প্রবাস বাংলা ভয়েস ডেস্ক :: এখন আমাদের মধ্যে যাদের বয়স ৩০ বছরের বেশি তাদের বাবা ও মায়ের সঙ্গে আলাপ করলে নিশ্চিত হওয়া যাবে জন্মের সময় মায়ের সিজারিয়ান অপারেশন দরকার হয়নি। নরসিংদীর মাধবদীতে একই পরিবারের ১২ জন সন্তান জন্ম নিয়েছে, ওই ১২ সন্তানের সর্বশেষ সন্তানের বয়স এখন ২৩; কিন্তু এই ১২ জনের একজনের জন্মের সময়ও সিজারিয়ান অপারেশন দরকার হয়নি।
ভোলা জেলার দৌলতখান উপজেলার একটি পরিবারের জন্ম নেয় ১০ সন্তান। ওই ১০ সন্তানের মধ্যে সাতজন ছেলে এবং ৩ জন মেয়ে। সর্বশেষ সন্তান এখন বিএসএস অনার্সে পড়ছেন, এদের কারো জন্মের সময় সিজার অপারেশন দরকার হয়নি।
এভাবে পাঁচ থেকে ১০-১২ জন করে সন্তান জন্ম হতো তিন দশক আগে, এসব জন্মের সময় নরমাল ডেলিভেরি হতো। অনেক ক্ষেত্রে হাসপাতালে যাওয়ারও দরকার হয়নি। বাসায়ই ধাত্রীর সহযোগিতায় জন্ম নিয়েছেন নবজাতক।
এখন কিন্তু সেই চিত্র বিরল হয়ে যাচ্ছে। মানুষের মনমানসিকতার পরিবর্তন এসেছে। শিশু জন্মদানের স্বাভাবিক প্রক্রিয়া হচ্ছে নরমাল ডেলিভারি। আমার কেন সেই অবস্থান থেকে সরে যাচ্ছি। আমরা যদি উদাহরণ দিয়ে বলি, যিনি কম্পিউটার আবিষ্কার করেছেন তিনি এটার পরিচালনার একটি গাইডলাইন দিয়ে দিয়েছেন।
একইভাবে মানুষ সৃষ্টিকারী তার জীবনযাপন ও বংশ বৃদ্ধির স্বাভাবিক নিয়ম বাতলে দিয়েছেন; কিন্তু সেই নিয়মে থাকলে সমস্যা কোথায়? বৈশ্বিক নানা পরিবর্তনে আমরা স্বাভাবিক নিয়মে বাইরে যেতে চাই। অনেকে স্বাভাবিক জন্মদানে কষ্ট অনুভব করতে চান না, কেউ বলেন ঝুঁকি নিতে চাই না।
অথচ স্বাভাবিক জন্মদানের চাইতে সিজারে ঝুঁকি বেশি। খরচও বেশি এবং সিজার অপারেশনের পর গর্ভধারিনী ও নবজাতকের নানাবিদ সমস্যাও দেখা দেয়। কিন্তু কেন এরপরও আমরা স্বাভাবিক জন্মে ফিরছি না?
আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা ‘সেভ দ্য চিলড্রেন’ বলছে, সিজারিয়ানে সন্তান জন্মদানে রয়েছে নানা রকম ঝুঁকি। সংস্থাটি বলছে এতে মা ও শিশু উভয়কেই এমন অস্ত্রোপচার ঝুঁকিতে ফেলে। শিশু জন্মে অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচারের ফলে ইনফেকশন ও মাত্রাতিরিক্ত রক্তক্ষরণ, অঙ্গহানি, জমাট রক্ত ইত্যাদির কারণে মায়েদের সুস্থতা ফিরে পেতে প্রাকৃতিক প্রসবের তুলনায় অনেক দীর্ঘ সময় লাগে।
এছাড়া সিজারিয়ানের কারণে প্রাকৃতিক জন্মের লাভজনক দিকগুলোও নষ্ট হতে পারে। যেমন- শিশু মায়ের প্রসবের পথ দিয়ে যদি স্বাভাবিকভাবে বের হয় তাহলে তার শরীর কিছু ভালো ব্যাকটেরিয়া গ্রহণ করতে পারে। এসব ব্যাকটেরিয়া শিশুর রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি করে। অস্ত্রোপচারের ফলে এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে সে যেতে পারে না। যার ফলে এই ভালো ব্যাকটেরিয়া সে পায় না।
এছাড়া মায়ের বুকের দুধ পান করার জন্য মায়ের সঙ্গে শিশুর যে শারীরিক নৈকট্যে আসা দরকার সিজারিয়ান হলে সেটি প্রয়োজনের তুলনায় দেরিতে ঘটে। কারণ মায়ের সুস্থ হয়ে ওঠার জন্য শিশুকে তখন কিছু সময় দূরে রাখা হয়। একদম শুরুর দিকে মায়ের বুক দুধের বাড়তি উপকারিতা রয়েছে। তা থেকে সে বঞ্চিত হয়।
‘সেভ দ্য চিলড্রেন’ তাদের এ সমীক্ষায় দেখিয়েছে, বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে যত শিশু জন্ম নেয় তার ৮০ শতাংশই হয় অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে। সংস্থাটি আরও বলছে, ২০১৮ সালে যত সিজারিয়ান হয়েছে তার ৭৭ শতাংশই চিকিৎসাগতভাবে অপ্রয়োজনীয় ছিল। কিন্তু তারপরও এমন সিজারিয়ান হচ্ছে।
প্রতিবেদনটিতে আরো বলা হয়, ২০০৪ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত বাংলাদেশে প্রসবকালীন অস্ত্রোপচার ৪ থেকে ৩১ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে। এমন অপ্রয়োজনীয়ে প্রসবকালীন অস্ত্রোপচার ঠেকাতে ডাক্তারদের ওপর নজরদারির পরামর্শ দিচ্ছে সেভ দ্য চিলড্রেন।
বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক অ্যান্ড হেলথ সার্ভে (বিডিএইচএস) ২০২২-এর প্রাথমিক ফলাফলে দেখা গেছে, দেশে সিজারিয়ান সেকশন বা অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে সন্তান জন্মদানের প্রবণতা বাড়ছে। ২০১৭ সালের তুলনায় ২০২২ সালে সিজারের ঘটনা বৃদ্ধি পেয়ে ৩৪ শতাংশ থেকে ৪৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। এ পরিসংখ্যান ভবিষ্যতের জন্ম ভালো কিছু বয়ে আনবে না।
পরিসংখ্যান বলছে- দুই দশক আগেও গর্ভবতীরা সিজার অপারেশনে এত বেশি আগ্রহী হননি। দিন যত যাচ্ছে এই প্রবণতা ততই বাড়ছে। অথচ আগে অদক্ষ ধাত্রীরাই স্বাভাবিক নিয়মে শিশু জন্মদান প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতেন। এখন এই আধুনিক যুগে এসে ধাত্রী প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রয়েছে; কিন্তু আমাদের দেশ এ বিষয়ে কার্যকরি কোনো পদক্ষেপে যাচ্ছে না। অথচ পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত সরকারও ধাত্রী প্রশিক্ষণে বেশ আগ্রহী। আমরাও এ বিষয়ে উদ্যোগী হতে পারি।
‘দ্য স্টেট অব দ্য ওয়ার্ল্ডস মিডওয়াইফারি ২০২১’ শীর্ষক এক বৈশ্বিক প্রতিবেদন বলছে- নিরাপদ মাতৃত্বের জন্য মিডওয়াইফারি সেবা অপরিহার্য। এ সেবা মাতৃমৃত্যুর হার কমাতে বিশেষ ভূমিকা রাখে। ওই প্রতিবেদন জানায়- বাংলাদেশে প্রতি ১০ হাজার জনে আছেন শূন্য দশমিক ৩ জন পেশাদার মিডওয়াইফ বা ধাত্রী। ২০২১ সালে প্রকাশিত ওই তথ্য দেশের স্বাভাবিক জন্মদানের জন্য খুবই হতাশাজনক। ৩৩টি সংস্থার সহযোগিতায় এ প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিল (ইউএনএফপিএ), বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) এবং ইন্টারন্যাশনাল কনফেডারেশন অব মিডওয়াইফস (আইসিএম)।
লেখক: হাসান আল বান্না, সাংবাদিক ও কলামিস্ট
প্রবাস বাংলা ভয়েস /ঢাকা/ ২৫ মার্চ ২০২৪ /এমএম