Menu

প্রবাস বাংলা ভয়েস ডেস্ক ::‌  বর্তমান বিশ্বে ৪০ শতাংশ মানুষের বসবাস অত্যন্ত নিুমানের আবাসস্থলে। বিশ্বের এ বৃহৎ জনগোষ্ঠী জীবনের মৌলিক অধিকার থেকেও বঞ্চিত। তাদের আবাসস্থলকে বিভিন্ন ধরনের জীবাণুর বাহকের উৎপত্তিস্থল হিসাবে গণ্য করা হয়। তাদের আবাসভূমি ও চারপাশ থেকে উৎপন্ন বাহকের মাধ্যমে ছড়ানো ২০টিরও বেশি রোগকে নেগলেকটেড ট্রপিক্যাল ডিজিজ (এনটিডি) বলা হয়। রোগগুলো বাহকের মাধ্যমে যেসব জীবাণু দ্বারা সংক্রমিত হয় সেগুলো হলো-ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, নেমাটেডি, একটিনো মাইসেটস, ফাঙ্গাস, প্যারাসাইটস ইত্যাদি। ডেঙ্গুও এই এনটিডির অন্তর্ভুক্ত।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২০২১-২০৩০-এ দশককে এনটিডিমুক্ত বিশ্ব গড়ে তোলার লক্ষ্যে রোডম্যাপ ঘোষণা করেছে এবং সে লক্ষ্য সামনে রেখে এসডিজি অর্জনকল্পে অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে। ইউনিভার্সেল হেলথ কভারেজ অর্থাৎ সবার জন্য সমান স্বাস্থ্য সুবিধা নিশ্চিতকরণই এর মূল উদ্দেশ্য। অভিন্ন লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে ওয়ার্ল্ড মস্কুইটো প্রোগ্রাম (ডব্লিউএমপি), যার মধ্যে রয়েছে মূলত মশাবাহিত রোগ যেমন: ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, ইয়েলো ফিভার, ম্যালেরিয়া, ফাইলেরিয়া ইত্যাদি। বর্তমান বিশ্বে, বিশেষ করে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও ল্যাটিন আমেরিকায় ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়েই চলেছে। বেড়ে চলেছে মৃত্যুর মিছিলও। এ ভয়াবহ পরিস্থিতিতে ডব্লিউএমপি মশা নিধনে অভিনব পদ্ধতির গবেষণা এবং যথাযথ প্রয়োগের ওপর গুরুত্বারোপ করছে।

উপর্যুপরি গবেষণা করে মশার গতিপ্রকৃতি ও দমন ব্যবস্থাপনার অত্যন্ত গতিশীল বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির জুতসই ব্যবহার নিশ্চিতকরণের প্রাণান্তর চেষ্টা করা হচ্ছে। এরই একটি সফল গবেষণালব্ধ ফলাফল হলো, ডেঙ্গু প্রতিরোধে প্যারাসাইটের ব্যবহার। অর্থাৎ জৈবিক পদ্ধতিতে এডিস মশার ডেঙ্গু ভাইরাস ছড়ানোর ক্ষমতাকে রহিত করা, যা সম্পূর্ণ পরিবেশবান্ধব ও নিরাপদ পদ্ধতি। এ পদ্ধতি আর্থিকভাবে সাশ্রয়ী ও টেকসই। বর্তমানে মশা মারার জন্য ব্যবহৃত কীটনাশক যেমন পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে, একইভাবে অন্য প্রাণীর প্রভূত ক্ষতিসাধন করছে এবং মশাকেও প্রতিরোধী করে তুলে রোগবিস্তারে ব্যাপক ভূমিকা রাখছে। তাই মশা দমনে প্রচলিত সব পদ্ধতির সঙ্গে সমন্বয় করে অর্থাৎ সমন্বিত বাহক ব্যবস্থাপনায় যতগুলো পদ্ধতির কথা বলা হয়ে থাকে, সব পদ্ধতির সঙ্গে জৈবিক পদ্ধতির ওপর বেশি গুরুত্বারোপ করতে হবে। কারণ উলবাকিয়া ব্যাকটেরিয়া ও বিটিআইসহ অন্য জৈবিক পদ্ধতিগুলো যেমন পরিবেশবান্ধব ও দীর্ঘমেয়াদি, তেমনি টেকসই। তবে এজন্য যে অবকাঠামো ও অভিজ্ঞ জনবল প্রয়োজন, তা অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে।

