Menu

প্রবাস বাংলা ভয়েস ডেস্ক ::‌ জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) মতে, ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে খাদ্য রপ্তানি ব্যাহত হওয়ায় বিশ্বে খাবারের উচ্চমূল্য নতুন রেকর্ড গড়েছে। দেশে বেশকিছু সময় ধরে বিভিন্ন ধরনের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রীর মূল্য অস্বাভাবিকভাবে বাড়ছে। প্রতিদিন লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে নিত্যপণ্যের দাম। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে পেশাজীবীসহ নিু-আয়ের জনগোষ্ঠীর জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। দেশের সিংহভাগ মানুষ তাদের চাহিদা মেটাতে অক্ষম হয়ে পড়ছেন। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যমূল্য বর্তমানে সাধারণ মানুষের ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যাচ্ছে। সামগ্রিক বাজারব্যবস্থা স্থিতিশীল রাখতে সরকার ইতোমধ্যে বেশকিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ নিয়েছে। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক, সোনালী ব্যাংকসহ সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোয় ভোজ্যতেল, চিনি, ডাল, ডিম, আলু ও পেঁয়াজের এলসি খুলতে সমস্যা যেন না হয়, সেদিকে নজর রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি কোল্ডস্টোরেজ গেটে আলুর কেজি ২৭ টাকা ও ৩৬ টাকা খুচরা মূল্য নিশ্চিত করতে জেলা প্রশাসকদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এটি বাস্তবায়নে জেলা প্রশাসকরা প্রতিটি কোল্ডস্টোরেজে একজন করে কর্মকর্তা নিয়োগ দিয়েছেন।

গত ১২ নভেম্বর দ্রব্যমূল্য ও সার্বিক বাজার পরিস্থিতি নিয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে উপস্থাপিত তথ্যসূত্রে জানা যায়, দেশে আলুর দাম বেড়ে গেলে আলুর বাজার নিয়ন্ত্রণে প্রথমে মূল্য বেঁধে দেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। পরবর্তীকালে কৃষি মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলোচনাসাপেক্ষে আলু আমদানির অনুমোদন দেওয়া হয়। আলু আমদানির জন্য ২ লাখ টনের আইপিও দেয় কৃষি মন্ত্রণালয়। এছাড়া ডিমের দাম নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে অনুমোদন দেওয়া ২৫ কোটি পিসের মধ্যে এখন পর্যন্ত ৬২ হাজার পিস ডিম আমদানি হয়েছে। গৃহীত পদক্ষেপের দৃশ্যমান প্রভাবে খুচরা বাজারে আলু ও ডিমের দাম কমতে শুরু করেছে এবং বাজার পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত আলু ও ডিম আমদানি অব্যাহত থাকবে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। ওই সংবাদ সম্মেলনে আরও বলা হয়, ১৪ নভেম্বর থেকে সরকার রাজধানীতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি)-এর মাধ্যমে পুনরায় ঢাকা শহরের বিভিন্ন পয়েন্টে ট্রাকে ডাল, তেল, আলু ও পেঁয়াজ বিক্রি শুরু করেছে। ৩০টি ট্রাক থেকে প্রতিদিন ৯০০ জন এ পণ্য ক্রয় করতে পারবেন। বেশি পণ্য সংগ্রহসাপেক্ষে আগামী দিনে ট্রাকসেলের সংখ্যা আরও বাড়ানো হবে। মূলত ঢাকায় বসবাসকারীদের মধ্যে যারা টিসিবির কার্ডধারী হতে পারেননি, তাদের জন্যই এ উদ্যোগ নেয় টিসিবি।

নানা উদ্যোগ নেওয়ার পরও কেন সংকট কাটছে না-এমন প্রশ্নের জবাবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব বলেছেন, ‘বাজার থেকে বড় কোম্পানিগুলো আইন অমান্য করে মূল্য বাড়িয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান চলছে। ইতোমধ্যে বেশি মূল্য বাড়িয়ে পণ্য বিক্রির অভিযোগে ৬৫টি কোম্পানির বিরুদ্ধে প্রতিযোগিতা কমিশনে মামলা চলমান। দুটি কোম্পানির বিরুদ্ধে ৮ কোটি ৪৪ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে।’

