প্রবাস বাংলা ভয়েস ডেস্ক :: ইউনিসেফের শিশুদের জন্য জলবায়ু ঝুঁকি সূচক বা চিলড্রেনস ক্লাইমেট রিস্ক ইনডেক্সে বাংলাদেশের অবস্থান ১৬৩ দেশের মধ্যে ১৫তম। বিভিন্ন গবেষক ও প্রতিষ্ঠানের গবেষণায় দেখা গেছে, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট নেতিবাচক প্রভাবের দিক থেকে বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম অরক্ষিত দেশগুলোর একটি। জলবায়ু পরিবর্তন যেভাবে সামাজিক সমস্যাগুলোকে প্রকট করছে, তাতে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে পড়ছে শিশুরা। ইউনিসেফের ২০১৯ সালের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সম্পর্কিত বিধ্বংসী বন্যা, ঘূর্ণিঝড় ও অন্য পরিবেশগত বিপর্যয়গুলো বাংলাদেশে ১ কোটি ৯০ লাখের বেশি শিশুর জীবন ও ভবিষ্যৎকে হুমকির মুখে ফেলছে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তন একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ, যা দরিদ্র বাংলাদেশিদের ঘরবাড়ি, আত্মীয়স্বজন ও নিজ সামাজিক গোষ্ঠীদের ফেলে অন্যত্র নতুন করে জীবন শুরু করার চেষ্টার দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
অনেকে ঢাকা ও অন্য বড় শহরগুলোয় যাচ্ছে, যেখানে শিশুদের বিপজ্জনক শ্রম বা বাল্যবিয়ের ঝুঁকির দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। ইতোমধ্যেই দেশে ৬০ লাখ জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অভিবাসী রয়েছে, যা ২০৫০ সালের মধ্যে বেড়ে দ্বিগুণেরও বেশি হতে পারে। এছাড়া উপকূলীয় অঞ্চলে বসবাসকারী আরও ৪৫ লাখ শিশু নিয়মিত শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় দ্বারা আক্রান্ত হয়।
বস্তুত প্রতিটি সংকটে শিশুরাই সবচেয়ে বেশি অসহায় হয়। জলবায়ু পরিবর্তনও এর ব্যতিক্রম নয়। যে সময়টাতে মানুষ বিকশিত হয়, সে বয়সটাই শিশু বয়স। নিঃসন্দেহে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে যে বহুমুখী পরিবর্তনগুলো হচ্ছে, তা থেকে শিশুরা রক্ষা পাবে না। সেজন্য জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলার পরিকল্পনার ক্ষেত্রে শিশুদের বিষয় আলাদা করে বিবেচনায় নেওয়া দরকার।
তাপমাত্রা বাড়লে মশাবাহিত ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, ম্যালেরিয়া বেড়ে যাবে। বৃষ্টির সময়ে ঠান্ডা বা ঠান্ডার সময়ে বৃষ্টি হলে হাঁচি-কাশির মাধ্যমে যে রোগগুলো ছড়ায়, সেগুলো ছড়াবে। মলমূত্র, স্পর্শের মাধ্যমে রোগবালাই ছড়াবে।
শিশুদের ঝুঁকি বড়দের চেয়ে বেশি। গরম ও অন্যান্য জলবায়ুসংক্রান্ত সমস্যার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার সক্ষমতা বড়দের তুলনায় তাদের কম। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম হওয়ায় তাদের ডায়রিয়া ও অন্যান্য প্রাণঘাতী রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে। পুষ্টিহীনতায় ভোগারও ঝুঁকি থাকে এসব শিশুদের। প্রাকৃতিক দুর্যোগে আক্রান্ত পরিবারগুলো যখন ঘরবাড়ি হারাচ্ছে, তখন সেই পরিবারের শিশুরা অর্থ-উপার্জনের জন্য কোনো না কোনো কাজে যোগ দিতে বাধ্য হচ্ছে। এর ফলে শিশুদের নানা ধরনের নির্যাতনের শিকার হওয়ার আশঙ্কা বাড়ছে বলে ইউনিসেফের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। দায়িত্ব নিতে না পেরে মেয়ে শিশুদের অনেক পরিবার দ্রুত বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে।
সারা দেশে বিশটি জেলার শিশুরা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের তিন জেলা খুলনা, সাতক্ষীরা ও ভোলায় জলবায়ু পরিবর্তন ব্যাপকভাবে প্রভাব ফেলছে। ঘনঘন দুর্যোগের সম্মুখীন হচ্ছে এ জেলাগুলো। বঙ্গোপসাগরের উপকূল ঘেঁষে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি এ সংকটকে আরও ঘনীভূত করছে। পানির লবণাক্ততাও একটি প্রধান সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। উপকূলের অনেক এলাকা এখন এ সমস্যায় আক্রান্ত।
