রমণ এবং মৌসুমি বৈচিত্র্য বোঝার পাশাপাশি ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের বিভিন্ন ধরন শনাক্ত করা।

বিশেষজ্ঞরা জানান, ফ্লু হলে হঠাৎ করেই তীব্র জ্বর ওঠে, যা ৩ থেকে ৪ দিন মেয়াদি হয়ে থাকে। রোগীর সারা গায়ে এবং মাথায় তীব্র ব্যথা থাকতে পারে। ফ্লুর আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো আক্রান্ত ব্যক্তি প্রচণ্ড ক্লান্তিবোধ করেন এবং তার দৈনন্দিন কর্মকাণ্ড মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়। আর যদি রোগী শিশু বা বয়স্ক ব্যক্তি হন অথবা অন্যান্য দীর্ঘস্থায়ী স্বাস্থ্যগত সমস্যা যেমন: ডায়াবেটিস, হৃদরোগ বা হাঁপানি থেকে থাকে, তাহলে জটিলতা মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে।

আইইডিসিআর এবং ন্যাশনাল ইনফ্লুয়েঞ্জা সেন্টারের পরিচালক অধ্যাপক ডা. তাহমিনা শিরিন বাংলাদেশে ইনফ্লুয়েঞ্জা সারভিল্যান্স থেকে প্রাপ্ত ফলাফল তুলে ধরেন। তিনি জানান, ২০০৭ সাল থেকে সরকারি-বেসরকারি ১২টি হাসপাতালে এই সার্ভিল্যান্স শুরু হয়। বর্তমানে ১০টি টারশিয়ারি ও ৯টি জেলা হাসপাতালে কার্যক্রম চলমান রয়েছে। এ সার্ভিল্যান্সের আগে দেশের মানুষ ইনফ্লুয়েঞ্জার সঠিক সময় জানত না। সার্ভিল্যান্সের আওতায় ২০০৭ সালের মে থেকে ২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ১ লাখ ১৫ হাজার ৫৮০ জন রোগীর গলা এবং নাকের সোয়াব (নমুনা) সংগ্রহ করে পরীক্ষা করা হয়। স্বল্প সময়ের জ্বর এবং কাশির অভিযোগ নিয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের ল্যাবরেটরিতে নমুনা পরীক্ষায় ১৩ হাজার ২৩৪ জন অর্থাৎ ১১ দশমিক ৫ শতাংশের রোগীর মাঝে ইনফ্লুয়েঞ্জার উপস্থিতি পাওয়া যায়। রোগীদের মধ্যে প্রায় প্রতি ১০০ জনে ১ জন হাসপাতালেই মারা যান। তবে ৬০ বছরের বেশি বয়স্ক ব্যক্তি এবং দীর্ঘস্থায়ী রোগে আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে এই মৃত্যুর হার স্বাভাবিকের চেয়ে তিনগুণ বেশি দেখা যায়।

অধ্যাপক ডা. তাহমিনা শিরিন বলেন, ‘তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, বাংলাদেশে সারা বছরই ফ্লু শনাক্ত হয়ে থাকে। তবে প্রতি বছরের এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বরে ফ্লু শনাক্তের হার ৬ গুণ বৃদ্ধি পায়। জুন থেকে জুলাইয়ে এর প্রকোপ সর্বোচ্চ হয়। এ কারণে এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশে ইনফ্লুয়েঞ্জা মৌসুম হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। তিনি মৌসুম শুরুর আগেই ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীকে ইনফ্লুয়েঞ্জা টিকা নিয়ে সুরক্ষিত রাখার প্রতি এবং ইনফ্লুয়েঞ্জার মৌসুমে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারে সতর্কতা অবলম্বন করার প্রতি গুরুত্বারোপ করেন।

আইসিডিডিআর,বি’র অ্যাসোসিয়েট সায়েন্টিস্ট ডা. ফাহমিদা চৌধুরী বিশ্বব্যাপী ফ্লু সংক্রমণের ধরন সম্পর্কে ধারণা দেন। তিনি বলেন, ‘বিশ্বে প্রতিবছর ২ লাখ ৯০ হাজার থেকে ৬ লাখ ৫০ হাজার মানুষ ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। এ সময় তিনি বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে ইনফ্লুয়েঞ্জার মৌসুমি বৈচিত্র্য তুলে ধরার পাশাপাশি এবং ফ্লু টিকা দেওয়ার সঠিক সময়ের ওপর ধারণা দেন। তিনি বলেন, বিশ্বের বিভিন্ন উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশ তাদের ফ্লু মৌসুমের আগে ফ্লু ভ্যাকসিন কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে।

সেমিনারে ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস থেকে সর্বোচ্চ সুরক্ষা নিশ্চিতে প্রতিবছর ফেব্রুয়ারি থেকে মার্চের মধ্যে ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের টিকা বা ফ্লু-শট নেওয়ার সুপারিশ করেন গবেষকরা। সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা ইনফ্লুয়েঞ্জার একটা মহামারি আশঙ্কা এবং অ্যান্টিবায়োটিকের অযৌক্তিক ব্যবহার প্রতিরোধের ওপর জোর দেন। তিনি বলেন, চলমান এই ফ্লুর মৌসুমে যদি জ্বর, সর্দি, কাশির মতো লক্ষণ দেখা দেয়, তাহলে অ্যান্টিবায়োটিক নেওয়ার আগে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। যাতে করে ওষুধের প্রতি রেজিসট্যান্স (অকার্যকারিতা) তৈরি না হতে পারে। এছাড়াও হাত ধোয়া, মাস্ক পরা এবং কাশি দেওয়ার শিষ্টাচারগুলো সারা বছর মেনে চললে শুধু ইনফ্লুয়েঞ্জা বা শ্বাসতন্ত্রের অসুখ নয়, অন্যান্য সংক্রামক রোগ প্রতিরোধ সম্ভব হবে।

বিশেষ অতিথির বক্তব্যে আইসিডিডিআর,বি’র নির্বাহী পরিচালক ড. তাহমিদ আহমেদ বৈশ্বিক জনস্বাস্থ্য নীতিনির্ধারণে বাংলাদেশে ইনফ্লুয়েঞ্জা সারভিল্যান্সের গুরুত্ব তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ‘২০০৮ থেকে ২০১০ সালে আইসিডিডিআর,বি’র বিজ্ঞানী ড. কে জামান গবেষণা করে দেখেছিলেন যে গর্ভাবস্থায় মাকে ইনফ্লুয়েঞ্জা ভ্যাকসিন দিলে মায়ের পাশাপাশি নবজাতকেরও ৬৩ শতাংশ রোগের ঝুঁকি কমিয়ে দেয়। এ গবেষণার ফলাফলের ভিত্তিতে পরবর্তী সময়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা গর্ভাবস্থায় মায়েদের ফ্লু ভ্যাকসিন দেওয়ার পরামর্শ দেয়।’

সেমিনারে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ইনফেকশাস হ্যাজার্ড ম্যানেজমেন্ট অফিসার ড. এএসএম আলমগীর, ইউএস-সিডিসির এপিডেমিওলজিস্ট, ড. গ্রেচেন কাওম্যান, গ্লোবাল হেলথ ডেভেলপমেন্ট (জিএইচডি) এবং ইস্টার্ন মেডিটার্নিয়ান পাবলিক হেলথ নেটওয়ার্কের প্রতিনিধি অধ্যাপক ড. মাহমুদুর রহমান বিশেষ অতিথি ছিলেন।

প্রবাস বাংলা ভয়েস /ঢাকা/ ১৭ এপ্রিল ২০২৪ /এমএম