বাংলাদেশের এক বিশাল জনগোষ্ঠী বোঝেই না মশা, মাছি, ছারপোকা ইত্যাদি পোকামাকড়ের মাধ্যমে কী ধরনের রোগ-জীবাণু ছড়ায়। মনে রাখতে হবে, মানুষের শরীর ক্ষত করে অথবা রক্তশোষণ করে এমন পোকামাকড় অবশ্যই রোগের জীবাণু বহন করে এবং রোগ ছড়ায়। তাই এসব থেকে নিজেদের রক্ষায় যথেষ্ট সচেতন হতে হবে। এসব বাহকের উৎপত্তিস্থল যেমন ধ্বংস করতে হবে, তেমনি ধ্বংস করতে হবে ওইসব জীবাণু বা অণুজীবের উৎপত্তিস্থলও। আর এ জন্যই সমন্বয়ের বিকল্প নেই। সবার জন্য ইউনিভার্সেল হেলথ কভারেজ নিশ্চিত করতে হলে পাবলিক স্যানিটেশন ও হাইজেন যথাযথভাবে নিশ্চিত করতে হবে। মানুষের নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের, বিশেষ করে খাবারের উৎপত্তি, বিপণন, প্রস্তুতকরণ ও সরবরাহের প্রক্রিয়া সংক্রমণমুক্ত রাখতে হবে। যেমন: মাছ, মাংস, সবজি ইত্যাদি আমাদের নিত্যপণ্যের অতিজরুরি তালিকায় রয়েছে। এখন দেখতে হবে এ পণ্যগুলোর উৎপাদন কোন প্রক্রিয়ায় হচ্ছে, অর্থাৎ কী কী উপাদান ব্যবহার করা হচ্ছে এ মাছ উৎপাদনে, এর সঙ্গে কোনো অণুজীব পরিবাহিত হচ্ছে কি না; একইভাবে মাছ বা মুরগি যখন বাজারে কাটা হয় তখন যথাযথ নিয়ম মেনে, স্বাস্থ্যবিধি অনুযায়ী তা করা হচ্ছে কিনা; মাছ, গরুর মাংস, মুরগির মাংস ইত্যাদি কাটার পর যেসব পোকামাকড় ও অণুজীবের আক্রমণ হতে পারে, তা থেকে নিরাপদ করার জন্য কোনো স্বীকৃত পদ্ধতি ব্যবহৃত হচ্ছে কি না ইত্যাদি। খাবার তখনই নিরাপদ হবে, যখন তা সব ধরনের জীবাণুর আক্রমণ থেকে মুক্ত থাকবে। এ খাবার তৈরির পর তা কোন পরিবেশে রাখা হচ্ছে ও পরিবেশন করা হচ্ছে, তা স্বাস্থ্যবিধির মধ্য দিয়ে হচ্ছে কি না, তাও দেখতে হবে।

দেশে আমরা হরহামেশা লক্ষ করি-মাছ, মাংস কাটার ক্ষেত্রে এবং কাটার পর তেমন কোনো স্বাস্থ্যবিধি মানা হয় না। আবার যে পরিবেশে মাংস ঝুলিয়ে রাখা হয়, তাও স্বাস্থ্যসম্মত নয়। বিভিন্ন স্থানে ময়লা ব্যবস্থাপনার যে বেহাল দশা এবং বদ্ধ পানির যে ভয়ংকর দূষিত অবস্থা-তা শুধু মশা, মাছি ও জীবাণুরই উৎপত্তিস্থল নয়, পরিবেশ দূষণেরও অন্যতম উপাদান। এ পরিস্থিতিতে এনটিডির যেসব রোগ রয়েছে, তার নিরাময় বিরাট বাধার সম্মুখীন। এসডিজির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক প্রদত্ত রোডম্যাপ অনুযায়ী এসব বাধা সফলভাবে অতিক্রম করতে হবে। এ লক্ষ্যে বাংলাদেশেও প্রচলিত পদ্ধতিতে মশা দমনের পাশাপাশি অস্ট্রেলিয়া, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ভিয়েতনাম, সিঙ্গাপুরসহ যেসব দেশ জৈব উপাদান ব্যবহারে সফল হয়েছে, সেসব দেশের কর্মপদ্ধতি অনুসরণ করা জরুরি।

এ গ্লোবাল ভিলেজের একটি প্রণিধানযোগ্য দেশ হিসাবে আমরা সব উন্নয়নের সূচকে এগিয়ে যাচ্ছি। তাহলে কেন অতিক্ষুদ্র একটি পতঙ্গ এডিস মশার ভয়াল গ্রাস থেকে নিজেদের রক্ষা করে এসডিজি অর্জনে সক্ষম হব না? আমাদের দেশে সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সঙ্গে সব ধরনের বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠেছে যেমন-কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, মেরিটাইম বিশ্ববিদ্যালয়, সিভিল অ্যাভিয়েশন বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ইত্যাদি। তাহলে জনস্বাস্থ্যের জন্য পাবলিক হেলথ বিশ্ববিদ্যালয় নয় কেন? পাবলিক হেলথ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে দেশের বিশাল জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতসহ সব ধরনের জনস্বাস্থ্য সম্পর্কিত সমস্যার বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও জুতসই সমাধান দ্রুত সম্ভব হবে। যেসব মানুষ এনটিডি দ্বারা আক্রান্ত হয়ে মানবতার প্যারামিটারে নিজেদের অত্যন্ত অসহায় মনে করছে, মনে মনে ভাবছে প্রকৃতি যা করবে তা-ই হবে, তাদের এ বিভ্রান্তির বেড়াজাল থেকে মুক্তির পথ উন্মোচিত হবে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে সবার সমন্বিত প্রচেষ্টায় পাবলিক হেলথ বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন, উন্নত মানের গবেষণাগার প্রতিষ্ঠা এবং বিজ্ঞ গবেষক তৈরির মাধ্যমে দেশকে এনটিডির অভিশাপমুক্ত করে সুস্থ, সাবলীল, রোগমুক্ত ও কর্মচঞ্চল জাতি হিসাবে আমরা মাথা উঁচু করে বাঁচতে পারি।

ড. মো. গোলাম ছারোয়ার : অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, কীটতত্ত্ব বিভাগ, জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান (নিপসম)

প্রবাস বাংলা ভয়েস /ঢাকা/ ২৫ অক্টোবর ২০২৩ /এমএম