এসবের ফলে শিশুদের স্বাস্থ্য ও শিক্ষার সম্ভাবনা নস্যাৎ হয়ে যায়। শোষণমূলক শিশুশ্রম, শিশু বিয়ে ও পাচারের ফাঁদে আটকা পড়ছে লাখ লাখ শিশু। এদের মধ্যে সবচেয়ে নাজুক অবস্থানে আছে শহরের বস্তিতে বাস করা শিশুরা। তাদের অনেকেই ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করছে, বাল্যবিয়ের শিকার, এমনকি যৌনকর্মীতেও পরিণত হচ্ছে।
প্রাকৃতিক এ প্রক্রিয়াকে এককভাবে কোনো দেশই নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না। বায়ু, মাটি, পানি দূষণ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। টক্সিক কেমিক্যালের ব্যবহার সহনীয় মাত্রায় রাখলে সেটা পরিবেশের ক্ষতি করবে না। এগুলো নিয়ন্ত্রণে কাজ করতে হবে।
জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে শিশুদের সুরক্ষা প্রদানে বেশকিছু উদ্যোগ বাস্তবায়নে সরকারকে সহযোগিতা দিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও অন্য অংশীদারদের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে। পরিবেশগত অবক্ষয়, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিশ্বের প্রতিটি দেশের শিশু-কিশোরের ভবিষ্যৎ হুমকির মুখে।
জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কে বিভিন্ন আলোচনা পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করা দরকার। যখন শিশুরা একবার তাদের চারপাশে পরিবেশগত সমস্যাগুলোর অস্তিত্ব ও জরুরি দাবি সম্পর্কে জানতে পারবে, তখন তারা আরও সচেতন হবে, পরিবেশ বিপর্যয় থেকে রক্ষায় কৌশলী হতে পারবে এবং বিশ্বের পরিবেশ রক্ষায় তারাও ভূমিকা রাখতে পারবে।
বৈশ্বিক এ সংকট মোকাবিলায় সরকারি-বেসরকারি ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর একযোগে কাজের কোনো বিকল্প নেই। সরকারের পাশাপাশি প্রত্যেকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে ভূমিকা নিলে হয়তো আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষতি থেকে রক্ষা করা সম্ভব হবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে কম বয়সিরাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে; নিরাপদ থাকছে না গর্ভের শিশুও।
জীববৈচিত্র্যে আমরা সমৃদ্ধ। কিন্তু নিজের স্বার্থে যারা পরিবেশ-প্রকৃতি ধ্বংস করে, বড় বড় শিল্পপতি হয়েও যারা পরিবেশের ক্ষতির দিকটি মাথায় রাখে না, বরং ধ্বংস করে, নদীর মৃত্যু ঘটায়, তারা দেশ, জাতি ও মানুষের শত্রু।
গত কয়েক বছরে সরকার দুর্যোগ ঝুঁকি কমানোর (ডিআরআর) ক্ষেত্রে অনেক অগ্রগতি অর্জন করেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সৃষ্ট ঝুঁকিগুলোকে শনাক্ত করেছে বাংলাদেশ সরকার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জলবায়ু পরিবর্তন অভিঘাতে সবচেয়ে ক্ষতির সম্মুখীন দেশগুলোর সংগঠন ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরাম সিভিএফের চেয়ারপারসন। তিনি এ বিষয়ে সব সময় বিশ্বে সরব ভূমিকা রেখেছেন।
উপকূলীয় এলাকায় বাংলাদেশ বহু ভবন নির্মাণ করেছে, যা ঘূর্ণিঝড়ের সময় আশ্রয়কেন্দ্র হিসাবে ব্যবহৃত হয়। এর ফলে দুর্যোগে মৃত্যুহার উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। তবে সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি ও উপার্জন হারানোর হার ক্রমেই বাড়ছে। সরকার জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলা সংক্রান্ত কর্মকাণ্ডে উন্নয়ন ও অনুন্নয়ন খাতে বার্ষিক বরাদ্দের ৬ থেকে ৭ শতাংশ ব্যয় করছে। বছরে এ অর্থের পরিমাণ দাঁড়ায় ১০০ কোটি ডলারের সমপরিমাণ। এ বিপুল বিনিয়োগের সঙ্গে প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা আরও বাড়াতে হবে; আর্থিক পরিকল্পনা, তদারকি, রিপোর্টিং ও কার্যকর নীতি গ্রহণ করতে হবে।
ফাতেমা ইয়াসমিন : ঊর্ধ্বতন ব্যবস্থাপক, মানবসম্পদ বিভাগ, উত্তরা ক্রিসেন্ট হাসপাতাল লি., ঢাকা
প্রবাস বাংলা ভয়েস /ঢাকা/ ০১ মার্চ ২০২৪ /এমএম