বৈশ্বিক মন্দার প্রভাব, বিশেষ করে রাশিয়া-ইউক্রেন ও ইসরাইল-ফিলিস্তিন সংঘাত পুরো বিশ্বকে লন্ডভন্ড করে দিচ্ছে। এরই সুযোগে দেশে নানা অপপ্রচার ও গুজবের মাধ্যমে পণ্যের কৃত্রিম সংকট তৈরি করে দ্রব্যমূল্য বাড়িয়ে দিচ্ছে অসাধু ব্যবসায়ীরা। এই বেপরোয়া সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্যরে লাগাম টানা অতীব জরুরি হয়ে পড়েছে। বিদেশ থেকে পণ্য আমদানি করেও পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকারকে হিমশিম খেতে হচ্ছে। এসব সিন্ডিকেটের মদদদাতা হিসাবে নষ্ট চরিত্রের কতিপয় রাজনৈতিক নেতার যোগসাজশ থাকার বিষয়ে জনশ্রুতি রয়েছে। নিকট অতীতের কপর্দকহীন এসব ব্যক্তি নাকি অল্প সময়ের মধ্যেই হাজার কোটি টাকার মালিক বনে গেছে এবং এ অবৈধ উপার্জনের বিনিময়ে পদ-পদবি লাভের জন্য আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে নানামুখী প্রস্তুতি গ্রহণ করছে। নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য কাউকে মনোনয়ন দেওয়ার আগে দলগুলোর উচিত সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে যাচাই-বাছাই করে সৎ-যোগ্য-নির্লোভ-নির্মোহ ও জনপ্রিয় দেশপ্রেমিক ব্যক্তিদের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সুযোগ দেওয়া। কোনো অসৎ ব্যক্তি যেন কোনোভাবেই লবিং-তদবির বাণিজ্যের অপকৌশলে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে না পারে, সেদিকে সতর্কতা অবলম্বন আবশ্যক। আশার বিষয়, অতিসম্প্রতি সরকার সিন্ডিকেটেড বাণিজ্য এবং দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে অশুভ এসব শক্তিকে চিহ্নিত করে শাস্তির আওতায় আনার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। আশা করা যায়, দ্রুততর সময়ের মধ্যে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সক্ষম হবে সরকার।

আমদানিনির্ভর পণ্যের সরবরাহ কমে গেলে বাজারে সংকট দেখা দেয় এবং দাম বৃদ্ধি পায়। কিন্তু দেশে উৎপাদিত পণ্যের সংকট তৈরি করে একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী কর্তৃক সেসব পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেওয়ার অভিযোগ দীর্ঘদিনের। ক্রমাগত দাম বাড়তে থাকা পণ্যের আমদানির সিদ্ধান্ত নিলে তা কখনো কখনো কমতে শুরু করে। এভাবে সাময়িকভাবে বাজার কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করা গেলেও ব্যবসায়ীদের ঘৃণ্য সিন্ডিকেট ভাঙা সম্ভব হয় না। এমন পরিস্থিতিতে বিশেষজ্ঞরা বাজারে প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ তৈরি, শুল্কহার কমিয়ে আমদানির ক্ষেত্র বৃদ্ধি এবং মূল্যস্ফীতিতে লাগাম টানতে পদক্ষেপ নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। কেউ বেআইনিভাবে খাদ্যদ্রব্য মজুত বা মজুতসংক্রান্ত সরকারের নির্দেশনা অমান্য করলে প্রয়োজনে তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের বিধান রেখে চলতি বছরে পাশ হওয়া ‘খাদ্যদ্রব্য উৎপাদন, মজুত, স্থানান্তর, পরিবহণ, সরবরাহ, বিতরণ (ক্ষতিকর কার্যক্রম প্রতিরোধ) আইন’-এর আওতায় আনার সুপারিশ করেছেন। ক্যাবের সভাপতি গণমাধ্যমে বলেছেন, ‘দেশে মজুত আইন আছে, এটি সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়ন করলে কেউ মজুত করে সংকট সৃষ্টি করতে পারবে না। ওই আইন প্রয়োগ করে ব্যবসায়ীকে তাদের অপকর্মের জন্য দ্রুত শাস্তির আওতায় আনার নজির খুব বেশি নেই। বাজার অভিযান করে মাঝেমধ্যে কিছু জরিমানা করা হয়। কিন্তু বড় ব্যবসায়ীরা সব সময়ই ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে। এ ব্যাপারে সরকারের আরও কঠোর হওয়ার প্রয়োজন আছে বলে মনে করি।’ সার্বিক বিবেচনায় এটি স্পষ্ট যে, হীন সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীদের কঠোর হস্তে দমন করা না গেলে বাজারব্যবস্থাকে স্থিতিশীল ও টেকসই করার কোনো প্রচেষ্টাই সুফল বয়ে আনবে না।

ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী : শিক্ষাবিদ; সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

প্রবাস বাংলা ভয়েস /ঢাকা/ ২৪ নভেম্বর ২০২৩ /এমএম